কুড়িগ্রামে গত ১০ বছরে ব্রহ্মপুত্র নদের ভাঙনে নিঃস্ব হয়েছে প্রায় ৩৫ হাজার পরিবার। একসময় যাদের ছিল গোলাভরা ধান, পুকুরভরা মাছ, ফলের বাগান এবং বিঘায় বিঘায় ফসলি জমি। তারা এখন ভূমিহীনদের তালিকায়। সব হারিয়ে নির্বাক হয়ে ব্রহ্মপুত্রের দিকে তাকিয়ে থাকেন ভাঙনের শিকার ওই পরিবারগুলো।
নদীভাঙা এসব পরিবার আশ্রয় নিয়েছে বাঁধ কিংবা অন্যের বসতভিটায়।
জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন বিভাগ জানায়, ২০১৫ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত কুড়িগ্রামের নয়টি উপজেলায় ১৬টি নদ-নদীর ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে প্রায় ৩৫ হাজার পরিবার।
এর মধ্যে সদরে ১ হাজার ৮২১টি, ভূরুঙ্গামারীতে ৬০৯টি, নাগেশ্বরীতে ২ হাজার ৪২৬টি, ফুলবাড়িতে ১৮৮টি, রাজারহাটে ৪৩৯টি, উলিপুরে ৫ হাজার ৯০৪টি, চিলমারীতে ৪ হাজার ৫১৯টি, রৌমারীতে ২ হাজার ১৮৩টি ও রাজিবপুরে ৩ হাজার ৮৫টি পরিবার ঘরবাড়ি-জমি হারিয়েছে।
ব্রহ্মপুত্র নদের ভাঙনের কবলে পড়েছে বিশেষ করে রাজিবপুর উপজেলার কোদালকাটি ও মোহনগঞ্জ ইউনিয়নের শত শত ঘরবাড়ি, আবাদি জমি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও ধর্মীয় স্থাপনা। ভাঙন আতঙ্কে নির্ঘুম রাত পার করছে নদীতীরবর্তী এসব মানুষ।
সরেজমিনে দেখা যায়, কোদালকাটি ইউনিয়নের পাকান্টারী ও সাজাই গ্রামে ব্যাপক নদীভাঙন শুরু হয়েছে। এর মধ্যে কোদালকাটি বাজার, কয়েকটি স্কুল, মাদরাসা, মসজিদ এবং বাড়িঘর ভাঙনের হুমকির সম্মুখীন। তৃতীয় দফা বন্যার পানি কমার সঙ্গে সঙ্গে ভাঙনের তীব্রতা শুরু হয়েছে ব্যাপক হারে।
হুমকিতে রয়েছে এই ইউনিয়নের সবচেয়ে পুরাতন বিদ্যাপীঠ বদরপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, কোদালকাটি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়, সাদাকাত হোসেন উচ্চ বিদ্যালয়, কোদালকাটি বাজার, ইউনিয়ন পরিষদ, ইউনিয়ন ভূমি অফিসসহ প্রায় ২০টি সরকারি ও বেসরকারি স্থাপনা।
গত সাত মাসে ব্রহ্মপুত্রের ভাঙনে বিলীন হয়েছে প্রায় ৫ শতাধিক বাড়িঘর ও বসতভিটা। ভিটেমাটি হারিয়ে নিঃস্ব এসব এলাকার শত শত পরিবার। ভূমিহীন হয়ে এখন অন্যের বসতভিটা কিংবা বাঁধে আশ্রয় নিয়েছেন তারা। অনেকেই পৈতৃক ভিটা, জমিজমা হারিয়ে চলে গেছেন অন্যত্র।
