সোমবার, ১৫ ডিসেম্বর ২০২৫, ৩০ অগ্রহায়ণ ১৪৩২
কিশোরগঞ্জ প্রতিনিধি
প্রকাশ : ১৪ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৮:২৪ পিএম
অনলাইন সংস্করণ

শান্তি মিশনে যাওয়ার আগে বাবাকে যা বলেছিলেন নিহত জাহাঙ্গীর

নিহত জাহাঙ্গীর আলম। ছবি : সংগৃহীত
নিহত জাহাঙ্গীর আলম। ছবি : সংগৃহীত

শান্তি প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন নিয়ে বিদেশের মাটিতে পাড়ি জমিয়েছিলেন তিনি। পরিবার, স্ত্রী ও তিন বছরের শিশুপুত্রকে রেখে গিয়েছিলেন জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনে। কিন্তু আর ফেরা হলো না। সুদানের আবেই এলাকায় সন্ত্রাসীদের ভয়াবহ হামলায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ছয়জন শান্তিরক্ষীর সঙ্গে শহীদের কাতারে যুক্ত হলেন কিশোরগঞ্জের সন্তান জাহাঙ্গীর আলম (৩০)।

শনিবার (১৩ ডিসেম্বর) আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর) এক খুদে বার্তায় জানায়, সুদানের আবেই এলাকায় জাতিসংঘের একটি ঘাঁটিতে সন্ত্রাসীরা অতর্কিত হামলা চালায়। এতে ছয়জন বাংলাদেশি শান্তিরক্ষী নিহত হন এবং অন্তত আটজন আহত হন। ঘটনার পর পুরো এলাকা চরম অস্থিতিশীল হয়ে পড়ে।

জানা যায়, নিহত জাহাঙ্গীর আলম কিশোরগঞ্জের পাকুন্দিয়া উপজেলার জাঙ্গালিয়া ইউনিয়নের তারাকান্দি গ্রামের আকন্দ বাড়ির হজরত আলীর ছেলে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে তিনি মেসওয়েটার পদে কর্মরত ছিলেন। প্রায় ১১ বছরের বেশি সময় ধরে নিষ্ঠা ও সুনামের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন তিনি।

গত ৭ নভেম্বর বুকভরা স্বপ্ন আর পরিবারের চোখের জল নিয়ে সুদানে যান জাহাঙ্গীর। উদ্দেশ্য একটাই-সন্তানকে ভালো ভবিষ্যৎ দেওয়া, অসুস্থ বাবা-মায়ের মুখে হাসি ফোটানো। কিন্তু এক মাস সাত দিন পার হতেই সব স্বপ্ন থেমে গেল রক্তাক্ত বাস্তবতায়। স্ত্রী রুবাইয়া আক্তার আর তিন বছরের একমাত্র সন্তান ইরফানকে রেখে চিরবিদায় নিলেন এই শান্তিরক্ষী।

বাবার আদর বোঝার আগেই পিতৃহারা হলো ছোট্ট ইরফান। বাবার ছবি, কণ্ঠ কিংবা স্পর্শ-সবই এখন স্মৃতি। ইরফান এখনো জানে না, ‘বাবা’ শব্দটি কেবল স্মৃতি হয়ে গেছে। বাবার কণ্ঠ, বাবার কাঁধ, বাবার হাত ধরে হাঁটার দিন-সবই হারিয়ে গেল এক রাতের হিংস্রতায়।

কান্নায় ভেঙে পড়েছে গ্রাম, শহীদের খবর পৌঁছাতেই তারাকান্দি গ্রাম যেন মুহূর্তেই স্তব্ধ হয়ে যায়। বাড়ির উঠোনজুড়ে আহাজারি, কান্না আর শোকের মাতম। প্রতিবেশীরা বলছেন, জাহাঙ্গীর ছিলেন শান্ত স্বভাবের, সবার বিপদে পাশে দাঁড়ানো একজন মানুষ। তিন ভাইয়ের মধ্যে তিনি ছিলেন মেঝো। বড় ভাই মো. মোস্তফা প্রবাসে, ছোট ভাই মো. শাহিন মিয়া কৃষিকাজ করেন।

ছোট ভাই শাহিন মিয়া কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ভাই আমাকে খুব আদর করত। কিছুদিন আগেও ফোন দিয়ে বলেছিল মা-বাবার দেখাশোনা করতে, জমির কাজগুলো করতে-দেশে এসে সব টাকা-পয়সার ব্যবস্থা করবে। তারপর আমার ফোন নষ্ট হয়ে যায়, আর কথা হয়নি। শেষ কথা বলাটাও কপালে ছিল না। প্রত্যেক ঈদে ভাই আমাকে নতুন কাপড় কিনে দিতেন। কী পরিমাণ আদর করতেন তা আমি বলে বোঝাতে পারব না। ইরফানকে রেখে ভাই চলে গেছে। কী হবে? কিছুই বুঝে উঠতে পারছি না।

চাচাতো ভাই হানিফ মিয়া জানান, হামলার খবর পাওয়ার পর নিহতের সঙ্গে থাকা এক সেনাসদস্যের মাধ্যমে জাহাঙ্গীর আলমের মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া যায়। তিনি বলেন, জাহাঙ্গীর ছিলেন শান্ত ও দায়িত্ববান মানুষ। পরিবারের প্রতিটি বিষয়ে পরামর্শ করতেন। শান্তি প্রতিষ্ঠার পথে জাহাঙ্গীর আলমের মতো আত্মত্যাগ জাতির ইতিহাসে বেদনা আর গর্ব-দুটিই হয়ে থাকবে। শান্তির জন্য জীবন দেওয়া এই শহীদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করছেন এলাকাবাসী। একই সঙ্গে তার অসহায় পরিবার-বিশেষ করে ছোট্ট ইরফানের পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।

