গত দু’সপ্তাহ ধরে যশোরসহ খুলনা বিভাগের ওপর দিয়ে অতিতীব্র তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে এ বিভাগের যশোর ও চুয়াডাঙ্গায় মৌসুমের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা বিরাজ করছে। এ অবস্থায় সর্বত্র গাছ লাগানোর জন্য জোর তাগিদ দেওয়া হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতেও ৩ হাজার গাছ কাটতে একাট্টা যশোর জেলা পরিষদ ও বন বিভাগ।
গত ছয় বছরে সড়ক, মহাসড়ক উন্নয়নের জন্য প্রায় ১৪ কোটি টাকা মূল্যের ৪ হাজার ২শ গাছ কেটেছে যশোর জেলা পরিষদ। বর্তমানে যশোর নড়াইল সড়কে ৪ কোটি ৪০ লাখ টাকা মূল্যের ৯৬১টি গাছ কাটা চলমান। এ ছাড়া যশোর সামাজিক বন বিভাগ সম্প্রতি ২ হাজার ৪৪টি গাছ কাটার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এটা নিয়ে প্রতিবাদ জানিয়েছে সামাজিক সংগঠনগুলো।
গত ২৫ এপ্রিল দুটি পত্রিকায় দরপত্র বিজ্ঞপ্তি দিয়ে ২ হাজার ৪৪টি বড় গাছ কাটার সিদ্ধান্ত নেয় যশোর সামাজিক বন বিভাগ। দরপত্র বিজ্ঞাপনে স্বাক্ষর করেন বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মো. আবুল কালাম। দরপত্রে উল্লেখিত এসব গাছের মধ্যে রেইনট্রি, বকাইন, মেহগনি, সেগুন, বাবলা, খৈয়েবাবলাসহ বিভিন্ন ধরনের গাছ রয়েছে।
বন বিভাগের এমন সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানিয়ে গাছ কাটার সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসার আহবান জানিয়েছে যশোর রোড উন্নয়ন ও শতবর্ষী গাছ রক্ষা কমিটি। কমিটির আহ্বায়ক খন্দকার আজিজুল হক ও সদস্যসচিব জিল্লুর রহমান ভিটু গণমাধ্যমের কাছে এক বিবৃতি পাঠিয়েছেন।
ওই বিবৃতিতে তারা বলেন, আমরা গভীর উদ্বেগ ও ক্ষোভের সঙ্গে লক্ষ্য করলাম বন বিভাগ সামাজিক বনায়নের গাছ সদর উপজেলার নরেন্দ্রপুর হতে আন্দুলিয়া পর্যন্ত ২৪৩টি বর্ষীয়ান বৃক্ষ, চাঁচড়া থেকে ভাতুড়িয়া, সাড়াপোল, তেতুলিয়া পর্যন্ত ৯৭৯টি বর্ষীয়ান বৃক্ষ, কেশবপুর উপজেলার বড়েঙ্গা বাজার থেকে পাচারই পর্যন্ত ৫০২টা, বাঘারপাড়া উপজেলার দোহাখোলা থেকে তালবাড়ীয়া পর্যন্ত ৩১০টি বৃক্ষ বিক্রয়ের দরপত্র আহ্বান করেছে।
বিবৃতিতে আরও বলেন, আমরা বন বিভাগের এই অপরিণামদর্শী উদ্যোগের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাচ্ছি। অবিলম্বে বন বিভাগের দরপত্র আহ্বান বাতিল করার দাবি জানাচ্ছি। একই সঙ্গে পরিবেশ বিধ্বংসী, গাছ বিধ্বংসীদের বিরুদ্ধে সচেতন মানুষকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানাচ্ছি । সঙ্গে শহরের বেজপাড়া এলাকার কবরস্থানের গাছ নিধনকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানাচ্ছি।
যশোরের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মো. আবুল কালাম বলেন, আমার যা বলার তা লিখিতভাবে পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে বলে দিয়েছি। এর বাইরে আর কিছু বলার নেই।
