চোখের সামনেই পুড়ে-ফেটে-বিবর্ণ কোটি কোটি টাকার স্বপ্নের লিচু। লিচুর রাজধানী বলে খ্যাত ঈশ্বরদীতে দেশি (আঁটি) লিচুতে সর্বনাশের পর বাগানগুলোতে বোম্বাই লিচু লাল টকটকে রঙিন হওয়ার কথা। কিন্তু বাদ সেজেছে প্রকৃতি।
শত শত বাগানের লিচু চাষিদের কোটি কোটি টাকা উপার্জনের রঙিন স্বপ্ন প্রকৃতির রুদ্র তাপে ধূলোয় মিশিয়ে দিয়েছে।
সুস্বাদু ও রসাল লিচু উৎপাদনের জন্য খ্যাত ঈশ্বরদীতে বৈশাখের মাঝামাঝিতে গাছে মুকুল আসে এবং চৈত্র মাসে মুকুল থেকে লিচুর সবুজ গুটি বের হয়। এ বছর প্রতিটি গাছে রেকর্ড পরিমাণ মুকুল এসেছিল। মুকুল থেকে গুটিও বেশ ভালোভাবে বের হয়েছে। চাষিরা এবারে লিচুর ভালো ফলনের আশায় বুক বেঁধেছিলেন। কিন্তু গত ২৮ মার্চ থেকে টানা মাঝারি ও তীব্র দাবদাহে লিচুর গুটি ঝরে পড়তে শুরু করে।
এখন বোম্বাই লিচু পেকে হলুদ ও লাল টকটকে হয়ে বাজারে আসার কথা। কিন্তু তীব্র খরায় লিচুর ওপরের আবরণ কালচে হয়ে ফেটে যাচ্ছে। এবারে আকারও হয়েছে ছোট, স্বাদও তুলনামূলক কম। এ অবস্থায় জয়নগরের শিমুল তলায় লিচুর মোকামে বিবর্ণ কালচে দাগের লিচু কেনার খরিদ্দার নেই। ২০০০-২৫০০ টাকা দামের এক হাজার লিচু বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার থেকে ১২শ টাকায়।
সরেজমিনে লিচু বাগানগুলো ঘুরে দেখা যায়, টানা দাবদাহে লিচুর গায়ে কালচে ও তামাটে রং ধারণ করেছে। গাছেই ফেটে যাচ্ছে এবং ঝরে পড়ছে লিচু। প্রতিটি ২-৩ টাকা দামের কৃষকের স্বপ্নের লিচু মাটিতে পড়ে লুটোপুটি খাচ্ছে।
কৃষকরা জানান, বৈরী পরিস্থিতিতে ঈশ্বরদীতে লিচু চাষে চরম বিপর্যয় ঘটেছে। লিচুতে উপার্জিত আয়ের ওপর এলাকার বেশিরভাগ লিচু চাষির গোটা বছরের সংসার নির্ভরশীল।
কৃষি অফিসের তথ্য অনুযায়ী, ঈশ্বরদীতে তিন হাজার ১০০ হেক্টর জমিতে লিচুর বাগান রয়েছে। উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করা হয়েছে ৩১ হাজার টন। মৌসুমে প্রতি বছরই ঈশ্বরদীতে কমবেশি প্রায় ৫শ কোটি টাকার লিচুর উৎপাদন হয়। এবারে মুকুল ও গুটি দেখে ধারণা করা হয়েছিল লিচু থেকে ৭শ কোটি টাকা লেনদেন হতে পারে। কিন্তু প্রকৃতির বিরূপ আচরণ ও তীব্র দাবদাহের কবলে পড়ে লিচুর বিপর্যয়ে হতাশাগ্রস্ত কৃষি বিভাগ ও লিচু চাষিরা।
অসহনীয় তাপপ্রবাহ হতে লিচু রক্ষার জন্য সচ্ছল লিচু চাষিরা প্রতিদিনই গাছে স্প্রে মেশিনের সাহায্যে পানি দিয়েছে। কিন্তু তাতেও তেমন কাজ হয়নি। এতে কেউ কেউ কিছুটা রক্ষা পেলেও যাদের সামর্থ্য নেই তাদের চরম বিপর্যয় ঘটেছে।
মিরকামারি গ্রামের লিচু চাষি শাহমত মন্ডল বলেন, আমার ৫০-৬০টি লিচুগাছ রয়েছে। এরইমধ্যে ২০-৩০টি গাছের লিচুতে ফাটল ধরেছে ও বিবর্ণ হয়ে গেছে। পাইকাররা এই লিচুর দাম পর্যন্ত বলছে না।
লিচু ব্যবসায়ী আলম মন্ডল বলেন, লিচু ফেটে যাওয়ার পাশাপাশি কালচে স্পট পড়েছে। খরিদ্দাররা টাকা দিয়ে দাগপড়া লিচু কিনতে চায় না। অনেক ব্যবসায়ী গুটি দেখে বাগান কিনেছেন। এই অবস্থায় বহু লিচু ব্যবসায়ী নিঃস্ব হয়ে যাবে।
জাতীয় পদকপ্রাপ্ত লিচু চাষি কিতাব মন্ডল বলেন, এবার খরা ও অনাবৃষ্টিতে লিচু আকারে ছোট হয়েছে। বোম্বাই লিচুর গায়ে কালচে স্পট পড়ে বিবর্ণ হয়েছে। কৃষকের স্বপ্ন প্রকৃতির রুদ্র তাপে ধূলোয় মিশে গেছে।
ঈশ্বরদীতে এবারে ৩ হাজার ১০০ হেক্টরের বেশি জমিতে লিচুর আবাদ হয়েছে জানিয়ে উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মিতা সরকার বলেন, মাসাধিক সময়ের তীব্র তাপপ্রবাহের কারণে গুটি ঝরে যাওয়ায় ভালো ফলন না হওয়ার শঙ্কা রয়েছে কৃষকের মনে। এই পরিস্থিতিতে ফলের মান ধরে রাখতে ২৫ মে থেকে বাজারজাতকরণের জন্য পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল।
মন্তব্য করুন