পার্বত্য জেলা রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি এবং বান্দরবান জেলায় নির্মিত সীমান্ত সড়কে খুলছে অর্থনীতি ও পর্যটনশিল্পের নতুন দুয়ার। এ সড়কের কারণে পাহাড়ি জনপদগুলোতে লেগেছে আধুনিকতার ছোঁয়া।
সড়কটির নির্মাণকাজ শেষ হলে যোগাযোগের পাশাপাশি পার্বত্য চট্টগ্রামের ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার এবং পর্যটনশিল্পের ব্যাপক উন্নয়ন ঘটবে। ফলে এ তিন জেলা শিক্ষা, স্বাস্থ্য থেকে শুরু করে সড়ক যোগাযোগে অভূতপূর্ব উন্নতি ও অর্থনৈতিক অঞ্চল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবে।
এ সড়কের কারণে যোগাযোগ ছাড়াও পার্বত্য জেলার সীমান্তে নিরাপত্তা নিশ্চিতের পাশাপাশি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ব্যবসা বাণিজ্য প্রসার, সামাজিক উন্নয়ন, স্থানীয়দের উৎপাদিত কৃষিপণ্য বাজারজাতকরণ ও পর্যটনশিল্পের নতুন দুয়ার খুলবে বলে আশা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
রাজস্থলী থেকে জুরাছড়ির দুমদুমিয়ায় ৫৬ কিলোমিটার সড়ক ঘুরে দেখা গেছে, রাঙামাটির দুর্গম দুমদুমিয়ায় আগে যেতে সময় লাগত দুই থেকে তিন দিন। এখন সীমান্ত সড়কের কারণে সেখানে পৌঁছাতে সময় লাগছে মাত্র কয়েক ঘণ্টা। এ সড়কের কারণে সহজে স্থানীয় বাসিন্দা ও পর্যটকরা যাতায়াত করতে পারছেন।
সড়কটির নির্মাণকাজ প্রায়ই শেষ। সড়কের দুপাশে প্রাণ জুড়ানো সবুজ প্রকৃতি। মাঝে মাঝে দেখা মিলে দুয়েকটি পাড়ার। রাজস্থলীর এই সড়ক দিয়ে বিলাইছড়ির ফারুয়া ইউনিয়ন হয়ে জুরাছড়ির দুর্গম দুমদুমিয়ায় যাওয়া যায় মাত্র দুই থেকে আড়াই ঘণ্টায়।
সড়কটির নির্মাণকাজ শেষ হলে সময় আরও কমে আসবে। আগে যেখানে নদী ও পাহাড়ি পথে হেঁটে বিলাইছড়ির ফারুয়া ও জুরাছড়ির দুমদুম্যায় যেতে সময় লাগত দুই থেকে তিন দিন। সড়কের সঙ্গে যুক্ত হয়ে উদয়াচল, শান্তিপাড়া, রোয়াপাড়া ছড়া, আমকাটাছাড়াসহ বিভিন্ন পাড়ার মানুষ সহজে যাতায়াত করতে পারছে। এলাকাটি উঁচু পাহাড় হওয়ায় কয়েকটি ভাগে বিভক্ত করে জেড আকারে সড়কটি নির্মাণ করা হয়েছে।
জানা গেছে, পাবর্ত্য চট্টগ্রামের সীমান্তে নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে ২০১৯ সালে রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান এ তিন পার্বত্য জেলায় সীমান্ত সড়ক নিমার্ণের প্রথম পর্যায় শীর্ষক প্রকল্পের কাজ শুরু হয়। সীমান্ত ও সংযোগ সড়কসহ প্রকল্পের দৈর্ঘ্য ১০৩৬ কিলোমিটার। যা কয়েকটি পর্যায়ে সম্পন্ন করা হবে। এর মধ্যে একনেক কর্তৃক প্রথম পর্যায়ের প্রকল্পটি অনুমোদিত হয়েছে। এর দৈর্ঘ্য ৩১৭ কিলোমিটার।
তার মধ্যে ২২০ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হয়েছে। আরও ৪৭ কিলোমিটার নির্মাণ কাজ চলমান আছে, যা ২০২৪ সালের মধ্যে সম্পন্ন হবে। প্রকল্পটির বর্তমান ভৌত অগ্রগতি ৮২ ভাগ ও আর্থিক অগ্রগতি ৮৫ ভাগ। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী।
প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানান, ঠেগামুখ-লইতংপাড়া-থানচি-দুমদুমিয়া-রাজস্থলী পর্যন্ত ১৩০ কিলোমিটার, সাজেক-দোকানঘাট-ঠেগামুখ পর্যন্ত ৯৫ কিলোমিটার, সাজেক-শিলদা-বেতলিং পর্যন্ত ৫২ কিলোমিটার এবং উখিয়া-আশারতলী-ফুলতলী পর্যন্ত ৪০ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণ কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। ১০৩৬ কিলোমিটারের পুরো সড়কটি নির্মিত হলে খাগড়াছড়ির রামগড় থেকে বান্দরবানের ঘুমধুম সরাসরি যাওয়া যাবে। প্রথম পর্যায়ের প্রকল্পের অধীনে ছয়টি সেতু, ৩৬টি বেইলি ব্রিজ ক্রয় ও প্রতিস্থাপন, ২২১টি আরসিসি বক্স কালভার্ট নির্মাণসহ পাহাড়ি পথে সড়কটি নির্মাণ করা হচ্ছে।
রোয়াপাড়ার বাসিন্দা নন্দলাল চাকমা বলেন, এই সড়কটি হওয়ার পর আমি দোকান খুলেছি। বেচাকেনা দিন দিন বাড়ছে। সড়কটি পুরো হয়ে গেলে তা আরও বাড়বে।
দুমদুম্যা ইউনিয়নের বাসিন্দা শান্তি চাকমা বলেন, আগে আমাদের এখান থেকে হাসপাতালে রোগী নিতে দুই থেকে তিন দিন সময় লাগত। অনেক সময় রোগী পথে মারাও যেত। সড়ক হওয়ার কারণে এখন রোগী যেমন হাসপাতালে নিতে সুবিধা হচ্ছে তেমনি ফসলগুলো বাজারে নিয়ে বিক্রয় করতে সুবিধা হচ্ছে। যার কারণে আগের চেয়ে উৎপাদন বাড়িয়ে দিয়েছি।
প্রকল্পটির প্রথম পর্যায়ের পরিচালক কর্নেল ভূঁইয়া মো. গোলাম কিবরিয়া বলেন, সমতলের তুলনায় পাহাড়ে কাজ করা অনেক চ্যালেঞ্জ। এখানে মোবাইল নেটওয়ার্ক না থাকাসহ দুর্গম এলাকা হওয়ায় শ্রমিকরা থাকতে চাইতো না। নানা চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে আমাদের কাজ করতে হচ্ছে। তারপরও গুণগত মান বজায় রেখে কাজ চলছে।
সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব এবিএম আমিন উল্লাহ নুরী বলনে, সড়ক বিভাগের অধীনে এটি দেশের দীর্ঘতম সড়ক হতে চলেছে। সড়কটি নিরাপত্তাসহ স্থানীয় অর্থনীতি ও পর্যটন শিল্পে ভূমিকা রাখবে। সেনাবাহিনীর অধীনে বাস্তবায়ন করা এ সড়ক আগামী মে মাসে কাজ শেষ হলে প্রধানমন্ত্রী উদ্বোধন করবেন।
মন্তব্য করুন