বিভিন্ন সংগঠন ও ব্যক্তির প্রতিবাদের বিষয়ে তিনি বলেন, দু’একটি সংগঠন তাদের কথা বলতেই পারে। গাছ কাটার তপশিল প্রকাশ করা হয়েছে। সেখান থেকে পিছিয়ে আসার আপাতত কোনো সুযোগ নেই।
সম্প্রতি যশোর শহরের বেজপাড়া কবরস্থানের ৫০টি গাছ বিক্রি নিয়ে প্রতিবাদ জানায় সচেতন যশোরবাসী। অভিযোগ ছিল, কবরস্থান কমিটির সদস্যরা কোনো সরকারি দপ্তরের অনুমতি না নিয়েই ১ লাখ ৭০ হাজার টাকায় ৫০টি ছোটবড় গাছ বিক্রি করে দেয়।
যশোরে অতিতীব্র দাবদাহের মধ্যে উঠে এসেছে যশোর জেলা পরিষদের বিগত কয়েক বছরে ৪ হাজারের বেশি গাছ কাটার বিষয়। এ সময়ের মধ্যে তারা নতুন কোনো গাছ লাগায়নি। সংশ্লিষ্টরা বলছে কয় লেন রাস্তা হবে সেটা চূড়ান্ত না হওয়ায় ইচ্ছামতো তারা গাছ লাগাতে পারছে না। এমনকি তাদের গাছ লাগানোর কোনো নির্দেশনাও নেই।
জেলা পরিষদের তথ্যমতে, গত ৬ বছরে চারটি সড়কের পাশ থেকে তাদের মালিকানাধীন ১৪ কোটি টাকা মূল্যের ৪ হাজার ২১০টি গাছ কাটা হয়েছে। এর মধ্যে ২০১৮ সালে ১ হাজার ৮৯৫টি গাছ কাটা হয়েছে যশোর-খুলনা মহাসড়ক উন্নয়নের সময়। যার বিক্রয় মূল্য ছিল চার কোটি ২১ লাখ টাকা। ২০২১ সালে যশোর-ঝিনাইদহ সড়কের হৈবতপুর ব্রিজ এলাকা থেকে ৬ লাখ ৬২ হাজার টাকা মূল্যের ১২টি গাছ কাটা হয়।
সে বছর যশোর-ঝিনাইদহ মহাসড়কে ৮৩৫টি গাছ কাটা হয়। যার মূল্য দুই কোটি ১৫ লাখ টাকা। এ ছাড়া ২০২২ সালে যশোরের রাজারহাট থেকে চুকনগর মহাসড়কে ৫০৭টি গাছ কাটা হয়। যার মূল্য ছিল এক কোটি ৫৭ লাখ টাকা। বর্তমানে যশোর-নড়াইল সড়কে চার কোটি ৪০ লাখ টাকা মূল্যের ৯৬১টি গাছ কাটা চলমান।
এ ছাড়া ঐতিহাসিক যশোর রোডের (যশোর-বেনাপোল মহাসড়কের) শতবর্ষী রেইনট্রি গাছসহ অন্যান্য গাছ বিক্রির উদ্দেশ্য তালিকাভুক্ত করেছে ৬৯৭টি। তবে ঐতিহাসিক যশোর রোডের এই শতবর্ষী গাছ না কাটার জন্য পরিবেশবাদীদের আন্দোলন ও হাইকোর্টে নিষেধাজ্ঞা থাকায় আপাতত গাছ কাটছে না জেলা পরিষদ।
যশোর রোড উন্নয়ন ও শতবর্ষী গাছ রক্ষা কমিটির সদস্য সচিব জিল্লুর রহমান ভিটু বলেন, সড়কের উন্নয়নের জন্য গাছ রেখেও পার্শ্ববর্তী দেশে উন্নয়ন চলছে। কিন্তু জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান অপরিকল্পিতভাবে গাছ কেটে সাবাড় করেছেন। হাজার হাজার গাছ কাটলেও তিনি কখনো গাছ লাগাননি।
যশোর জেলা পরিষদের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আছাদুজ্জামান জানান, যৌক্তিক কারণ ছাড়া গাছ কাটার সুযোগ নেই। মহাসড়ক সম্প্রসারণ ও উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য সড়ক ও জনপথ বিভাগের পক্ষ থেকে জেলা পরিষদকে গাছ অপসারণের জন্য চিঠি দেওয়া হয়। সেই চিঠির আলোকে জেলা উন্নয়ন সমন্বয় কমিটি ও বিভাগীয় কমিশনারের অনুমোদন দেয়। এরপরেই গাছ কাটার দরপত্র আহবান করা হয়। গাছ বিক্রির টাকা সরাসরি সরকারি কোষাগারে জমা হয়।
মন্তব্য করুন