আতাউর রহমান, ব্রাহ্মণপাড়া (কুমিল্লা) প্রতিনিধি
প্রকাশ : ২৭ ডিসেম্বর ২০২৩, ১১:২০ এএম
অনলাইন সংস্করণ

অনুকূল পরিবেশের অভাবে নিভে যাচ্ছে জোনাকির আলো

সবুজ পাতার ফাঁকে জোনাকি পোকা। ছবি : কালবেলা
সবুজ পাতার ফাঁকে জোনাকি পোকা। ছবি : কালবেলা

এক সময় সন্ধ্যা হলেই কুমিল্লার ব্রাহ্মণপাড়ার জনপদের ঝোঁপঝাড়ে দেখা যেত শরীরে পিদিম জ্বালিয়ে মিটমিট করে জ্বলা জোনাকি পোকার ওড়াউড়ির দৃশ্য। সময়ের পরিক্রমায় বনানী স্বল্পতা ও আধুনিকতার বদৌলতে পাওয়া আলোক দূষণের ফলে অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে জোনাকি পোকা। এখন আর আগের মতো এই জনপদে দেখা মেলে না আর রাতের শরীরজুড়ে মিটমিট করে জ্বলা তারার মতো জোনাকি পোকার মনোমুগ্ধকর দৃশ্য। সচেতন মহলের দাবি ভবিষ্যৎ প্রজন্ম যেন জোনাকি পোকা দেখতে পায় সে লক্ষ্যে পরিবেশবান্ধব জোনাকি পোকা সংরক্ষণ করা হোক।

বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম ও অন্যান্য মাধ্যম থেকে জানা গেছে, জোনাকি হলো ল্যামপিরিড পতঙ্গ পরিবারের একটি গোবরে পোকা, বর্গ হলো কলিওপ্টেরা। বাংলায় এর নাম তমোমণি। এরা মূলত পাখাওয়ালা গোবরে পোকা, যাদের সাধারণভাবে জোনাকি পোকা বলা হয়। কারণ তারা জৈব রাসায়নিক ব্যবস্থায় নিজের শরীর থেকে আলো উৎপন্ন করে। এরা এই আলো যৌন মিলন ঘটানোর কাজে বা শিকারের উদ্দেশ্যে জ্বেলে থাকে। এরা কোল্ড লাইট বা নীলাভ আলো উৎপন্ন করে কোন আল্ট্রাভায়োলেট বা ইনফ্রারেড তরঙ্গ ছাড়াই। এ আলোর রং হলুদ, সবুজ বা ফিকে লাল হতে পারে। আলোর তরঙ্গ দৈর্ঘ্য হলো ৫১০ থেকে ৬৭০ ন্যানোমিটার। ভেজা কাঠ, ঝোঁপঝাড়, ডোবায় জোনাক পোকা বংশবিস্তার করে থাকে।

আরও জানা গেছে, প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষা করে থাকে জোনাকি পোকা। বিভিন্ন প্রাণী যেমন সাপ ও ব্যাঙের খাবার জোনাকি পোকা ও এদের লার্ভা। যা বাস্তুতন্ত্রে প্রভাব রাখে।

চাইনিজ একাডেমি অব সায়েন্সের বন্যপ্রাণী গবেষক নাসির উদ্দিন বলেন, জোনাকি পোকা ফুলের পরাগ এবং মধু খায় এতে এক ফুলের পরাগ অন্য ফুলে দিয়ে পরাগায়নে সহায়তা করে থাকে। যা কৃষকের খাদ্যশস্য ফলাতে সহায়তা করে। তিনি বলেন, একটি এলাকায় জোনাকির উপস্থিতি ওই এলাকার পানির গুণাগুণ সম্পর্কে ধারণা দেয়। যদি পানিতে ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ থাকে তবে সেই এলাকায় জোনাকি পোকা থাকে না। জোনাকির শরীরে লুচিফেরিন নামক রাসায়নিক পদার্থ থাকে। যা ক্যান্সার, চর্মরোগ, সিস্টিক ফ্যাব্রোসিস এবং হৃৎপিন্ডের নানা রোগের প্রতিষেধক তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। কাজেই জোনাকি সংরক্ষণ ও পোকাটি নিয়ে আরও গবেষণার দরকার আছে বলে উল্লেখ করেন নাসির উদ্দিন।

এদিকে আধুনিক যুগের বিজ্ঞানীরাও জোরালোভাবে জানান জোনাকি পোকার প্রক্ষেপিত কোমল আলো আমাদের ওষুধ শিল্প উন্নয়নে মুখ্য ও যুগান্তকারী ভূমিকা রাখতে পারে। এ নিয়ে বিজ্ঞানীরা তাদের গবেষণা চলমান রেখেছেন বলে জানা গেছে।

কীট তত্ত্ববিদদের মতে, পৃথিবীতে সব রকমের আলোর মধ্যে জোনাকির আলো সবচেয়ে বেশি কার্যকর, স্মার্ট ও পরিবেশবান্ধব। কিছু প্রজাতির পুরুষ জোনাকি রাতের বেলা তার নিজস্ব শৈলীতে আলো জ্বেলে নারী জোনাকি পোকাকে তার দিকে আকৃষ্ট করে থাকে। আর স্ত্রী জোনাকিরাও পুরুষ জোনাকির এরূপ আলো জ্বালানোর নিপুণ শৈলীর ওপর ভিত্তি করে সঙ্গী নির্বাচন করে থাকে।

