বাংলাদেশের গ্রাম থেকে শহরে মানুষের মাথার চুল বিশেষ করে মেয়েদের ঝরে পড়া চুল বা ফেলনা চুল এখন আর ফেলনা না। এসব ফেলে দেওয়া চুল দিয়েই আসছে শত কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা।
চুয়াডাঙ্গার দামুড়হুদা উপজেলায় নিজ উদ্দোগে গড়ে উঠেছে শত শত চুল প্রসেসিং এর কারখানা। এসব কারখানার অধিকাংশই আবার উপজেলার সীমান্তবর্তী কারপাসডাঙ্গা ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামে অবস্থিত। এতে প্রায় ২০ হাজার পরিবারের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হওয়ায় পাশাপাশি বদলে গেছে তাদের ভাগ্য। নারী-পুরুষ কাজ করে আয় করছে হাজার হাজার টাকা। আর এই চুলের মহাজনরা বা মালিকরা এখন কোটিপতি।
যেভাবে চুল বিক্রির জন্য প্রস্তুত করা হয়:
প্রথমে লোহার কাটা বা কাঁচি দিয়ে জড়ানো চুলগুলো ছাড়িয়ে লম্বা করে গোছা করা হয়। এরপর গোছাগুলো শ্যাম্পু দিয়ে একাধিকবার ধুয়ে রোদে শুকিয়ে নেওয়া হয়। শুকানোর পর ছোট বড় বাছাই করে গাডার দিয়ে বেঁধে ছোট বড় আলাদা করে প্যাকেটজাত করে আনা হয় ঢাকায়। এখান থেকে দেওয়া হয় বায়ারদের।
চুয়াডাঙ্গায় চুল রপ্তানি গল্পের শুরুটা, ২০০২ সালের দিকে ভারত সীমান্তে দামুড়হুদার কারপাসডাঙ্গা ইউনিয়নের কিছু বেকার যুবক চোরাচালানীর কাজে লিপ্ত ছিল। এরা ভারত থেকে মাদকসহ নানাবিধ মালামাল আনা-নেওয়া করতো। এই যুবকরাই প্রথম ভারতীয় চোরাচালানীদের কথামত নিজ এলাকা থেকে অন্যান্য চোরাই পণ্যের সাথে নারীদের মাথার চুল ভারতে পাচার শুরু করে। তখন চীন, কোরিয়া ও বার্মার বায়াররা ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে চুল ক্রয় করতো। এক পর্যায়ে বায়াররা জেনে যায় বাংলাদেশের মহিলাদের মাথার চুল লম্বা এবং সুন্দর। তারা বাংলাদেশে আসে। পরিচয় হয় কারপাসডাঙ্গার চুল চোরাচালানীদের সাথে। তারা প্রস্তাব দেয় ভাল চুল সরবরাহের। এরপর থেকে যুবকরা চোরাচালানীর পথ ছেড়ে গ্রামে-গঞ্জে ও শহরের আনাচে-কানাচে কুড়াতে থাকে মহিলাদের মাথার চুল। চুল রপ্তানি এসব তথ্য জানালেন কারপাসডাঙ্গা চুল সমিতির সভাপতি শহিদ বিশ্বাস। এভাবে ক্রমেই ছড়িয়ে পড়ে পরিধি, চুল সংগ্রহ বাড়তে থাকে। বর্তমানে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে প্রতিদিন অন্তত ২ হাজার কেজি চুল আমদানি হয় চুয়াডাঙ্গায়। আর দেশের সবচেয়ে বড় চুলের হাট কার্পাসডাঙ্গা।
