মঙ্গলবার, ২১ মে ২০২৪, ৭ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১
মো. আবুল হাসেম, মাটিরাঙ্গা (খাগড়াছড়ি) প্রতিনিধি
প্রকাশ : ০৯ নভেম্বর ২০২৩, ১১:৪৩ এএম
অনলাইন সংস্করণ

পাহাড়ের তরুণ ইব্রাহিমের মাসিক আয় ২ হাজার ডলার

খাগড়াছড়ির মাটিরাঙ্গার চৌধুরিপাড়ার তরুণ ফ্রিলান্সার ইব্রাহিম খলিল। ছবি : কালবেলা
খাগড়াছড়ির মাটিরাঙ্গার চৌধুরিপাড়ার তরুণ ফ্রিলান্সার ইব্রাহিম খলিল। ছবি : কালবেলা

অধ্যাবসায় শব্দটি অন্য কারও কাছে সত্য হোক বা না হোক, কিন্তু তা ফ্রিল্যান্সার ইব্রাহিমের ক্ষেত্রে সত্য বলে প্রতীয়মান হয়েছে। কেননা বারবার ধাক্কা খেয়ে পুনরায় লেগে থাকা, পরিবারের অর্থনৈতিক দুরবস্থা, এতসব প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে শুধু ফ্রিল্যান্সিংকে পেশা ও নেশা হিসেবে গ্রহণ করে সফল হওয়া এক স্বপ্নবাজ তরুণ মো. ইব্রাহিম খলিল। আজ পাহাড়ে যিনি একজন সফল ও পেশাদার ফ্রিল্যান্সার হিসেবে পরিচিতি। তবে এই সফলতা অর্জন সহজ ছিল না। বরং ছিল বাধা ও চ্যালেঞ্জে ভরপুর।

খাগড়াছড়ির মাটিরাঙ্গা উপজেলায় জন্মগ্রহণ করেন তিনি। সেখানেই তার বেড়ে ওঠা। তার নেশা-পেশা যেন প্রযুক্তি নিয়েই। প্রযুক্তির প্রতি তার আগ্রহ দিন দিন বাড়তেই থাকে। তাই বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে পড়াশোনার পাশাপাশি মাত্র ১৮ বছর বয়সে ফ্রিল্যান্সিং ক্যারিয়ার শুরু করেন ইব্রাহিম।

ফ্রিল্যান্সিং ক্যারিয়ার শুরু করতে একটি কম্পিউটার বা ল্যাপটপ লাগবে। কিন্তু তার এই আবদার পূরণ করা পরিবারের কাছে অমাবস্যার চাঁদের মতো। তারা বাবা ছিল ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী। তিন ভাইবোনের মধ্যে সে ছিল সবার বড়। যেখানে দু-বেলা খাবার জোগাড় করতে পরিবারকে রীতিমতো সংগ্রাম করতে হচ্ছে সেখানে ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকা দিয়ে তাকে কম্পিউটার কিনে দেওয়া, এমন সাধ্য পরিবারের পক্ষে সম্ভব ছিল না। ইব্রাহিম নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। পরিবারে বাবাই একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। তার জন্মের পর থেকেই অভাব অনটনে দিনাতিপাত করতে থাকে তাদের পরিবার। ছোট্ট একটি ব্যবসার ওপর ভর করে কোনোরকম চলছিল তাদের সংসার। পরিবারের এই সংগ্রামের মধ্যেই ইব্রাহিম বড় কিছু হওয়ার স্বপ্ন দেখেছেন। ছোট থেকেই পড়াশোনায় ভালো ছিলেন। বন্ধুদের কাছ থেকে ১৫ হাজার টাকা ধার করে বাকি ২০ হাজার টাকা নিজের চাচার কাছ থেকে নিয়ে প্রথমে ৩৫ হাজার টাকা দিয়ে বহু কাঙ্ক্ষিত ল্যাপটপ কিনেন তিনি। মধ্যবিত্ত পরিবারের বাবা বুজতেই চাইতেন না অনলাইনে আয় করার বিষয়টা। ইব্রাহিমের মায়ের অনুপ্রেরণায় তখন থেকেই চলছে অবিরাম অধ্যবসায়।

