এস কে সাহেদ, লালমনিরহাট প্রতিনিধি
প্রকাশ : ০৭ এপ্রিল ২০২৪, ০৮:২৪ এএম
আপডেট : ০৭ এপ্রিল ২০২৪, ০৯:০৯ এএম
অনলাইন সংস্করণ

লিবিয়ায় অপহরণের শিকার বাংলাদেশি ৪ শ্রমিক

লিবিয়ায় অপহরণের শিকার এক শ্রমিকের পরিবার। ছবি : কালবেলা
লিবিয়ায় অপহরণের শিকার এক শ্রমিকের পরিবার। ছবি : কালবেলা

জীবিকার সন্ধানে লিবিয়ায় পাড়ি জমানো লালমনিরহাট ও কুড়িগ্রাম জেলার ৪ শ্রমিকের অপহরণের খবর শুনে কান্নায় ভেঙে পড়েছে তাদের পরিবারের লোকজন। অপহরণের শিকার ৪ শ্রমিকের বাড়ি থেকে ভেসে আসছে কান্নার শব্দ। ঈদের কোনো আনন্দ নেই তাদের বাড়িতে। অপহরণকারী চক্রের বিকাশ নম্বরে মুক্তিপণের টাকা না দিলে শ্রমিকদের হত্যা করে লাশ গুম করার হুমকি পেয়ে এখন দিশেহারা দরিদ্র পরিবারের লোকজন।

অপহরণের শিকার শ্রমিকরা হলো, লালমনিরহাট সদর উপজেলার পঞ্চগ্রাম ইউনিয়নের সিন্দুরিয়া গ্রামের জয়নাল আবেদিনের ছেলে আল আমিন (২৩), জয়নাল আবেদিনের জামাতা ও পার্শ্ববর্তী কুড়িগ্রাম জেলার রাজারহাট উপজেলার ঘড়িয়ালডাঙার ইদ্রিস আলীর ছেলে হাফিজুল ইসলাম (৪০), রাজারহাটের ভীম শর্মা গ্রামের আবদুল মোতালেবের ছেলে আল আমিন (২২) এবং তার খালাতো ভাই ও পঞ্চগ্রামের রামরাম গ্রামের শাহিনুর ইসলামের ছেলে রাকিবুল ইসলাম (২৪)। এরা সবাই লিবিয়ার বেনগাজিতে রাজমিস্ত্রির কাজ করত।

প্রায় ৩ বছর আগে ধার দেনা, জমি বন্ধক, কেউ আবার জমি বিক্রি করে লিবিয়ায় পাঠানো হয় এসব শ্রমিকদের। পরিবারগুলো এখন নিঃস্ব প্রায়। দরিদ্র পরিবারের পক্ষে অপহরণকারীদের দাবি করা মুক্তিপণের টাকা দেওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু মুক্তিপণের টাকা বাংলাদেশে থাকা অপহরণকারী চক্রের বিকাশ নম্বরে না দিলে ওই চার শ্রমিককে হত্যা করে লাশ গুম করে ফেলার হুমকিতে এখন দিশেহারা অসহায় পরিবারগুলো।

সরেজমিন লালমনিরহাটের পঞ্চগ্রাম ইউনিয়নের সিন্দুরিয়া গ্রামে দেখা যায়, দরিদ্র কৃষক জয়নাল আবেদিনের (৬০) বাড়িতে ভাঙাচোরা দোচালা টিনের ঘর। তিন বছর আগে জমিজমা বিক্রি করে পাঁচ লাখ টাকা খরচ দিয়ে ছেলে আল আমিনকে লিবিয়ায় পাঠিয়েছেন তিনি। ছেলের সঙ্গে তার জামাতা হাফিজুল ইসলামও লিবিয়ায় পাড়ি জমান।

