একজোড়া মুরগির দাম ২৫ হাজার টাকা এমন কথা শুনে চোখ কপালে ওঠারই কথা, কিন্তু তা অবাস্তব নয় বাস্তবেই তাই। বিদেশি আমেরিকান ব্রাহমা জাতের একজোড়া মুরগির দাম ১৫ থেকে ২৫ হাজার টাকা। শুধু তাই নয়, এর থেকেও বেশি দামের মুরগি আছে আপনের খামারে। সাজ্জাদুল ইসলাম আপন শখের মুরগি খামারি। তার বাড়ি বগুড়ার গাবতলীতে।
মায়ের কাছ থেকে নেওয়া ২ হাজার টাকা দিয়ে মুরগি পালন শুরু করে এখন তার খামারে ২৮ প্রজাতির প্রায় তিন শতাধিক বিদেশি মুরগি আছে। যার বাজার মূল্য কমপক্ষে ৫ লাখ টাকা। করোনার কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হওয়ায় ছাত্রাবাস থেকে বাড়ি ফিরে এক অর্থে বেকার বসে থাকা আপন শখের বসে শুরু করেন মুরগি পালন। বিদেশি জাতের সেই মুরগিরই বদলে দিয়েছে তার জীবন। এক প্রজাতির মুরগি থেকে এখন আপনের কাছে আছে ২৮ প্রজাতির বিদেশি মুরগি। ঘরের কোণের ছোট্ট এক খাঁচা থেকে এখন তা পরিণত হয়েছে খামারে। নতুন করে একটি খামার ভবন নির্মাণেও হাত দিয়েছেন আপন।
সাজ্জাদুল ইসলাম আপন গাইবান্ধা সরকারি কলেজের ইংরেজি বিভাগের অনার্স প্রথম বর্ষে পড়ার সময় করোনার প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। সে সময়ই বগুড়া শহরের সেউজগাড়ির একটি ছাত্রাবাস থেকে বাড়ি ফিরে মুরগি প্রতিপালনে মনোযোগী হন আপন। ‘শখের মুরগিওয়ালা’ নামে এখন সারা দেশেই পরিচিত আপন। মুরগি পালনে শুধু যে নিজের ভাগ্যই বদলিয়েছেন তা নয়, বরং এখন তার খামারে এলাকার ৮ জন মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থাও হয়েছে। সেইসঙ্গে সারা দেশের বিভিন্ন প্রান্তে অসংখ্য মানুষকে কর্মমুখি করতে সরবরাহ অব্যাহত রেখেছেন তার খামারে উৎপাদিত মুরগি। প্রতিদিন তার খামার পরিদর্শনে যাচ্ছেন নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ। অসাধারণ দর্শনীয় সব মুরগি কোলে ও কাঁধে নিয়ে তুলছেন ছবি ও সেলফি।
মুরগি পালনের এ গল্প জানতে চাইলে আপন বলেন, ‘শহরের সেউজগাড়ির একটি ছাত্রাবাসে থেকে আমি পড়ালেখা করতাম। করোনার সময় বাড়ি চলে এলাম। ঘরবন্দি সময়ে একদিন ফেসবুকে স্ক্রল করতে গিয়ে কিছু শৌখিন মুরগি চোখে পড়ল। মুরগিগুলো ভালো লাগায় তার সন্ধানে নেমে পেয়েও গেলাম। কিন্তু কেনার মতো টাকা আমার হাতে ছিল না। এক জোড়া মুরগি কেনা এবং তার খাঁচাসহ খাবার মিলে ২ হাজার টাকার দরকার। সে সময় মায়ের কাছ থেকে দুই হাজার টাকা চেয়ে নেই। সেই টাকায় দেড় মাস বয়সী দুটি মুরগির বাচ্চা কিনি। বাচ্চা দুটি বড় হয়ে ছয় মাসের মাথায় ডিম দেওয়া শুরু করে। ডিম থেকে আবার বাচ্চা হয়। এভাবেই শুরু।’
