১০ মাস আগে নিখোঁজ হয়েছিল মোস্তাফিজুর রহমান (১৭) নামের এক শিক্ষার্থী। নিখোঁজের এক সপ্তাহ পর ধান ক্ষেতের একাধিক জায়গা থেকে শরীরের বিভিন্ন অংশ উদ্ধার করে পুলিশ। উদ্ধারকৃত শার্ট ও লুঙ্গি দেখে পরিবারের সদস্যরা মোস্তাফিজুরের বলে দাবি করে। এরপর জানা যায় নৃশংসভাবে খুন হয়েছে সে।
কৃষক বাবা আনোয়ার হোসেন ও মা মোসলেমা দম্পত্তির একমাত্র ছেলে নিহত মোস্তাফিজুর রহমানের বাড়ি নওগাঁর পত্নীতলা উপজেলার মসরইল (শংকরপুর) গ্রামে।
এমন হত্যাকাণ্ডে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয় এলাকাজুড়ে। কিন্তু এ হত্যাকাণ্ডের ১০ মাস পেরিয়ে গেলেও কোনো রহস্য উদ্ঘাটন করতে পারেনি পুলিশ। মামলায় তদন্তের নেই কোনো অগ্রগতি। এমনকি শনাক্ত হয়নি মূল আসামি।
এদিকে চাঞ্চল্যকর এ হত্যার রহস্য উদ্ঘাটন এবং মামলার তদন্তে অগ্রগতি না হওয়ায় পুলিশের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন ভুক্তভোগী পরিবার ও স্থানীয়রা।
তারা বলছেন, পরিকল্পিতভাবে মোস্তাফিজুরকে হত্যাকাণ্ডের এখনো রহস্য উদ্ঘাটন করতে পারেনি পুলিশ। ধরা-ছোঁয়ার বাইরে আসামি। দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি না থাকায় হতাশ ও দিশাহারা হয়ে পড়েছে নিহতের পরিবার। বিচারের আশায় দিন গুনছে তারা। স্থানীয়দের মধ্যেও বিরাজ করছে ক্ষোভ ও হতাশা। তারা দ্রুত তদন্ত সম্পন্ন করে দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানিয়েছেন।
অপরদিকে এই মামলার অন্যতম অভিযুক্ত ‘নাইম’ নামে এক যুবককে গ্রেপ্তারের পর জিজ্ঞাসাবাদ করে পুলিশ। পরবর্তীতে জামিনে বেরিয়ে আসেন নাইম। এরপর আর কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এ ছাড়াও সন্দেহভাজন কয়েকজনের নাম বললেও পুলিশ শুধু তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করেই ছেড়ে দেয়।
তবে পুলিশ বলছে, ধীর গতিতে নয়, নিয়ম মেনেই তদন্ত চলছে। মোবাইলের ফরেনসিক রিপোর্ট হাতে পেলেই চূড়ান্ত চার্জশিটের দিকে এগিয়ে যাওয়া হবে।
অন্যদিকে মা-বাবা তার ছেলে আর বোন তার ভাইয়ের বিচার পাওয়ার আশায় দিন-রাত বিলাপ করছেন। এখনো ডুকরে ডুকরে কাঁদছে। সবার চাওয়া সর্বোচ্চ শাস্তি।
পরিবারের সদস্য ও স্থানীয়রা জানান, নিয়মিত পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়তেন মোস্তাফিজ। ২০২৪ সালের ৬ নভেম্বর সন্ধ্যায় মাগরিবের নামাজ পড়তে বাড়ি থেকে বের হয়ে যায়। এরপর বাড়িতে ফিরে না আসায় তার পরিবারের লোকজন মসজিদসহ বিভিন্ন জায়গায় খোঁজখবর করতে থাকেন। কোথাও খুঁজে না পাওয়ায় তারা হতাশ হয়ে পড়েন।