বলছিলাম, খাগড়াছড়ির মাটিরাঙ্গার চৌধুরিপাড়ার ইব্রাহিম খলিলের কথা। নানা চড়াই উতরাই পেরিয়ে বর্তমানে তিনি একজন সফল ফ্রিল্যান্সার। মাসে আয় করেন দুই হাজার ডলার। তিনি এখন সরকার স্বীকৃত ফ্রিল্যান্সার। শিক্ষাজীবনে চট্টগ্রাম কমার্স কলেজ থেকে ম্যানেজমেন্টে মাস্টার্স করছেন তিনি।

শুরুটা হয়েছিল ২০১৬ সালে। তরুণ তরুণীদের আউটসোর্সিং বিষয়ে সক্ষমতা বৃদ্ধি করে মানবসম্পদ উন্নয়নের লক্ষ্যে আইসিটি বিভাগের আওতায় লার্নিং অ্যান্ড আর্নিং ডেভেলপমেন্ট প্রকল্পের আওতায় প্রফেশনাল আউটসোর্সিং ট্রেনিং প্রদানের উদ্যোগ গ্রহণ করে সরকার। তখন তিনি আবেদন করে ১০০ জন প্রতিযোগীর মধ্যে জেলার মধ্যে দ্বিতীয় হন তিনি। শুরু করেন প্রশিক্ষণ গ্রহণ। নিজ উপজেলা থেকে খাগড়াছড়ি সদরে গিয়ে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন ইব্রাহিম। প্রশিক্ষণ শেষে অর্ডার না পাওয়ায় প্রায় দেড় বছর বন্ধ ছিল কাজ। চলছে সফল হবার ক্রমাগত চেষ্টা।

ইব্রাহিম বলেন, ২০১৮ সালের শুরুর দিকে এই প্রথম ৫ ডলারের একটি লোগে তৈরির কাজ পাই। একই বছরের জুনের শেষের দিকে ৫০ ডলারের আরেকটি কাজ পাই। এরপর ২০১৯ সালে একটার পর একটা অর্ডার পেতে থাকি। এ বছরে গড়ে মাসে প্রায় ৫০ হাজার টাকার মতো অর্ডার পেতাম। ২০২০ সালে করোনা মহামারির সময় আয় বেড়ে ৭০ হাজারের অধিক হয়। চলছে সফলতার মধ্যে হতাশা। এরপর কর্তৃপক্ষের শর্ত ভায়োলেট করার কারণে আমার আইডিটা নষ্ট হয়ে যায়। তাতে হতাশ না হয়ে নতুন করে আরও দুটি আইডি খুলি। একই বছরে আবার কাজ পাওয়া শুরু করি। তখন মাসে আয় নেমে ৪০ হাজার টাকা মিলত। মহামারির একই বছরে ঘরে বসে আমার প্রায় ৮০ হাজার টাকা আয় হতো।