এসময় কৃষক জয়নাল আবেদিন জানান, তিন বছর পর হঠাৎ গত ১১ মার্চ সকালে অজ্ঞাত পরিচয় এক ব্যক্তি তার ইমো নম্বরে ফোন করেন। এ সময় জানানো হয়, তার ছেলে আল আমিন ও জামাতা হাফিজুল ইসলামকে অপহরণ করা হয়েছে। মুক্তির জন্য এক লাখ টাকা মুক্তিপণ দিতে হবে। তা না হলে তাদের দুজনকে হত্যা করার হুমকি দেওয়া হয়। ওই অজ্ঞাত ব্যক্তির ২টি বিকাশ নম্বরে ৫০ হাজার করে মোট ১ লাখ টাকা পাঠিয়ে দেওয়ার জন্য চাপ সৃষ্টি করা হয়। টাকা জোগাড় করতে পারি নাই। তাই ছেলে ও জামাতার জীবন বাঁচাতে টাকা দিতে পারি না। তারা টাকার জন্য চাপ অব্যাহত রেখেছে।

এদিকে ছেলে ও জামাতা অপহরণের খবর পাওয়ার পর থাকেই শয্যাশায়ী জয়নাল আবেদিনের স্ত্রী আলেয়া বেগম। দিন রাত কান্নাকাটি আর দোয়া দরুদ পড়ছেন তিনি।

কান্নাজড়িত কণ্ঠে অসুস্থ্য আলেয়া বেগম জানান, তার ছেলে ও জামাতাকে গ্রামের আবদুল মোন্নাফের ছেলে লিবিয়া প্রবাসী মিজানুর রহমানের মাধ্যমে লিবিয়ায় পাঠানো হয়েছে। তার অভিযোগ এই অপহরণের সঙ্গে মিজানুর জড়িত আছেন। মিজানুরের লোকজন অপহরণ করে অজ্ঞাত স্থানে আটকে রেখে মুক্তিপণের টাকা দাবি করছেন।

‘এখন এই টাকা কই পাব, কেমনে জোগাড় করব? আমরা অনেক অভাবে আছি। টাকা না দিলে ওরা তো মারি ফেলাইবে’- বলেই উচ্চস্বরে কেঁদে ফেলেন তিনি।

এদিকে সাংবাদিকদের আসার খবর শোনে লালমনিরহাটের পঞ্চগ্রাম ইউনিয়নের রামরাম গ্রামে জড়ো হন লিবিয়ায় অপহরণের শিকার চার শ্রমিকের পরিবারের সদস্যরা। সেখানে এক হৃদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়।

জানা যায়, স্বামী অপহরণের শিকার হওয়ার পর থেকে জয়নাল আবেদিনের মেয়ে জয়নব বেগম (৩৫) বাবার বাড়িতে আছেন। পাশের রাজারহাটের ঘড়িয়ালডাঙায় তার শ্বশুরবাড়ি। শ্বশুরবাড়ি থেকে তাকে বলা হয়েছে, স্বামীকে অপহরণকারীদের কাছ থেকে ছাড়াতে না পারলে যেন স্বামীর বাড়িতেই না ফিরি।

গৃহবধূ জয়নব জানান, ‘আমার স্বামী আমার ভাই আল আমিনের সঙ্গে লিবিয়ায় গেছে। এখন সেখানে অপহরণের শিকার হওয়ায় আমার শ্বশুরবাড়ির লোকজন স্বামীকে খুঁজে বের করে দেশে আনার পর শ্বশুরবাড়িতে যেতে বলেছে। আমার দুইটা মেয়ে, আমার সংসার বোধ হয় নষ্ট হয়ে গেল। স্বামীক ফিরে না পাইলে আমার কপাল পুড়বে।

অপরদিকে পঞ্চগ্রামের পাশেই কুড়িগ্রামের রাজারহাট উপজেলার ভীম শর্মা গ্রাম। এই গ্রামে আল আমিন নামে আরেকজন দুই বছর আগে লিবিয়ায় পাড়ি জমায়। আল আমিনের বড় ভাই লিটন মিয়া (২৩) জানান, গত ১১ মার্চ সকালে একটি নম্বর থেকে ফোন করে জানানো হয়, আমার ভাই আল আমিন, খালাতো ভাই রাকিবুল, সিন্দুরিয়া গ্রামের আরেক আল আমিন, তার ভগ্নিপতি হাফিজুলকে অপহরণ করা হয়েছে। তাদেরকে জীবিত দেখতে চাইলে জনপ্রতি পাঁচ লাখ টাকা করে মুক্তিপণ দিতে হবে। পুলিশকে জানালে তাদের হত্যা করে লাশ গুম করে ফেলার হুমকি দেওয়া হয়।