এসব কারখানায় একজন দক্ষ শ্রমিকের বেতন ১৫ হাজার টাকা থেকে ২০ হাজার টাকা পর্যন্ত হয়ে থাকে। মহিলা শ্রমিকেরা মূলতো চুক্তিবদ্ধ ভাবে গুটি চুল বাছাই এবং পরিষ্কারের কাজ করে থাকে। প্রতি ১০০ গ্রাম গুটি চুল বাছাই এবং পরিষ্কার করতে তারা পেয়ে থাকে ১০০ থেকে ১৫০ টাকা। সেই হিসেবে একজন মহিলা শ্রমিক মাসে এই কাজ করে ৫ থেকে ৬ টাকা আয় করে। কারখানাগুলো ঘুরে দেখা যায় এখানকার শ্রমিকেরা একে অপরের সাথে পাল্লা দিয়ে কাজ করে চলেছে। এতে যেমন কারখানার মালিক লাভবান হচ্ছে ঠিক তেমনি হাজার-হাজার পরিবারের কর্মসংস্থানেরও সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে।
একসময় এসব এলাকার নারী-পুরুষেরা সীমান্তে চোরা চালান কাজে লিপ্ত ছিল। সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া স্থাপনের কারণে তারা একসময় অনেকটাই বেকার হয়ে পড়ে। ঢাকা, কুমিল্লা, নঁওগা, বরিশাল, চিটাগাং এলাকায় চুলের কারবারের কথা শুনে তারা দলে দলে স্থানীয়ভাবে ফেরী করে গুটি চুল সংগ্রহ করে কেনা-বেচা করতে থাকে। এই ব্যাবসায়ে লাভ হবার কারণে এবং এর ব্যাপক চাহিদা দেখে তারা চুল প্রসেসিং কারখানা করতে উদ্দোগি হয়ে তাদের মহাজনদের পরামর্শক্রমে নিজেরাই কারখানা গড়ে তোলে।
২০০৩ সালের শেষের দিকে মাত্র কয়েকটা ছোট কারখানা তৈরীর মাধ্যমে শুরু হয় এই এলাকার চুল প্রসেসিং কারখানা। আর আজ সীমান্তবর্তী এসব এলাকায় গড়ে উঠেছে প্রায় ৫শ থেকে ৬শ টির মত ছোট বড় কারখানা যা কর্মসংস্থান যোগাচ্ছে প্রায় ২০ হাজারের মত পরিবারের। প্রতিদিন পরিবহন যোগে শত শত কেজি গুটিচুল চলে আসছে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এসব এলাকায়।
চুয়াডাঙ্গার দামুড়হুদা উপজেলার কার্পাসডাঙ্গা ইউনিয়নের কুতুবপুর গ্রামের কারখানা মালিক মনির হোসেন জানান, প্রথমে তিনি ৩-৪ কেজি চুল দিয়ে কারখানা শুরু করেন। বর্তমানে তার কারখানায় প্রতিদিন ৩০ থেকে ৪০ কেজি চুলের কাজ করা হয়। পুরুষ এবং মহিলা শ্রমিক মিলে প্রায় ১০০-১৫০ জন শ্রমিক নিয়মিত কাজ করছে তার কারখানায়। চুলের মহাজনদের কাছ থেকে গুটি চুল আনার পর থেকে রেমি চুল প্রস্তুত করা পর্যন্ত নারী-পুরুষ উভয়ই দক্ষতার সাথে কাজ করে যাচ্ছে।