পরে নিখোঁজের এক সপ্তাহ পর ১৩ নভেম্বর বিকেলে গ্রামের একটি ধান ক্ষেতের গর্ত থেকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা হাতের হাড় ও নাড়িভুঁড়ি পাওয়া যায়। আরেক গর্তে পাওয়া যায় অর্ধগলিত শরীরের কিছু অংশ। পুলিশ খবর পেয়ে সেগুলো উদ্ধার করে। পাশে পড়ে থাকা শার্ট ও লুঙ্গি দেখে পরিবারের সদস্যরা সেগুলো মোস্তাফিজুরের বলে দাবি করে।
পরের দিন ১৪ নভেম্বর আবারও ধানক্ষেতের আরেক জায়গা থেকে মাথার চামড়াসহ কিছু চুল, নাক, হাড় ও কলিজা উদ্ধার করা হয়। জানতে পারে সেগুলো মোস্তাফিজুরের দেহের অংশ বিশেষ। এই দুই দিনে ধান ক্ষেতের ভেতরে লাশের এমন অংশ দেখে বুঝতে পারেন তাকে খুন করা হয়েছে।
স্থানীয় মধইল বিএল উচ্চ বিদ্যালয় থেকে গত বছর এসএসসি পরীক্ষায় গণিত বিষয়ে অকৃতকার্য হয়েছিল মোস্তাফিজুর। তার ঘরে এখনও ঝুলছে স্কুলের আইডি কার্ড ও ব্যাগ, ফাঁকা পড়ে আছে শোবার ঘর। মাঝে মাঝেই মোস্তাফিজের ঘরে গিয়ে ছবি আঁকড়ে ধরে কান্না করেন তার মা। একমাত্র ছেলের মৃত্যুর ১০ মাস পরেও মায়ের চোখের পানি থামেনি।
মা মোসলেমা ও বোন জিন্নাতুনের মুখে এখনো শুধুই আর্তনাদ। তারা জানালেন, আমরা এমন হতভাগা মোস্তাফিজুরের হাতের হাড়, নাড়িভুঁড়ি, কলিজা দেখতে হয়েছে।
ছেলেকে শেষ বার মাগরিবের নামাজ পড়ার কথা বলেছে মা। সেই ছেলে আর ফেরেনি। ধান ক্ষেতে টুকরো-টুকরো হাড়সহ অর্ধগলিত দেহ পাওয়া যায়। পড়ে থাকা কাপড় ও দেহের কিছু অংশ দেখে শনাক্ত করি আমার ছেলে মোস্তাফিজুর। পুলিশ ডিএনএ টেস্ট করেও নিশ্চিত হয় ওটা আমার সন্তান। কারা মারল, কী কারণে মারল এসবের উত্তর আজও অজানা। ছেলেকে হারিয়েছি, বিচারটুকু তো পাব। প্রায় ১০ মাস হয়ে যাচ্ছে তবুও আমার সন্তানের হত্যার বিচারের কোনো অগ্রগতি নেই। এভাবেই ক্ষোভ ও কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন মোস্তাফিজুর রহমানের মা মোসলেমা আক্তার।
একইভাবে আমি হতভাগা পিতা দাবি করে আনোয়ার হোসেন বলেন, থানায় কয়েক জনের নাম উল্লেখ করে মামলা করতে চাইলে নিষেধ করেন পুলিশ। বলে অজ্ঞাত নাম দিয়ে মামলা করলে পুলিশ তথ্য বের করবে। সেভাবেই মামলা করি। এরপর থেকে শুধু পুলিশ যায় আর আসে। সন্দেহমূলক থানায় কয়েকটা নাম দিলে তাদের থানায় ডেকে শুধু জিজ্ঞাসাবাদ করেই ছেড়ে দেয়। দেখতে দেখতে ১০ মাস পার হয়ে গেল তারপরও ছেলে হত্যার কোনো বিচার পাচ্ছি না। আল্লাহ জানে ছেলে হত্যার বিচার কবে পাব।
