

শীত মৌসুম আসতে না আসতেই মানিকগঞ্জের হরিরামপুরের বিভিন্ন অঞ্চলের গাছিরা খেঁজুরগাছ প্রস্তুত করতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। অনেকে আবার আগাম গাছ কেটে রস আহরণও শুরু করেছে। এ জেলার গুড়ের চাহিদা রয়েছে দেশব্যাপী। প্রসিদ্ধ লাভ করেছে বিশেষ প্রক্রিয়ায় তৈরি করা হাজারি গুড়।
‘লোকসংগীত আর হাজারি গুড়, মানিকগঞ্জের প্রাণের সুর’ এই প্রতিপাদ্য সামনে রেখেই ২০১৭ সালে মানিকগঞ্জে হাজারি গুড়কে ব্র্যান্ডিং করা হয়। ফলে প্রায় তিনশ বছরের ঐতিহ্য ঝিটকার হাজারি গুড়ের চাহিদা রয়েছে সমগ্র দেশজুড়ে। তাই শীতের আবির্ভাব ঘটতে না ঘটতেই মানুষ যেন মুখিয়ে থাকে হাজারি গুড়ের লোভনীয় স্বাদ আর গন্ধের অপেক্ষায়।
হেমন্তের শেষভাগে হরিরামপুরের বিভিন্ন অঞ্চলের গাছিরা রস আহরণের জন্যে খেঁজুরগাছ প্রস্তুতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। হাজারি গুড়ের পাশাপাশি তৈরি করা হয় লাল পাটালি, যা দেশের বিভিন্ন জেলায় রপ্তানি হয়।
জানা যায়, এ উপজেলা খেঁজুর গুড়ের জন্য বিখ্যাত বহুকাল আগে থেকেই। তবে প্রায় তিনশ বছর আগে উপজেলার বাল্লা ইউনিয়নের শিকদারপাড়া গ্রামে মোহাম্মদ হাজারি নামের জনৈক এক ব্যক্তির হাত দিয়েই বিশেষ প্রক্রিয়ায় প্রথম তৈরি হয় খেঁজুরের গুড়। স্বাদে গন্ধে আলাদা বিশেষত্ব থাকায় এক সময় সেই গুড়ের নাম ছড়িয়ে পড়ে এবং হাজারি গুড় নামেই তা পরিচিতি লাভ করে। এই গুড় আলাদাভাবে পরিচিতি লাভে ব্যবহার করা হয় ‘হাজারী’ নামের একটি সিলমোহর, যা বর্তমানে হাজারি গুড় নামে পরিচিত।
কালের বিবর্তনে বর্তমানে হাজারি পরিবারের উত্তরসূরিদের দু-একজন ব্যতীত আর কেউ এই গুড় তৈরি করেন না। তবে উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় যাচাই-বাছাইয়ের মাধ্যমে প্রায় ২৭ জন গাছি ‘হাজারী’ সিলমোহর ব্যবহার করে দেশের চাহিদা মেটাতে এই গুড় উৎপাদনের মধ্য দিয়ে টিকে আছে এই হাজারি গুড়ের ঐতিহ্য ও ইতিহাস।
২০২৩ সালের শেষ দিকে জেলা প্রশাসন থেকে এই শিকদারপাড়াকে হাজারি পল্লি হিসেবে ঘোষণা করা হয় এবং খেঁজুরগাছ সংকটের কারণে সরকারিভাবে এ উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় প্রায় ১০ লক্ষাধিক টাকার খেঁজুরগাছের চারাও রোপণ করা হয়।
সরেজমিনে গাছিদের সঙ্গে আলাপ করে জানা যায়, বর্তমানে খেঁজুরগাছ সংকটের কারণে অতীতের চেয়ে গুড় উৎপাদন অনেকটাই কম। আগে গ্রামাঞ্চলে প্রতিটি বাড়িতেই খেঁজুরগাছ দেখা যেত এবং অনেক বাড়িতেই গুড় তৈরি হতো। তখন দামও ছিল হাতের নাগালে। খেঁজুরগাছ সংকটে এখন গুড়ের উৎপাদন যেমন কম তেমনি দামের পরিমাণ অনেক বেশি। এক কেজি লাল গুড় বিক্রি হয় ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা কেজি। আর হাজারি বিক্রি হয় ১৫শ থেকে ২ হাজার টাকা কেজি।
ঝিটকা উজানপাড়া এলাকার করিম গাছি জানান, আমাদের এখানে আগে প্রতিটি বাড়িতে খেঁজুরগাছ ছিল। ফলে অনেক রস হতো গুড়ও বানানো যেত অনেক। কিন্তু বর্তমান খেঁজুরগাছ সংকট। আমরা উপজেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে বছর চুক্তিতে গাছ কিনে তারপর গুড় তৈরি করি। এতে গাছ কিনতে অনেক টাকা খরচ লাগে। আমার ৪ জন কামলা খাটে পুরো মৌসুমজুড়ে। স বমিলিয়ে খরচের পরিমাণ অনেক। এর ফলে দেখা গেছে, এক কেজি ফ্রেশ লাল গুড় প্রায় ১ হাজার টাকা এবং হাজারি গুড় ১৮শ থেকে ২ হাজার টাকা কেজি বিক্রি করতে হয়। তবে বাপ-দাদার ঐতিহ্য রক্ষায় এ পেশা রাখতে হয়। অনেকই বাদ দিয়েছে। এখন গাছির সংখ্যা খুবই কম।
একই গ্রামের রমজান গাছি জানান, এখন তো খেঁজুর গাছ খুবই কম। যাদের আছে তারা গুড় তৈরি করেন না। আমরা যারা গুড় বানাই ওই গাছ বছর চুক্তিতে কিনে রস আহরণ করি। প্রায় ৩০ বছর ধরে গুড় তৈরি করছি।
হাজারি পরিবারের এ প্রজন্মের উত্তরসূরি শফিকুল ইসলাম হাজারি শামীম জানান, এই হাজারি গুড় আমাদের প্রায় ৩০০ বছরের ইতিহাস এবং ঐতিহ্য বহন করছে। এই গুড়ের গুণগত মান রক্ষায় এবং ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখতে কিছু নিয়মাবলির মাধ্যমে মানুষের হাতে এই গুড় পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে। এই গুড়ের যে চাহিদা তাতে উৎপাদন খুবই সীমিত। তাই চাহিদা মেটাতে উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে আমাদের পরিবার থেকেই এলাকার বিভিন্ন গ্রামের গাছিদের যাচাই-বাছাইয়ের মাধ্যমে তাদের দিয়ে গুড় তৈরি করে চাহিদা পূরণের পাশাপাশি এই ঐতিহ্য এখন পর্যন্ত টিকিয়ে রাখা হয়েছে।
তবে শীত এলেই বাজারে ভেজাল গুড়েরও আমদানি হয়। প্রতি বছর ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযানেও রোধ হচ্ছে না ভেজাল গুড় তৈরি।
এ বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নাহিদা আক্তার জানান, ভেজাল গুড় রোধে আমরা বরাবরই অভিযান পরিচালনা করে থাকি। এ বছরও অভিযোগ পেলেই দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া হবে। আমাদের ফুড ইন্সপেক্টর আছেন। তিনি সবই সময়ই বাজার মনিটরিংয়ে থাকবেন। আমাদের অভিযানও চলমান থাকবে।
মন্তব্য করুন