আপন জানান, এখন তার কাছে ২৮ প্রজাতির মুরগি রয়েছে। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, সিল্কি, ব্রাহামা, কোচিন, বেনতাম, পলিশ ফ্রিজেল, ফনিক্স, ইয়োকোহামা, অনাগাদুরি, ফাইটার, পলিশকেপ, সেব্রাইট, শো-শেরেমা, বাটারকেপ, হোয়াইট ফেস, রোসকম্প ও সুমাত্রা জাতের মুরগি। নিজস্ব পদ্ধতিতে ডিম থেকে বাচ্চা ফুটিয়ে তিনি সে বাচ্চা দেশের বিভিন্ন প্রান্তের আগ্রহী খামারিদের কাছে সরবরাহ করেন। এক্ষেত্রে তার বড় সহায়ক অনলাইন মাধ্যম। ‘শখের মুরগিওয়ালা’ ফেসবুক পেইজ আর ইউটিউব চ্যানেলের মাধ্যমেই মুরগি কেনাবেচা করছেন আপন।
বগুড়ার গাবতলী উপজেলা সদরের (পৌর এলাকা) কলেজপাড়ার আবদুল কাইয়ূম তরফদারের দুই ছেলের মধ্যে বড় আপন। পুস্তক ব্যবসায়ী বাবার ইচ্ছা ছিল ছেলে বড় হয়ে ডাক্তার হবে। এজন্য মেধাবী আপনকে বগুড়া জিলা স্কুলে ভর্তি করিয়েছিলেন। ভর্তি পরীক্ষায় স্বল্প নম্বরের ব্যবধানে মেডিকেলে ভর্তির সুযোগ হাতছাড়া হলে গাইবান্ধা সরকারি কলেজে ভর্তি করানো হয় আপনকে। এতে বাবার মন খারাপ হলেও ছেলের বর্তমান সাফল্যে বেশ খুশি কাইয়ূম।
তিনি বলেন, ‘আগে ভাবতাম নিজের ইচ্ছা অনুযায়ী ছেলেকে লেখাপড়া করাতে পারলাম না, ওর ভবিষ্যৎ যে কি হয়! আর এখন ভাবি আমি না থাকলেও ও আর ঠেকবে না। ব্যবসার যে পথ ও পেয়েছে এছাড়া দেশের বিভিন্ন প্রান্তের যে মানের লোকজনের সঙ্গে ওর পরিচয় হয়েছে এখন আর ওকে নিয়ে চিন্তা হয় না। এছাড়া ছোট ছেলে আবিদুল ইসলাম আবিদ এবার এসএসসি পরীক্ষা দিচ্ছে, সে-ও বড় ভাইয়ের সঙ্গে থেকে একই পথে হাঁটছে, আমার ধারণা ওরা নিজেরাই নিজেদের মতো করে প্রতিষ্ঠিত হতে পারবে।’
আপন বলেন, ‘শখ থেকে এই ব্যবসা শুরু করেছিলাম। এখন সেখানকার আয় থেকে ছোট ভাইয়ের লেখাপড়া ও নিজের লেখাপড়ার খরচ জোগাতে পারছি। এলাকার সমবয়সী কিছু তরুণের উপার্জনের ব্যবস্থা করতে পারছি, এটাই বড় পাওয়া। এছাড়া প্রতিদিন বিভিন্ন এলাকার উদ্যোক্তারা আসছেন, যুব উন্নয়নে প্রশিক্ষণ নিতে আসা তরুণরা এসে খামার পরিদর্শন করছেন এটা শুধু লেখাপড়ার মধ্যে থাকলে আমার ভাগ্যে জুটত না।’ এছাড়া ইতিমধ্যে বগুড়া সদর এবং গাবতলী উপজেলায় প্রাণিসম্পদ প্রদর্শনীতে পুরস্কার জেতাও সম্ভব হতো না উল্লেখ করে আপন কোনো কাজকেই ছোট করে না দেখে তরুণ ও শিক্ষার্থীদের ছোটখাটো যে কোনো কিছু দিয়ে উদ্যোগ গ্রহণের আহ্বান জানান।
বগুড়া সদর উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. একেএম ফরহাদ রোমান জানান, প্রাণিসম্পদ অফিস সবসময় এ রকম তরুণ উদ্যোক্তাদের উৎসাহিত করেন। আপনের মতো কেউ এমন উদ্যোগ নিতে চাইলে তাদের সার্বিক সহযোগিতা করা হবে।
মন্তব্য করুন