এই গুটি চুল প্রথমে মহিলা শ্রমিকের মাধ্যমে গুটি ছাড়িয়ে আলাদা করে প্রাথমিক পরিষ্কার এবং বাছাই কাজ করা হয়। এরপর এই বাছাই করা চুলগুলো ডিটার্জেন্ট পাওডার ও শ্যাম্পু দিয়ে পানিতে ভিজিয়ে রেখে পরিষ্কার করা হয়। দ্বিতীয়বারের মত পরিষ্কার করা এই চুল কারখানার ভিতরে নিয়ে কাটিং মেশিনের মাধ্যমে কাচি করা হয়।কাচি করা চুলগুলোকে একই সাথে রাবার দিয়ে ছোট ছোট গোছায় বেঁধে আলাদা করা হয়। কারখানায় এই ছোট ছোট গোছা করা চুলগুলোকে বলা হয় নচি/লাচি।এবার এই নচি/লাচি করা চুল পূনরায় শ্যাম্পু ও কন্ডিশনার ব্যাবহার করে ধৈত করে বাতাশে শুকানো হয়। শুকিয়ে চুল যখন উজ্জল হয় তখন এগুলোকে শেষবারের মত কাটিং মেশিনে নেয়া হয় ফিতা দিয়ে মেপে গ্রেডিং করে রেমি তৈরীর জন্য। এই রেমি করা চুলই কারখানা থেকে বিক্রির জন্য প্রস্তুতকৃত চুল।
চাইনা থেকে বায়াররা সরাসরি কারখানায় এসে তাদের কমিশনভুক্ত লোকের মাধ্যমে এই চুল কিনে নিয়ে যায়। তাই চুল বিক্রি করতে এমন কোন ঝামেলাই পোহাতে হয়না। কিছু কিছু কারখানা মালিকেরা আবার বাড়তি লাভের আশায় নিজেরায় ঢাকাতে গিয়ে চুল বিক্রি করে থাকে।
কারপাসডাঙ্গা চুল প্রসেসিং ব্যাসায়ী সমিতির সভাপতি শহিদুল ইসলাম জানান, আমাদের এলাকার সকল চুল ব্যাবসায়ীরা বেশ সাচ্ছন্দে কোন ঝামেলা ছাড়াই ব্যাবসা করে যাচ্ছে। আমাদের এই ব্যাবসার বৈধ সনদ থাকার পরও চুল ঢাকায় নিয়ে যাওয়ার সময় আমাদের পুলিশি হয়রানির স্বীকার হতে হয় মাঝে মধ্যে।
রেমি (প্রসেসিং) চুলের দৈঘ্যের ওপরই এর মূল্য নির্ভর করে। চুল যত লম্বা হবে বাজার দরও তত বেশি হবে। চুলের এই দৈর্ঘ্যের ওপর ভিত্তি করে এর বাজার মূল্য সর্বনিন্ম ৬ ইঞ্চি চুল ১ হাজার ২০০ টাকা থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ ২২-৩২ ইঞ্চি সাইজের চুল প্রতিকেজি ৬০ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ২২ ইঞ্চি থেকে ৩২ মাপের লম্বা চুলকে সর্বোচ্চ গ্রেডের চুল বলা হয়।
বর্তমান প্রতিদিন দামুড়হুদা এলাকা থেকে ৫০০ থেকে ৬০০ কেজি প্রসেসিং চুল বায়ারদের কাছে যায়। এই চুলের গড় মূল্য প্রায় ১ কোটি টাকা।
সাম্প্রতিক সময়ে যখন বিভিন্ন শিল্প গড়ে তোলার জন্য ব্যাংক ঋণ নিয়ে ঋণখেলাপীর মতো ন্যাক্কারজনক ঘটনার জন্ম হচ্ছে একটিরপর একটি ঠিক তখনই নিজ উদ্দোগে গড়ে তোলা এই চুল প্রসেসিং কারখানা হাজার হাজার মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টির মাধ্যমে সম্ভাবনার নতুন ক্ষেত্র সৃষ্টি করেছে।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্য মতে এই ফেলনা চুল রপ্তানি করে সবচেয়ে বেশি মুদ্রা এসেছে ২০১৫-১৬ অর্থবছরে এক কোটি ১৪ লাখ মার্কিন ডলার। বর্তমানে চীনসহ কিছু দেশ বাংলাদেশে এসে এই খাতে বিনিয়োগও করছে। ফলে ছোট একটি খাত হলেও সেটি ধীরে ধীরে সম্ভাবনা জাগাচ্ছে বলেই মনে করা হচ্ছে।
মন্তব্য করুন