এদিকে সচেতন মহল বলছে, জোনাকীর সংখ্যা কমে যাচ্ছে। আর এই কমে যাওয়ার মূল কারণ হচ্ছে পরিবেশে অত্যধিক আলোক দূষণ। রাতে ঝলমলে আলোর কারণে নিশাচর কীটপতঙ্গসহ নানান পশুপাখির খুব অসুবিধা হয়। আর এটাই হচ্ছে আলোক দূষণ। এই আলোকদূষণের কারণেই কমে যাচ্ছে নিশাচর কীট জোনাকিসহ আরও অনেক কীটপতঙ্গ ও পশুপাখি।

উপজেলার সদর ইউনিয়নের ডগ্রাপাড়া এলাকার বাসিন্দা আবু তাহের বলেন, আমরা ছোটবেলায় দেখেছি সন্ধ্যা হলেই বাড়ির আশপাশের ঝোঁপঝাড়ে, পুকুর ও খালের পাড়ে জোনাকি পোকা আলো জ্বালিয়ে ওড়াউড়ি করতো। এ দৃশ্য দেখতে খুব ভালো লাগতো। আমরা জোনাকি পোকা জামার পকেটে নিয়ে ঘুরতাম। জামার পকেটে মিটমিট করে আলো জ্বলতো, এতে আমরা উল্লসিত হতাম। কিন্তু এই সময়ে এসে জোনাকি পোকা দেখা যায় না বললেই চলে।

দীর্ঘভূমি বঙ্গবন্ধু উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী প্রধান শিক্ষক আমির হোসেন কালবেলাকে বলেন, জোনাকি পোকা কমে যাওয়ার প্রধান কারণ হচ্ছে পরিবেশ দূষণ। এটা দিন দিন অতিরিক্ত আলোর ব্যবহার ও অপরিকল্পিতভাবে বন উজাড় ও গাছকাটার কারণেও পরিবেশ দূষণ হচ্ছে। জোনাকি পোকা টিকিয়ে রাখতে হলে তাদের বাসযোগ্য অনুকূল পরিবেশ তৈরি করতে হবে।

ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. আবু হাসনাত মো. মহিউদ্দিন মুবিন কালবেলাকে বলেন, অপরিকল্পিতভাবে বাড়িঘর নির্মাণ ও গাছপালা কর্তনের ফলে জোনাকি পোকার আবাসস্থল কমছে। আধুনিক সময়ে অতিরিক্ত আলোকসজ্জার কারণে আলোক দূষণ বাড়ছে। এ পরিবেশ জোনাকি পোকার জন্য অন্যতম প্রধান হুমকি। এতে করে দিন দিন জোনাকি পোকা পরিবেশ থেকে হারিয়ে যাচ্ছে। জোনাকি পোকা সংরক্ষণে সকলকে এগিয়ে আসতে হবে। জোনাকি পোকার আবাসস্থল নিশ্চিত করতে হবে।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

হবিগঞ্জে পুলিশের গাড়িতে ডাকাতদলের হামলা

সান্তোসে কেমন আছেন নেইমার?

নজরুলজয়ন্তী ঘিরে কুমিল্লায় ৩ দিনের বর্ণাঢ্য আয়োজন

পাকিস্তানে পৌঁছেছে টাইগারদের ১০ সদস্যের বহর

কপোতাক্ষ নদের কাঁকড়া রপ্তানি হচ্ছে ৪ দেশে 

মেসির জাদুতে রুদ্ধশ্বাস কামব্যাক, তবুও জয় পেল না মায়ামি

আনাস হত্যা মামলা: ট্রাইব্যুনালে আনুষ্ঠানিক বিচার প্রক্রিয়া শুরু

যুদ্ধজাহাজ উদ্বোধনের সময় দুর্ঘটনায় দায়ী ৩ জনকে আটক

অটোরিকশা চালকের চোখ উপড়ানো মরদেহ উদ্ধার

সন্ত্রাসী ‘ঢাকাইয়া আকবর’ মারা গেছেন

১০

রাজধানীতে ট্রাকের চাপায় পিষ্ট দুই মোটরসাইকেল আরোহী

১১

সীমান্তে ২ বাংলাদেশিকে বিএসএফের গুলি

১২

বজ্রবৃষ্টিতে ১৩ জনের মৃত্যু

১৩

কবি নজরুলের স্মৃতিবিজড়িত ২ বাড়ি 

১৪

চাঁপাইনবাবগঞ্জে আ.লীগ নেতা মুক্তা গ্রেপ্তার

১৫

জাল সনদে এমপিও আবেদনে মাদ্রাসাশিক্ষকদের কঠোর নির্দেশনা অধিদপ্তরের

১৬

ইরান-যুক্তরাষ্ট্র পরমাণু আলোচনা থমকে গেল পাঁচ কারণে

১৭

অ্যাশেজের টানা কনসার্ট

১৮

চবির ব্যাচ-৪২ এর সভাপতি তাহিরা মিশু, সম্পাদক আলীমুল 

১৯

দুপুরের মধ্যে যেসব জেলায় ৬০ কিমি বেগে ঝড়ের শঙ্কা

২০
X