রেজাউল করিম, গোয়ালন্দ (রাজবাড়ী) প্রতিনিধি
প্রকাশ : ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০২:৪৪ পিএম
অনলাইন সংস্করণ

দুর্গম চর বেতকায় নেই ন্যূনতম নিরাপত্তা

ইঞ্জিনচালিত ট্রলারে তিন ঘণ্টারও বেশি সময় পর যেতে হয় বেতকা-রাখালগাছি চরে। ছবি : কালবেলা
ইঞ্জিনচালিত ট্রলারে তিন ঘণ্টারও বেশি সময় পর যেতে হয় বেতকা-রাখালগাছি চরে। ছবি : কালবেলা

‘ম্যায়াডা ৯ মাসের পোয়াতি। এটা দিনের জন্যিও ডাক্তার দেহাইবার পারি নাই। তয় আল্লাহ এহন পর্যন্ত ভালোই নাগছে। পোলাপান হওনেরকালে কী অইবো তা আল্লাই জানে। এই চরে একটা ডাক্তার নাই। ওর আব্বায় বাড়ি থাহে না। গাঙে জাল বায়। এটা কিছু (প্রসবকালীন সমস্যা) অইলে আল্লারে ডাহন ছাড়া কিছুই করতে পারুম না। হাসপাতাল তো হেই মেলা দূর, নিবার গেলে দুই-তিন ঘণ্টা লাগে। নাও না পাইলে নিওন যায় না।’

কথাগুলো কালবেলাকে বলছিলেন গোয়ালন্দ উপজেলার দেবগ্রাম ইউনিয়নের বাসিন্দা বেতকা চরের মমেনা বেগম। তাদের টিনের ঘরের সামনে বসে কথা হচ্ছিল তার সঙ্গে।

বেতকা চরের বাসিন্দা মমেনা বেগম জানান, কিছু দিন আগে তার বোনের মেয়ে হনুফার বাচ্চা হওয়ার সময় অনেক কষ্ট হয়েছিল। তাকে হাসপাতালে নেওয়ার সময় তিনি মারা যান। রাজবাড়ীর গোয়ালন্দ উপজেলার দেবগ্রাম ইউনিয়নের মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন চর বেতকা-রাখালগাছি। প্রায় দুই থেকে আড়াই ঘণ্টা পদ্মায় ইঞ্জিনচালিত ট্রলারে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পৌঁছাতে হয়। এই চরে অন্তত ছয় হাজার মানুষের বসবাস। এসব মানুষের জীবনে নেই কোনো মৌলিক অধিকার। তারা বঞ্চিত শিক্ষা, চিকিৎসা ও জীবনের নিরাপত্তা থেকে। চরবাসীর প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবায় নেই কোনো কমিউনিটি ক্লিনিক, নিরাপত্তার জন্য নেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর স্বাভাবিক পদচারণা। একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় থাকলেও মাধ্যমিকে পড়াশোনার সুযোগ নেই। বরং প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যেসব শিক্ষক কর্মরত, তাদের যাতায়াত ও কর্মস্থলে যথাযথ পাঠদান অনেকটাই কঠিন। সঙ্গে রয়েছে নিরাপত্তাহীনতা।

ডাকাতের উৎপাত

চলতি মাসের ৬ তারিখ দৌলতদিয়া ফেরিঘাট থকে ইঞ্জিনচালিত ট্রলারে রওনা হয়ে তিন ঘণ্টারও বেশি সময় পর বেতকা-রাখালগাছি চরে গিয়ে দেখা যায়, কৃষিকাজ ও মাছ ধরাই এখানকার মানুষের পেশা। যোগাযোগ ব্যবস্থা না থাকায় ফসলের ন্যায্য দাম থেকে বঞ্চিত হন তারা। এ ছাড়া চরের মানুষ গবাদি পশু পালন করে থাকেন। কিন্তু এ গবাদি পশু বিক্রিযোগ্য হলে ডাকাতদের কবল থেকে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই রক্ষা করতে পারেন না তারা। যদিও ডাকতদের প্রতিহত করতে তাদের ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা থাকে সব সময়। এভাবেই ঝড়বৃষ্টি, বন্যা, চোর-ডাকাত ও নদীর সঙ্গে যুদ্ধ করেই চলছে তাদের জীবন ও জীবিকা।

স্থানীয় ফুলজান বিবি জানান, অনেক কষ্ট করে চারটা গরু পালন করেছিলেন। কিছুদিন আগে গরুগুলো বিক্রিযোগ্য হওয়ার পর সন্ধ্যারাতে ডাকাতরা চারটি গরুই লুট করে নিয়ে গেছে। চরবাসীর নিরাপত্তায় একটি পুলিশ ক্যাম্প করে দিলে তারা ডাকাতদের হাত থেকে রেহাই পেতেন।

নেই মাধ্যমিক স্কুল

স্থানীয় চর বেতকা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী রেশমা খাতুন জানায়, এ বছরের পর তার আর লেখাপড়া করা হবে না। কারণ এই চরে প্রাথমিক শেষ করে মাধ্যমিকে ভর্তি হওয়ার মতো কোনো স্কুল নেই। পড়তে চাইলে রাজবাড়ী অথবা পাবনার কোনো স্কুলে ভর্তি হতে হবে। সেটা কোনোভাবেই সম্ভব হবে না। তাই বাবা-মা চেষ্টা করলেও এখানেই তার পড়াশোনা শেষ হয়ে যাবে।