‘২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে বর্তমান পর্যন্ত আমার অর্ডার বেড়ে ১ লাখ টাকা হয়। এবার নতুন পরিকল্পনা করি উদ্যোক্তা হবো। শুরু করি গ্রাফিক্স ডিজাইন ফ্রিল্যান্সিং অনলাইন কোর্স। দেশে এবং দেশের বাইরে থেকে প্রতি ব্যাচে ৩০ থেকে ৫০ জন ছাত্রসহ বর্তমানে ৮টি ব্যাচ চলমান রয়েছে। সব মিলিয়ে প্রায় ৪০০ জনকে ফ্রিল্যান্সিং প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। এদের মধ্যে থেকে ৮০ জনের অধিক শিক্ষার্থী অর্ডার পাচ্ছেন। তিনি ফ্রিল্যান্সিং ও আইটি সেক্টরকে আরও উন্নত ও প্রসার করতে মাটিরাঙ্গায় খলিল কম্পিউটার ট্রেনিং সেন্টার চালু করেন যেখানে প্রতিদিন ৫টি ব্যাচে বিভিন্ন বিষয়ে প্রশিক্ষণ প্রদান করা হবে।’ এই ট্রেনিং সেন্টারটি খাগড়াছড়ি জেলার সকল উপজেলায় এর ব্যাপ্তি হবে বলে জানান ইব্রাহিম। শুরুতে ডাচ বাংলা মোবাইল বাংকের খাগড়াছড়ি শাখার ডিস্ট্রিবিউশন ম্যানেজার ছিলেন ইব্রাহিম। বর্তমানে ডাচ বাংলা ব্যাংকের এজেন্ট ব্যাংকিং মাটিরাঙ্গা শাখার প্রোপ্রাইটর। তা ছাড়া সে এর আগে বিতর্ক প্রতিযোগিতায় জেলার মধ্যে শ্রেষ্ঠ বিতার্কিক হওয়ার গৌরব অর্জন করেন। মাটিরাঙ্গা উপজেলার বিতর্ক ক্লাবের প্রশিক্ষক ছিলেন তিনি। এদিকে ইব্রাহিম চলতি বছরের জুলাই মাসে ঢাকায় ন্যাশনাল ইয়ুথ ক্যারিয়ার কার্নিভাল-২০২৩ এ রাইজিং ইয়ুথ অ্যাওয়ার্ড-২০২৩ প্রাপ্ত হন। ৮ এপ্রিল পাবর্ত্য চট্টগ্রাম নাগরিক পরিষদ কর্তৃক সফল ফ্রিল্যান্সার ও আইটি এক্সপার্ট সম্মাননা স্মারক অর্জন করেন। এ বছরের ৩ সেপ্টেম্বর খাগড়াছড়ি জেলা প্রশাসক কর্তৃক জেলা পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ ফ্রিল্যান্সার মনোনিত হন। একই সাথে উপজেলার সকল ফ্রিল্যান্সারদের অংশগ্রহণে অত্র এলাকার হতদরিদ্রদের মাঝে মাসে একবার একবেলা উন্নত মানের খাবারের ব্যবস্থা করেন।

তিনি বলেন, আমার স্বপ্ন খাগড়াছড়িতে মি. ফ্রিলান্সার আইটি অফিস চালু করা। এতে করে এ অঞ্চলের বেকারদের কর্মসংস্থান হবে একই সঙ্গে যারা আমার এখান থেকে কাজ শিখছে তারাও এতে কাজ করার সুযোগ পাবে। কার্যক্রমটি অনলাইনে চালু থাকলেও সরাসরি উদ্বোধনের পর এটি হাতে কলমে চালু হবে বলে তিনি জানান।

এদিকে মাটিরাঙ্গা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ডেজী চক্রবর্তী মাটিরাঙ্গার ফ্রিল্যান্সারদের উদ্বুদ্ধ করতে সকল ধরনের সহযোগিতার আশ্বাস দেন এবং অত্র উপজেলোর সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ফ্রিল্যান্সার রিলেটেড সেমিনার করবেন বলে তিনি জানান। তা ছাড়া মাটিরাঙ্গা সহকারী প্রোগ্রামার রাজিব রায় চৌধুরী উপজেলার সকল ফ্রিল্যান্সারদের একটি ডাটা সংযুক্ত করেন যেখানে তারা সরকারি সকল সুযোগ-সুবিধা পেতে পারেন। খাগড়াছড়ি সহকারী প্রোগ্রামার সলিল চাকমা ইতোমধ্যে সকল ফ্রিল্যান্সারদের নিয়ে কাজ শুরু করছেন।

ফ্রিল্যান্সিংয়ে তরুণদের সম্ভাবনার কথা জানিয়ে মাটিরাঙ্গা সরকারি ডিগ্রি কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রভাষক মো. আব্দুল হামিদ বলেন, এ প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা পড়াশোনার পাশাপাশি কিছু করতে চাইলে ফ্রিল্যান্সিংয়ের সুবিধা নেওয়া উচিত। প্রতিদিন ৮-১০ ঘণ্টা ফ্রিল্যান্সিংয়ে কাজ করতে পারলে বেকারত্ব ঘোচানো সম্ভব।

