যশোরের শিল্প ও বাণিজ্য নগরী নওয়াপাড়া ভৈরব সেতু পার হয়ে দেয়াপাড়ায় খোলা আকাশের নিচে পড়ে আছে সরকারের কোটি টাকার ভর্তুকির সার। মাসের পর মাস রোদ-বৃষ্টিতে পড়ে থাকা এই রাসায়নিক সারের মান নিয়েও রয়েছে সংশয়। খোঁজ নিয়ে জানা গেল ওই সার বিদেশ থেকে আমদানি করেছে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন (বিএডিসি)। ওই সারের পরিবহন ঠিকাদার আকিজ গ্রুপের অঙ্গ-প্রতিষ্ঠান দ্য সাকসেসর রস জাহাজ থেকে খালাস করে আনলেও বিএডিসির গুদামে জায়গা সংকটের কারণে তাদের বুঝিয়ে দিতে না পেরে খোলা আকাশের নিচে ফেলে রেখেছে।
শুধু এই একটি ড্যাম্পেই নয়, নওয়াপাড়া মেইন রোডে এবং অলিতে-গলিতে দেখা যাচ্ছে অসংখ্য সারের ড্যাম্প। এ ছাড়াও ফুলতলা, খুলনা, শিরোমনি, আশুগঞ্জ, কালীগঞ্জ, মুক্তারপুর, নারায়ণগঞ্জের আলীগঞ্জ, আমিন বাজার ও গাবতলীর বিভিন্ন পয়েন্টে খোলা আকাশের নিচে অসংখ্য ড্যাম্পে প্রায় ছয় থেকে সাত লাখ টন সার পরিবহন ঠিকাদাররা ফেলে রেখেছেন। যা গুদাম সংকটের কারণে গ্রহণ করতে পারছে না বিএডিসি।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, সারা দেশের বিএডিসির গুদামগুলোর ধারণ ক্ষমতা আড়াই লাখ থেকে তিন লাখ টন। কিন্তু তাদের ধারণ ক্ষমতার চেয়ে কয়েক গুণ আমদানি করায় ওই সার পরিবহন ঠিকাদারদের কাছে পড়ে থাকে। ২০২১-২২ এবং ২০২২-২৩ অর্থবছরে আমদানি করা ডিএপি, টিএসপি ও এমওপি সার এখনো পরিবহন ঠিকাদারদের কাছে (খোলা আকাশের নিচে) পড়ে আছে। আন্তর্জাতিক বাজার বৃদ্ধির কারণে বিগত অর্থবছরে অধিক মূল্যে আমদানি করা লক্ষাধিক টন ডিএপি ও টিএসপি এখনো পরিবহন ঠিকাদারদের কাছে পড়ে রয়েছে, যা গ্রহণ করতে পারেনি বিএডিসি। অথচ, বর্তমান আন্তর্জাতিক বাজার অনুযায়ী ওই সারের মূল্য অর্ধেকে নেমে এসেছে। বিএডিসি সূত্রে জানা গেছে, সারা দেশে বিএডিসির ধারণ ক্ষমতা আড়াই লাখ টনের একটু বেশি, তবে এই মুহূর্তে তাদের মজুত ৯ লাখ টনের মতো। এর মধ্যে পশ্চিমাঞ্চলে ধারণ ক্ষমতা ১ লাখ ৩৪ হাজার টন হলেও মজুত আছে প্রায় তিন লাখ টন।
সঠিক পদক্ষেপের অভাবে সরকারের গচ্চা
বিশ্ব বাজারে প্রতিনিয়ত সারের দাম কমছে। ফলে উপযুক্ত সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের অভাবে দ্বিগুণ দামে সার ক্রয় করছে বিএডিসি। পরিসংখ্যান মতে, বাংলাদেশে সারের মৌসুম হিসেবে ধরা হয় আগস্টের মাঝামাঝি থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। ফলে গত বোরো মৌসুম শেষেও বিএডিসির কাছে দুই লাখ টনেরও বেশি এমওপি সার মজুত ছিল। অথচ, প্রয়োজন না থাকলেও মার্চ থেকে জুন মাসে আরও ১ লাখ ৬৫ হাজার টন আমদানি করে। ওই সার ৬০০ ডলার মূল্যে ক্রয় করা হলেও বর্তমানে আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্য ৩২০ ডলার। এদিকে অর্থ সংকটের কারণে বিএডিসির আমদানি করা সারের জাহাজ চট্টগ্রাম বন্দরে পৌঁছানোর পরেও অর্থ পরিশোধ না করায় নির্ধারিত সময়ে আনলোড শেষ না করতে পেরে বিপুল টাকা জাহাজকে জরিমানা গুনতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে বিএডিসি। সর্বশেষ গত ১৫ জুন কানাডা থেকে প্রায় ৫৫ হাজার টন এমওপি সার নিয়ে এমভি স্লিপার কোপ নামে একটি জাহাজ চট্টগ্রামের কুতুবদিয়ায় পৌঁছেছে।