লিটন অভিযোগ করে বলেন, এর পেছনে পঞ্চগ্রামের সিন্দুরিয়া গ্রামের আবদুল মোন্নাফের লিবিয়াপ্রবাসী ছেলে মিজানুর রহমান, একই ইউনিয়নের রামরাম গ্রামের সামসুল হকের ছেলে লিবিয়াপ্রবাসী মো. নাজমুল হুদা (২৩) এবং একই গ্রামের আবু বক্কর সিদ্দিকের ছেলে লিবিয়া প্রবাসী মো. সুলতান (৩২) জড়িত আছেন। তিনি লালমনিরহাট সদর থানায় পৃথক অভিযোগ দিয়েছেন বলে তিনি জানান। এদিকে জয়নাল আবেদিনও থানায় লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন।

লালমনিরহাট পঞ্চগ্রাম ইউনিয়নের সিন্দুরিয়া গ্রামের মৃত কাশেম আলীর ছেলে অভিযুক্ত আবদুল মোন্নাফের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি এসব অভিযোগ অকপটে অস্বীকার করেন। তিনি বলেন, ঈর্ষান্বিত হয়ে তারা এসব মিথ্যা কথা বলছেন। তবে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান, তিনিও শুনেছেন, গ্রামের কয়েকজন লিবিয়ায় অপহরণের শিকার হয়েছেন।

এ ব্যাপারে লালমনিরহাট সদর থানার উপপরিদর্শক (এসআই) মো. রুহুল আমিন জামান, ‘লিবিয়ায় মুক্তিপণের জন্য শ্রমিকদের অপহরণের বিষয়ে দুটি পৃথক লিখিত অভিযোগ পেয়েছি। অভিযোগ তদন্ত চলছে। দ্রুত পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

২৩ মাস পর গ্যাস সংযোগ পেল যমুনা সার কারখানা

কাপড়ের মার্কেটে ভয়াবহ আগুন

সুখবর পেলেন মহিলা দলের নেত্রী পাপিয়া

কিডনির রোগ নিয়ে প্রচলিত ১৭ ভুল ধারণা, সত্যতা জেনে নিন এখনই

শেখ হাসিনার স্বর্ণ নিয়ে যে তথ্য দিলেন দুদক মহাপরিচালক

ভূমিকম্প পরবর্তী পরিস্থিতিতে জবি শিক্ষার্থী সংসদ নির্বাচনে ডোপ টেস্ট স্থগিত

স্বর্ণের দামে বড় লাফ, দুই সপ্তাহে সর্বোচ্চ

ভর্তি ফি কমানোর দাবিতে চবিতে অবস্থান কর্মসূচি

হরিণের মাথা-পা-মাংস ও ফাঁদসহ শিকারি আটক

প্রসূতির মরদেহ রেখে পালানো সেই ক্লিনিক সিলগালা

১০

‘মিস ইউনিভার্স’ মালিকের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি

১১

দেশের সব কলেজকে ‘অতীব জরুরি’ নির্দেশনা

১২

মালয়েশিয়ায় যথাযোগ্য মর্যাদায় সশস্ত্র বাহিনী দিবস উদযাপন

১৩

৪৭তম বিসিএস : এক দিন আগে পরীক্ষা বর্জনের ঘোষণা

১৪

মাদক ও সন্ত্রাসমুক্ত শিক্ষাঙ্গন গড়তে হবে : ড. কাইয়ুম

১৫

শীতের সকালে নদীতে ভাবনা

১৬

আন্তর্জাতিক রচনা প্রতিযোগিতায় তিন বাংলাদেশি শিক্ষার্থীর সাফল্য

১৭

বাউলদের ওপর হামলা উগ্র ধর্মান্ধদের কাণ্ড : মির্জা ফখরুল

১৮

হাসিনা-কামালের মৃত্যুদণ্ডের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ

১৯

ইতালিতে এক বাংলাদেশি গ্রেপ্তার

২০
X