বোরো ফসলের মাঠে এখন পাকা ধানের সোনালি হাসি। উজ্জ্বল রোদে সেই হাসি আরও ঝলমল করে উঠছে। অনেক মাঠেই কাস্তে নিয়ে ধান কাটার উৎসবে নেমে পড়েছেন কৃষক। আবহাওয়া ও পরিবেশ অনুকূল থাকায় এবারো ধানের ফলন ভালো হয়েছে। এতে কৃষকের মন ভরছে ঠিকই। কিন্তু বেশিক্ষণ তাদের পক্ষে সেই খুশি ধরে রাখা সম্ভব হচ্ছে না। কারণ, তাদের উৎপাদন খরচ উঠবে কিনা তা নিয়ে শঙ্কা দেখা দিয়েছে। এ জন্য কৃষক যাতে ধানের ন্যায্যমূল্য পায়, তা নিশ্চিত করতে সরকারের সুদৃষ্টি কামনা করেছেন কৃষকরা।
মাঠ পর্যায়ে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বগুড়ার তিনটি উপজেলায় বোরো ধান কাটা মাড়াই শুরু হয়েছে। অপেক্ষাকৃত নিচু জমিগুলো থেকে ধান কাটা শুরু করেছে কৃষক। তবে কৃষি বিভাগ বলছে, পুরোদমে ধানকাটা মাড়াই শুরু করতে আরও দিন দশেক লাগবে।
জেলার বিভিন্ন উপজেলার বোরো ধানের মাঠ ঘুরে দেখা যায়, প্রায় বোরো জমির ধান পেকে সোনালি রঙে শোভা ছড়িয়েছে। পাকা ধান কাটায় ব্যস্ত কৃষক-শ্রমিক। শ্রমিকের পাশাপাশি ধান কাটায় ব্যবহার হচ্ছে আধুনিক যন্ত্র কম্বাইন্ড হারভেস্টার মেশিন ও রিপার মেশিন।
বগুড়া জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সহকারী কৃষি কর্মকতা ফবিদুর রহমান ফরিদ জানান, চলতি মৌসুমে জেলায় ১ লাখ ৮৭ হাজার ১১০ হেক্টর জমিতে বোরো চাষের লক্ষমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। আর উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৭ লাখ ৮৯ হাজার ৪৩২ টন। বগুড়ায় এ পর্যন্ত ধান কাটার উপযোগী হয়েছে ২ থেকে ৩ শতাংশ। বৈশাখের শেষ সপ্তাহে পুরোদমে ধান কাটা শুরু হবে।
কৃষকরা জানান, এবার প্রতি বিঘা বোরো চাষে সাড়ে ১২ হাজার থেকে প্রায় ১৩ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। তবে এবার উৎপাদন ভালো হয়েছে। কিন্তু উৎপাদন খরচ তোলা নিয়ে চিন্তা এখনো কাটেনি। এলাকায় শ্রমিক সংকট রয়েছে। এখনো দেশের অন্যান্য স্থান থেকে শ্রমিকরা এসে পৌঁছাননি। আবার শ্রমিক পেলেও দিতে হচ্ছে অতিরিক্ত মজুরি। সবে মাত্র জেলার সারিয়াকান্দি উপজেলার বেশ কয়েকটি চরে, সোনাতলা ও নন্দীগ্রাম উপজেলায় ধান কেটে ঘরে তুলতে শুরু করেছে কৃষক।
নন্দীগ্রাম উপজেলার কাথম গ্রামের কৃষক জোব্বার প্রামানিক জানান, তার প্রতি বিঘায় ১৩ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। তিনি এবার ১১ বিঘা জমি চাষ করেছেন। তার হিসাবে, এক বিঘা জমিতে বীজ বাবদ খরচ হয়েছে ৩০০ টাকা, হাল চাষ ৮০০ টাকা, ধানের চারা লাগানো বাবদ ১৩০০ টাকা, পানি সেচ দেওয়া বাবদ ১ হাজার ৬০০ টাকা, সার বাবদ ৩ হাজার টাকা, কীটনাশক ও পরিচর্যায় ১৫০০ টাকা এবং ধান কাটা বাবদ খরচ ৪ হাজার ৫০০ টাকা।
তিনি বলেন, যদি আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে আশানুরূপ ধানের ফলন ঘরে তোলা সম্ভব হবে। সে হিসাবে বিঘা প্রতি ২০ থেকে ২৩ মণ ধান হতে পারে। আর প্রকৃতি যদি বিরূপ আচরণ করে সে ক্ষেত্রে কী হবে তা সৃষ্টিকর্তাই ভালো জানেন।
তিনি আরও বলেন, কৃষকের সবকিছু নির্ভর করবে ধানের বাজারমূল্যের ওপর। ভালো ফলনের পাশাপাশি বাজারমূল্য সন্তোষজনক হলে উৎপাদন খরচ উঠবে। আর তা নাহলে কৃষকরা লোকসানে পড়বেন। তবে এবার ধান কাটার শুরুতেই ধানের দাম ভালো পেয়ে কৃষকরা খুশি।
তেঘর গ্রামের কৃষক ইসমাঈল হোসেন বলেন, ‘এবার আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় বোরো ধানের ফলন ভালো হয়েছে। এরই মধ্যে ধান পেকেছে, কাটাও শুরু হয়েছে। এক হাজার ৪২০ টাকা মণ দরে ধান বিক্রি হচ্ছে। দাম ভালো পেয়ে কৃষকরা খুশি। আর কয়েক দিন আবহাওয়া ভালো থাকলে সুন্দরমতো ধান ঘরে তোলা সম্ভব হবে। আগামী সপ্তাহ থেকে নন্দীগ্রাম উপজেলাজুড়ে বোরো ধান কাটা পুরোদমে শুরু হয়ে যাবে।’
নন্দীগ্রাম উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা গাজিউল হক বলেন, নন্দীগ্রাম উপজেলার ১৯ হাজার ৮২৩ হেক্টর জমিতে বোরো ধানের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। আগাম জাতের বোরো ধান কাটা শুরু হয়েছে। তবে আগামী সপ্তাহ থেকে পুরোদমে বোরো কাটা শুরু হয়ে যাবে। এবার ধানের ফলন ও দাম পেয়ে কৃষকরা খুশি।
বগুড়া জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মতলুবর রহমান জানান, বগুড়ার ১২ উপজেলায় চলতি মৌসুমে ১ লাখ ৮৭ হাজার ১১০ হেক্টর জমিতে বোরো চাষ করা হয়েছে। প্রতিকূল আবহাওয়া সহায়ক ধানের জাত নির্বাচন আর কৃষকদের আধুনিক কলাকৌশল প্রদান করায় এবার লক্ষ্যমাত্রার চেয়েও বেশি ফলন হয়েছে। জেলার কিছু কিছু স্থানে বোরো ধান কাটা-মাড়াই শুরু হয়েছে। আশা করছি কৃষকরা তাদের ন্যায্যমূল্য পাবেন। এবারও বগুড়ার বোরো ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে।
বগুড়ার জেলা প্রসাশক সাইফুল ইসলাম জানান, এবার সার ও সেচের কোনো ঘাটতি না থাকায় বগুড়ায় বোরো ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে। জেলা প্রশাসন থেকে মনিটরিং করা হচ্ছে যাতে কৃষকরা ধান বিক্রিতে সঠিক দাম পান। সে বিষয়ে জেলার সকল উপজেলায় নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। ধান কেনাবেচায় কোনো প্রকার অনিয়ম করলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
মন্তব্য করুন