নিয়ম অনুযায়ী, প্রতিদিন ৩ হাজার টন খালাস করে জাহাজ ছেড়ে দিতে হবে, এই নির্ধারিত সময়ের ব্যত্যয় ঘটলে প্রতিদিন ১২ হাজার ডলার ক্ষতিপূরণ গুণতে হবে। অথচ, এই জাহাজটি দেশে আসার প্রায় এক মাস হতে চললেও এখনো আমদানির টাকা পরিশোধ করতে না পারায় খালাস শুরু হয়নি। ফলে বিএডিসিকে গুনতে হচ্ছে বিপুল পরিমাণ জরিমানা। এর আগেও চলতি বছরে আরও একাধিক জাহাজকে সময়মতো অর্থ পরিশোধ না করতে পেরে জরিমানা গুনতে হয়েছে। অন্যদিকে, সময়মতো তদারকি করে পরিবহন ঠিকাদারদের কাছ থেকে সার বুঝে না নেওয়ায় পরিবহন ঠিকাদার পোটন ট্রেডার্স, মেসার্স নাবা অ্যান্ড কোম্পানি ও কুষ্টিয়া ট্রেডার্স শত শত কোটি টাকার সার কালোবাজারে বিক্রি করে টাকা হজম করে বেকায়দায় ফেলেছে রাষ্টীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান বিএডিসিকে।
অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারী
বিএডিসির অধিকাংশ গুদামে দায়িত্বরত ইনচার্জ, অফিস সহকারী ও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও পরিবহন ঠিকাদার ও ডিলারদের কাছ থেকে ঘুষ বাণিজ্যের বিষয়টি ওপেন সিক্রেট। এ ছাড়াও গুদাম থেকে অবৈধভাবে খোলা বাজারে সার পাচারের মতো ভয়ংকর কয়েকটি ঘটনাও ঘটেছে। গুদাম থেকে কালোবাজারে সার বিক্রির মামলায় সাবেক এক কর্মকর্তা সম্প্রতি আদালতের রায়ে। এ ছাড়া দেশের বিভিন্ন গুদামে সার চুরির ঘটনায় মামলার বিষয়টিও পুরোনো। বেশ কিছু গুদাম থেকে কালোবাজারে সার বিক্রির ঘটনাও ঘটছে।
ভাড়ায় খাটছে বিএডিসির সার ডিলারশিপ
সারা দেশে জোর তদারকি না থাকায় বিএডিসির অসংখ্য সার ডিলারশিপ কাগজে-কলমেই রয়েছে। বাস্তবে, অধিকাংশ ডিলারের দেওয়া ঠিকানায় কোনো দোকান বা গুদামের অস্তিত্ব পাওয়া নেই। ফলে কাগুজে ডিলাররা মাসিক বরাদ্ধের সার সিন্ডিকেটের কাছে বিক্রি করে দেয়। ফলে কৃষিবান্ধব সরকার সারের যে মূল্য নির্ধারণ করেছে তার থেকে অনেক বেশি দামে সার কিনতে হচ্ছে প্রান্তিক কৃষকদের। কখনো কখনো টাকা হলেও সার কিনতে পারে না কৃষক। গত বোরো মৌসুমে বিএডিসির কাছে পর্যপ্ত এমওপি সার মজুত থাকলেও সারা দেশে কৃষক এমওপি সার পায়নি। ভরা মৌসুমে এমওপি সার না পেয়ে অধিকাংশ কৃষক দ্বিগুণ টাকা দিয়ে খোলা বাজার থেকে কিনতে বাধ্য হয়েছে। আবার কোনো কোনো অঞ্চলে সময়মতো এমওপি সার না পাওয়ায় প্রয়োগ করতে পারেনি কৃষক। বিএডিসি পশ্চিমাঞ্চলের দায়িত্বরত যুগ্ম পরিচালক (সার) মো. লিয়াকত আলী বলেন, বিএডিসি আপদকালীন সময়ে দায়িত্ব পালন করে, সেহেতু চাহিদার চেয়ে বেশি সার মজুত থাকে। কারণ, হঠাৎ করে তো বিদেশে থেকে সার আনা যায় না। তিনি স্বীকার করে বলেন, গত বছর আমাদের বরাদ্ধ ছিল না, তারপর আমদানি হওয়ায় গুদাম সংকটের কারণে সার পরিবহন ঠিকাদারের কাছে রয়েছে। তবে, খুব শিগগিরই এ পরিস্থিতি কেটে যাবে।
২০২১-২২ সালে আমদানি করা সার খোলা আকাশের নিচে মান ঠিক আছে কিনা এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, যেহেতু গুদামে জায়গা ছিল না, সেহেতু এটা নিয়ে কী বলব, আশা করি কোনো সমস্যা হয়নি। তবে এসব সার দ্রুতই গুদামে নেওয়া হবে।
এসব বিষয়ে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের (বিএডিসি) জেনারেল ম্যানেজার (জিএম সার) ওবায়দুল ইসলামের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এসব বিষয়ে আমি কোনো ধরনের বক্তব্য দিতে পারব না। এসব বিষয়ে জানতে সরকারি নিয়মে মিডিয়া সেলের সঙ্গে যোগাযোগের পরামর্শ দেন তিনি।
মন্তব্য করুন