মোস্তাফিজুরের বোন জিন্নাতুন বলেন, থানায় মামলা করতে গেলে পুলিশ তাদের মতো করে লেখে অভিযোগ নেয়। এখন মনে হচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ অভিযোগ না হওয়ায় এতদিন বিচার পাচ্ছি না। হয়তো কোনো অদৃশ্য শক্তি কাজ করছে। ১০ মাস হয়ে গেল আর কতদিন অপেক্ষা করতে হবে। পুলিশ কর্মকর্তারা বদলি হয়ে গেলে আরও বিচার পাওয়া যাবে না। আমরা চাই পুলিশ ভালো করে তদন্ত করলে অবশ্যই খুনি ধরা পড়বে।
স্থানীয় স্কুল শিক্ষক আবুল হোসেন, মসজিদের মোয়াজ্জিন আবুল কালাম আজাদ, ইউপি সদস্য মনছুর আলী ও শারমিন আক্তার নামে এক গৃহবধুসহ বেশ কয়েকজন বলেন, নিহত মোস্তাফিজুর রহমান ছিলেন শান্ত-শিষ্ট ও ভালো ছেলে। তিনি নিয়মিত পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করতেন এবং সবার সঙ্গে ভালো ব্যবহার করতেন। এত নির্মমভাবে কাউকে হত্যা করা যায় জীবনে দেখিনি। আর এই নৃশংস হত্যার বিচার হবে না এটা তারা মেনে নিতে পারছেন না।
তারা বলেন, আজকে আসামি ধরছে, কালকে ছাড়ছে এ নিয়ে কানাঘুষা চলছে। এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে কারা জড়িত পুলিশ নির্দিষ্ট কাউকে খুঁজেও বের করতে পারেনি। প্রশাসনের কাছে দাবি দ্রুত তদন্ত শেষ করে দোষীদের আইনের আওতায় নিয়ে আসা হোক। আমরা গ্রামবাসী চাই মোস্তাফিজুর হত্যাকাণ্ডের সঠিক বিচার। সেই সঙ্গে এমন শাস্তি দেওয়া হোক যাতে এমন ন্যক্কারজনক কাজ কেউ করতে সাহস না পায়।
নওগাঁর পুলিশ সুপার মোহাম্মদ সাফিউল সারোয়ার কালবেলাকে জানান, ২০২৪ সালের ১৩ নভেম্বর মাঠ থেকে একটি মরদেহ উদ্ধার করা হয়। পরে ডিএনএ পরীক্ষায় নিশ্চিত হওয়া যায় সেটি মোস্তাফিজুর রহমানের। এ ঘটনায় একজনকে গ্রেপ্তার করা হলেও তার বিরুদ্ধে প্রমাণ পাওয়া যায়নি। বাদীপক্ষ আরও কয়েকজনের নাম বললেও তদন্তে এখন পর্যন্ত তাদের সম্পৃক্ততার প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
জেলার এই পুলিশ প্রধান আরও বলেন, আমরা চাই না নিরপরাধ কেউ শাস্তি পাক। তবে দোষীদের অবশ্যই আইনের আওতায় আনা হবে। আমরা ফরেনসিক রিপোর্টের জন্য অপেক্ষা করছি। তদন্তে মোটামুটি একটা পর্যায়ে চলে এসেছি। মোবাইলের ফরেনসিক রিপোর্ট হাতে পেলেই চূড়ান্ত চার্জশিটের দিকে এগিয়ে যাওয়া হবে।
তবে পরিবারের সদস্যরা ও স্থানীয়রা মনে করছেন, তদন্তে উদাসীনতার কারণে বিচার প্রক্রিয়া প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে। প্রশাসন ও সরকারের প্রতি তাদের জোর দাবি, দ্রুত এই হত্যাকাণ্ডের রহস্য উন্মোচন করে দায়ীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা হোক।
মন্তব্য করুন