চতুর্থ শ্রেণির অপর শিক্ষার্থী জুঁই খাতুন। সে বড় হয়ে কী হতে চায়, জানতে চাইলেই দ্রুত বলে ফেলে, সে ইঞ্জিনিয়ার হতে চায়। এ স্কুল শেষ করে সে কীভাবে লেখাপাড়া করবে, প্রশ্ন করলেই আর কোনো উত্তর খুঁজে না পেয়ে চুপ হয়ে যায় সে।

স্থানীয় আব্দুল গফুর সরদার জানান, তারা নানা রকমের সমস্যার মুখোমুখি হয়েই এখানে বসবাস করছেন। বিভিন্ন সময় এখানে বড় বড় জনপ্রতিনিধি ও সরকারি অফিসাররা আসেন। তারা বিভিন্ন আশ্বাসও দিয়ে যান; কিন্তু কোনোটাই বাস্তবায়ন হয় না। তিনি এই চরের মানুষের দুঃখ-দুর্দশার কথা বিবেচনা করে সরকারের কাছে একটি হাসপাতাল ও একটি পুলিশ ক্যাম্প স্থাপনের দাবি জানান।

চর বেতকা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ইদ্রিস মোল্লা জানান, যাতায়াত ব্যবস্থাই এই চরের প্রধান সমস্যা। যাতায়াত ব্যবস্থা সহজ করা গেলে এখানকার হাজার হাজার মানুষের সব রকম নাগরিক সুবিধা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। দুর্গম হওয়ার কারণে এর আগে এই চরে পুলিশ পর্যন্ত সন্ত্রাসীদের হামলার শিকার হয়েছে।

তিনি আরও জানান, তাদের বিদ্যালয়ে অনেক মেধাবী শিক্ষার্থী রয়েছে। কিন্তু তাদের প্রবল ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও প্রাথমিকের গণ্ডি পেরিয়ে ঝরে পড়তে হয়। কারণ এ চরে কোনো মাধ্যমিক স্কুল নেই।

তিনি বলেন, ‘আমরা সব শিক্ষকই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে উত্তাল পদ্মা পাড়ি দিয়ে স্কুলে আসি। এতে একদিকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় লাগে, সঙ্গে অতিরিক্ত অর্থ খরচ হয়।’

গোয়ালন্দ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মোস্তফা মুন্সি জানান, বেতকা-রাখালগাছি চরের সঙ্গে পার্শ্ববর্তী জেলা পাবনার সঙ্গে সড়ক পথে যোগাযোগ স্থাপনের কাজ চলছে। কাজ শেষ হলে চরবাসী এর সুফল পাবেন।

দুর্গম এই চরে একটি পুলিশ ক্যাম্প স্থাপনের ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ চালিয়ে যাচ্ছেন জানিয়ে তিনি বলেন, এ ছাড়া জেলা প্রশাসকের কাছে একটি কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপনের আবেদন করেছেন।

গোয়ালন্দের ইউএনও জাকির হোসেন জানান, এ চরে একটি আশ্রয়ণ প্রকল্প করা হয়েছে। গোয়ালন্দ উপজেলায় কমিউনিটি ক্লিনিকের বরাদ্দ পেলে, এ চরে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে স্থাপন করা হবে। এ ছাড়া ব্যক্তি উদ্যোগে যদি কেউ মাধ্যমিক বিদ্যালয় পরিচালনা করতে আগ্রহী হন, তবে তাকে সার্বিক সহযোগিতা করা হবে।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

শেখ হাসিনার বিষয়ে দুই দেশকে কী করতে হবে, জানালেন বিক্রম মিশ্রি

দাফনের ১৯ দিন পর স্কুলছাত্রীর লাশ উত্তোলন

ভালোবাসার শিখরে থেকেই বিদায় নিতে চান তাহসান

ছাত্রদলে যোগ দিলেন বৈষম্যবিরোধীর পাঁচ শতাধিক শিক্ষার্থী

বিচ্ছেদের পথে থাকে যেসব ছোট ছোট কারণ

দেশের জন্য উৎসর্গ প্রাণ, বাবার দেখা হলো না সন্তানের মুখ

সব দল একমত হলে পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন হওয়া সম্ভব : গোলাম পরওয়ার

ডা. আজিজুর রহমান মারা গেছেন

নির্বাচনী জোটে যাওয়া নিয়ে সিদ্ধান্ত জানাল বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস

তারেক রহমানের বক্তব্যের প্রশংসায় শিশির মনির

১০

বিসিবি নির্বাচন / ভোট গণনার সময় যে বার্তা দিলেন তামিম

১১

ব্রহ্মপুত্র নদে ভেসে আসছে হাজার হাজার গাছের গুঁড়ি

১২

গবেষণা / ঘুম না হলে সহজ ব্যায়ামে মিলতে পারে সমাধান

১৩

ইউপি সদস্যকে কুপিয়ে হত্যা

১৪

বিসিবি নির্বাচনের ভোটগ্রহণ শেষ, চলছে গণনা

১৫

স্রোতের মধ্যে জীবন বাজি রেখে বাঁধ রক্ষা, মহাবিপর্যয় এড়াল বিজিবি

১৬

রাজধানীর কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ

১৭

১ কোটি ৩০ লাখ টাকা নিয়ে উধাও ব্যাংকের ম্যানেজার

১৮

কেন দীপিকাকে দেখেই বদলে গেল রণবীরের মুখ

১৯

ইসির ৫০ প্রতীকেও ‘না’, ‘শাপলায়’ অনড় এনসিপি

২০
X