ভাঙনকবলিত এসব এলাকার স্থানীয় অনেকেই জানান, এর আগেও বেশ কয়েকবার নদীতে ভেঙেছে তাদের বাড়িঘর ও পৈতৃক ভিটা। হারিয়েছেন ফলের বাগান, পুকুরভরা মাছ ও ফসলি জমি। অনেক কষ্টে এসব পরিবার কোনো রকমে মাথা গোঁজার ঠাই নিলেও এবারও পিছু নিয়েছে আগ্রাসী ব্রহ্মপুত্র। এ বছর বাড়িঘর ভেঙে যাওয়ায় আর নতুন করে বাড়ি-ঘর তৈরি করতে পারেননি অনেকেই।
গত দশ বছরে শুধু কোদালকাটি ইউনিয়নের ৩,৮,৯ নম্বর ওয়ার্ডগুলো পুরোপুরি চলে গেছে নদীগর্ভে। এই তিনটি ওয়ার্ডের প্রায় ৭ হাজার মানুষ সব কিছু হারিয়ে এখন ভূমিহীনের তালিকায়। একই চিত্র পার্শ্ববর্তী মোহনগঞ্জ ইউনিয়নেও। নয়ারচর, চর নেওয়াজি, শংকর মাধবপুর, হাজিপাড়া, ফকিরপাড়া ও ব্যাপারীপাড়া ভাঙনে এখন বিলীন।
এ ছাড়াও ভাঙনঝুঁকিতে রয়েছে ইউনিয়ন পরিষদ, মোহনগঞ্জ বাজার, স্কুল-কলেজ, মসজিদ-মাদ্রাসা, কমিউনিটি ক্লিনিকসহ নানা স্থাপনা।
কোদালকাটি ইউনিয়নের বল্লভের গ্রামের সাবিনা বেগম (৩৪) বলেন, ৫ বার বাড়ি নদীতে চলে গেছে, আবারো যাচ্ছে। আমাদের কিছুই থাকল না। ব্রহ্মপুত্র আমাদের সব শেষ করে দিয়েছে।
কোদালকাটি ইউনিয়নের পাইকানটারী (বল্লভপাড়া) এলাকার গেল্লা শেখের পুত্র গোলজার হোসেন (৩০) বলেন, আমাদের বাড়ি চারবার ভেঙে গেছে। কোনো রকম আরেকটি বাড়ি করেছিলাম। এবার ভাঙনে সেটাই শেষ হয়ে গেছে। এখন আমরা যাবো কোথায় ভেবে পাচ্ছি না।
একই ইউনিয়নের বাসিন্দা সফিয়ার রহমান (৫০) বলেন, আমাদের আমবাগান, কাঁঠাল বাগান, বাঁশবাগান ছিল। এখন সব নদীতে। এর আগেও তিনবার বাড়ি নদীতে ভাঙে যায়। এবার বাড়ি ভেঙে গেলে থাকার জায়গা থাকবে না আর। পানি উন্নয়ন বোর্ড যদি জিও ব্যাগ ফেলত তাহলে এখানকার বাড়িগুলো রক্ষা পেতো।
এ বিষয়ে কুড়িগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আব্দুল্লাহ্ আল মামুন বলেন, রাজিবপুর উপজেলার কোদালকাটি, মোহনগঞ্জ এবং রৌমারী উপজেলার কত্তিমারী এলাকায় ব্যাপক ভাঙন শুরু হয়েছে। এমতাবস্থায় আপদকালীন সময়ের জন্য জিও ব্যাগ ফেলানো হচ্ছে। শুকনো মৌসুম এলে ভাঙনকবলিত এলাকায় স্থায়ী কাজের জন্য সমীক্ষা করা হবে।
কুড়িগ্রাম জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সাইদুল আরীফ বলেন, নদীভাঙা মানুষ, যারা একেবারে নিঃস্ব তাদের তালিকা তৈরি করে প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া আশ্রয়ণ প্রকল্পে বাসস্থানের ব্যবস্থা করা হচ্ছে এবং যেসব মানুষ আশ্রয় প্রকল্পে আসতে অনিচ্ছুক তাদেরকে আপদকালীন সময়ের জন্য ঢেউটিন এবং অর্থ দিয়ে সহযোগিতা করা হচ্ছে। এ ব্যাপারে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সর্বোচ্চ সহায়তা অব্যাহত থাকবে।
মন্তব্য করুন