উপার্জনের পদ্ধতি সম্পর্কে ইব্রাহিম বলেন, ফ্রিল্যান্সিংয়ে ঢুকেই হাজার হাজার ডলার আয় হয়, এমন স্বপ্ন দেখা বন্ধ করতে হবে। কারণ ব্যবসায় ঢুকে কখনই কেউ একবারে বিরাট কিছু করতে পারে না। এটাও ঠিক একই রকম। তাই সময় নিয়ে কাজ করতে হবে। তাহলে আস্তে আস্তে আয় বাড়বে। কেননা একটা কথা মাথায় রাখতে হবে- ফ্রিলান্সিং করে কেউ রাতারাতি বড়লোক হয় না।

দক্ষ মানবসম্পদ তৈরির মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের মধ্য দিয়ে দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখতে নিজের প্রত্যয় ব্যক্ত করে এই উদীয়মান ফ্রিল্যান্সার ইব্রাহিম বলেন, বর্তমানে চাকরি পাওয়া খুবই কঠিন। হাজার হাজার বেকার ঘুরে বেড়াচ্ছেন, অথচ অনলাইনে প্রচুর কাজ। এখান থেকে প্রতি মাসে লাখ টাকা আয় করা সম্ভব। তাই চাকরির পেছনে না ঘুরে সঠিক পথে পরিশ্রম করে কাজ করে স্বাবলম্বী হওয়া যায়।

তিনি আরও বলেন, ভাষাগত দক্ষতার পাশাপাশি প্রযুক্তিগত দক্ষতার জন্য ফ্রিল্যান্সারদের দেশের যে কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে ন্যূনতম ডিগ্রি পাস থাকা উচিত। এতে ফ্রিল্যান্সিং জগতের দক্ষতা সহজ হবে এবং কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে সফল হওয়া সম্ভব হবে।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

বাবার খোঁজে ভারতে যাচ্ছেন এমপি আনারের মেয়ে

ফোর্বসের তালিকায় স্থান পাওয়া ৯ তরুণকে ছাত্রলীগের শুভেচ্ছা

মোবাইল কিনে না দেওয়ায় শিক্ষার্থীর আত্মহত্যা

উন্মুক্ত লাইব্রেরিতে বসে লাখ টাকার অবৈধ বিদ্যুৎ ব্যবসা

র‍্যাব হেফাজতে নারীর মৃত্যু, ক্যাম্প কমান্ডারসহ প্রত্যাহার ৪

চলতি অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি হবে ৫.৮২ শতাংশ : বিবিএস

ট্রাকের ধাক্কায় প্রাণ গেল শিশুর

জাল স্বাক্ষরে ওষুধ বিতরণের অভিযোগ

ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে আরবদের মুনাফেকি ও সুপার হিরোদের অবদান

নোয়াখালীতে ৩০ কেজি হরিণের মাংস জব্দ

১০

নিপুনের পেছনে বড় কোনো শক্তি আছে : ডিপজল

১১

ফিলিস্তিনের পক্ষে সংহতি জানিয়ে চবিতে সাইক্লিস্টের র‍্যালি

১২

রাষ্ট্রপতির সঙ্গে আইআইইউসি প্রতিনিধিদলের সৌজন্য সাক্ষাৎ

১৩

আ.লীগ নেতার বিরুদ্ধে আপত্তিকর ভিডিও ছড়ানোর অভিযোগ

১৪

রাইসির মরদেহ কোথায়, জানাজার বিষয়ে কী সিদ্ধান্ত?

১৫

রাইসিকে বহনকারী হেলিকপ্টারটি ৫০ বছরের পুরোনো

১৬

মসজিদে ঢুকে ইমামকে যুবদল নেতার বেধড়ক মারধর

১৭

রাইসির হেলিকপ্টার বিধ্বস্তের পরও বেঁচে ছিলেন এক আরোহী

১৮

ছেলের আত্মহত্যায় মায়ের বিষপান

১৯

অপু বিশ্বাসের অভিযোগে ৩ জনকে সতর্ক করল পুলিশ

২০
X