‘সেখানে সবুজ ডাঙা ভরে আছে মধুকূপী ঘাসে অবিরল; সেখানে গাছের নাম কাঁঠাল, অশ্বত্থ, বট, জারুল, হিজল; সেখানে ভোরের মেঘে নাটার রঙের মতো জাগিছে অরুণ; সেখানে বারুণী থাকে গঙ্গাপসাগরের বুকে, সেখানে বরুণ’।
প্রকৃতির কবি জীবনানন্দ দাশ বরুণে বিমোহিত হয়ে এভাবেই তার কবিতায় ‘সুন্দর ও করুণ’ জায়গাটির বর্ণনা দিতে গিয়ে তুলে এনেছেন ভেষজ গাছ বরুণের কথা।
প্রকৃতিতে পলাশ শিমুলের সৌন্দর্য ম্লান হতে না হতেই বসন্তের শেষ দিকে নয়নাভিরাম সৌন্দর্যে সাজে বরুণ ফুল। সাদা ও হালকা হলুদ রঙের ফুল গ্রামবাংলার প্রকৃতিতে এক অনাবিল সৌন্দর্য এনে দেয়। এই ফুলের মনোহর দৃশ্যে যে কারো চোখ আটকে যায়। আসা-যাওয়ার পথে সকল শ্রেণিপেশার মানুষ এ ফুলের মুগ্ধতার প্রেমে পড়ে।
কুমিল্লার ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলার গ্রামে গ্রামে অনাবিল সৌন্দর্যে ভরপুর নয়নাভিরাম রাজসিক বরুণ ফুলের দেখা মেলে। থোকায় থোকায় ফোটা বরুণ ফুলের সৌন্দর্য গ্রামের প্রকৃতিতে এনে দিয়েছে এক নতুন উচ্ছ্বাস। গাছভর্তি বরুণের দৃষ্টিনন্দন ফুল অনেক দূর থেকে চোখে পড়ছে। স্থানীয়দের কাছে বরুণগাছ বউন্না গাছ নামে পরিচিত। তবে অঞ্চলভেদে এটি বন্না, বইন্না, শ্বেতপুষ্প, কুমারক, সাধুবৃক্ষ, শ্বেতদ্রুম, মহাকপিথা ও মারুতাপহ নামেও পরিচিত।
জানা গেছে, বরুণ একটি বহুবর্ষজীবী ঔষধি গাছ। এর ফল গোলাকার ও শক্ত ধরনের। বীজ ও শিকড় থেকে চারা হয়। সাধারণত বরুণকে গ্রীষ্ম ঋতুর ফুল ধরা হয়। মূলত বসন্তের মাঝামাঝি সময় থেকে বরুণের পুষ্পোচ্ছ্বাস নজর কাড়ে। বৈশাখ পর্যন্ত গাছে গাছে ফুলের সমারোহ থাকে। বরুণ ফুলের রঙ সাদা ও হালকা হলুদ। এ সময়টায় গাছভর্তি ফুলের কারণে পাতা খুব একটা দেখা যায় না।
বরুণ গাছের রয়েছে বিস্ময়কর ঔষধি গুণ। বরুণ গাছের ছাল, পাতা ও ফুলের ব্যবহার প্রাচীনকাল থেকেই মানবদেহের নানা রোগে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। চর্মরোগ, গ্যাস্টিক, ক্ষুধামন্দা, বায়ু, কফ, পিত্ত রোগে এর ব্যবহার রয়েছে। এটি পায়ের গোড়ালি ও তলার ব্যথা নিরাময় এবং মানবদেহের ভেষজ ঔষধ হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
কিডনি বা পিত্ত থলির পাথর ও মুখের মেছতায় এ গাছের ছাল ঔষধ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এটির ফল মানুষের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরিতে সহায়তা করে। এ ছাড়াও মানবদেহের আরও নানা রোগে এই গাছের ছাল, ফুল, ফল ও পাতা ভেষজ ঔষধ হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
স্থানীয়রা জানান, শোভাবর্ধনকারী এই গাছটি দিয়ে আসবাবপত্র তৈরি করা যায় না বলে এই গাছ রোপণের প্রতি নেই আগ্রহ। যার ফলে উপজেলার গ্রামীণ পরিবেশ থেকে ভেষজ এই গাছটির সংখ্যা দিনদিন কমে আসছে। বসন্তে পাতা ঝরে গেলে গ্রীষ্মের শুরুতে নতুন পাতার সঙ্গে বড় বড় থোকায় বরুণ ফুল ফোটে। মাসখানেক ধরে গ্রামীণ প্রকৃতিতে সাদা ও হালকা হলুদ রঙের ফুলের এই সৌন্দর্যের পসরা সাজানো থাকে।
কদবেলের মতো দেখতে বরুণ গাছের গোলাকার ফল শক্ত হয়। একসময় বিভিন্ন ধরনের ফল পাকাতে বরুণ গাছের পাতা ব্যবহার করা হতো। এ ছাড়া প্রাচীনকাল থেকেই বরুণ ভেষজ গাছ হিসেবে পরিচিত। বরুণের কচি ডগা ভর্তা-ভাজি করে এবং কাঁচা ফল রান্না করে সবজি হিসেবে খাওয়া যায়।
উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ কার্যালয়ের উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা শামিমুল ইসলাম বলেন, বরুণ গাছটি সারা বছর সবার দৃষ্টির অগোচরে থাকলেও গ্রীষ্মের শুরুতে ফুল ফুটিয়ে নিজের অস্তিত্ব জানান দেয়। সাদা পাপড়ির মাঝে লালচে রঙের কেশরযুক্ত থোকা থোকা বরুণ ফুল বেশ দৃষ্টিনন্দন।
বৃক্ষপ্রেমী শিক্ষক সাজ্জাদ হোসেন বলেন, গাছভরা বরুণ ফুল প্রকৃতিকে অনাবিল উচ্ছ্বাস দেয়। তবে সাধারণ মানুষের অনাগ্রহের কারণে এটি ধীরে ধীরে আমাদের প্রকৃতি থেকে হারিয়ে যাচ্ছে। এই গাছের ব্যাপক ঔষধি গুণ রয়েছে।
ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের ইউনানি চিকিৎসক সোহেল রানা কালবেলাকে বলেন, প্রাচীনকাল থেকে বরুণ ভেষজ গাছ হিসেবে পরিচিত। এর পাতা চর্মরোগ, ব্যথা, বাত নিরাময়ে ব্যবহার করা হয়। শিকড়ের বাকলের নির্যাস গ্যাস্ট্রিক রোগে ব্যবহার হয়।
তিনি বলেন, এ ছাড়া গাছের ছাল, ফুল-ফল ও পাতা অনেক রোগের চিকিৎসায় ব্যবহৃত হচ্ছে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে এই গাছের সংখ্যা দিনদিন কমে যাচ্ছে। এসব ঔষধি গাছ হারানোর ফলে প্রকৃতিও তার ভারসাম্য হারাতে বসেছে।
মন্তব্য করুন