নিহতের বাবা হজরত আলী ও মা পালিমা বেগম সন্তানের মৃত্যুতে ভেঙে পড়েছেন। নিহতের বাবা হযরত আলী কাঁদতে কাঁদতে বলেন, আমার ছেলে যাওয়ার সময় বলেছিল আমাকে দেখে রাখতে। বলেছিল দেশে এসে টাকা দেবে, কাজ কম করতে। এখন সে নিজেই নেই-আমি কাকে নিয়ে বাঁচব? আমার পরিবারের সব খরচ আমার ছেলে দিতো। তার দেওয়া টাকায় সংসারের খরচ আমার এবং তার মায়ের চিকিৎসার খরচ সবকিছু চলে যেত। এখন আমাদের কী হবে?

মা পালিমা বেগমের কান্না যেন ভাষাহীন। কাঁদতে কাঁদতে শুকিয়ে গেছে চোখের পানি শত চেষ্টা করেও আর চোখ দিয়ে পানি ঝরছেনা রকমের। কাঁদতে কাঁদতে তিনি বলেন, আমার বাবাকে এনে দেন। সে আমার ঘরের আলো ছিল। এত সুন্দর ছেলে-ওর মতো আর কেউ না। আমার একটা নাতী। ৩ বছরের ইরফানকে কে দেখবে? কাকে সে বাবা বলে ডাকবে? কী বলে সান্ত্বনা দিব তাকে! আমি আমার ছেলেকে চাই।

স্ত্রী রুবাইয়া আক্তার বারবার মূর্ছা যাচ্ছেন। কাঁদতে কাঁদতে বলছেন, আমার স্বামী ছবি তুলতে নিষেধ করেছিল। বলেছিল এতে আজাব হবে। আমি এখন কী নিয়ে বাঁচব?

হোসেন্দী ইউনিয়ন পরিষদের প্যানেল চেয়ারম্যান ও নিহতের ফুফাতো ভাই মো. সুরুজ মিয়া মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, শান্তি প্রতিষ্ঠায় দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে জাহাঙ্গীর আলমের আত্মত্যাগ জাতির জন্য গর্বের হলেও পরিবারের জন্য অপূরণীয় ক্ষতি। সরকারের কাছে সন্তানের ভবিষ্যৎ ও এই পরিবারের জন্য সহযোগিতার চাচ্ছি।

পাকুন্দিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) রুপম দাস বলেন, ঘটনার খবর পাওয়ার পরপরই আমরা পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। সরকারিভাবে সব ধরনের সহযোগিতা নিশ্চিত করা হবে। শুধু সান্ত্বনাতে তো আর মন ভরে না। আমরা পাশে আছি।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

‘গণতান্ত্রিক উত্তরণের লড়াই বারবার হোঁচট খাচ্ছে’  

দেশের ক্রান্তিকাল কাটাতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ফেরার আহ্বান সালামের

এলাকার উন্নয়নে ঐক্যের আহ্বান হাবিবুর রশিদ হাবিবের

তারেক রহমানের প্রত্যাবর্তনে সকল অপশক্তি পরাস্ত হবে : ইশরাক

পেশাজীবীদের সর্বাত্মক সহযোগিতো চাইলেন তারেক রহমান

দাপুটে জয়ে সিরিজে ২–১ ব্যবধানে এগিয়ে গেল ভারত

‌‘আমাকে শোরুমে নিয়ে যান, সব সত্য বেরিয়ে আসবে’

ওসমান হাদিকে গুলি : সন্দেহভাজন ফয়সলের স্ত্রীসহ আটক ৩

ইসলামিক রিয়ালিটি শো ‘পুষ্টি ভার্সেস অফ লাইট- সিজন ২’ এর আনুষ্ঠানিক ঘোষণা 

লন্ডনে তারেক রহমানের জনসভা ১৬ ডিসেম্বর

১০

আইপিএলের মক নিলামে ৭৫ লাখ রুপিতে দল পেলেন তানজিম সাকিব

১১

রোগী দেখার সময় চিকিৎসকের গেম খেলা, তদন্তে হাসপাতালে দুদক

১২

চাঁদপুরে ২ জনের মরদেহ উদ্ধার

১৩

সেন্টমার্টিন যাত্রায় সক্রিয় জালিয়াতি চক্র, টিকিট যেন সোনার হরিণ

১৪

শান্তিরক্ষী মিশনে সুদানে ড্রোন হামলায় আহত ঘিওরের চুমকি

১৫

ছাত্ররাই হানাদার-স্বৈরাচারের হাত থেকে দেশকে মুক্ত করেছে : হান্নান মাসউদ

১৬

চট্টগ্রামে ছয় প্রতিষ্ঠানকে জরিমানা, বেকারি বন্ধ

১৭

নবনির্মিত নতুন ভবনে সিএমপি কমিশনার, উদ্বোধন

১৮

বিএনপিই একমাত্র দেশে গণতান্ত্রিক পরিবেশ ফেরাতে পারে : অমিত

১৯

ট্রেন থেকে পড়ে অজ্ঞাত ব্যক্তি নিহত

২০
X