ঢাকা ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ নির্বাচনের ফলাফলে ছাত্রদলের মতো ভরাডুবি হয়েছে বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদেরও (বাগছাস)। এক বছর আগে যে তরুণদের নেতৃত্বে শেখ হাসিনা সরকারের পতন হয়েছে, মাত্র এক বছরের ব্যবধানে সেই নেতৃত্বের একটা বড় অংশ কেন এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হলো— সেই প্রশ্নও সামনে আসছে।
গত বছর আগস্টে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকেই দেশের বিভিন্ন ক্যাম্পাসে ছাত্র সংসদ নির্বাচনের দাবিতে সবচেয়ে বেশি সরব ছিলেন বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থী ও গণঅভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দেওয়া শিক্ষার্থীরা। যে কারণে অনেকের ধারণা ছিল, বৈষ্যমবিরোধী ছাত্র আন্দোলন বা বাগছাস প্যানেলের প্রার্থীরাই ডাকসু-জাকসুসহ বিভিন্ন ছাত্র সংসদে ভালো ফলাফল পেতে পারে। এই নির্বাচনে জয়ের ফলাফল ঘরে তুলবে ছাত্রদের নতুন রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টি। কিন্তু ধারণার বিপরীত ভরাডুবির পর বিষয়টি নতুন করে ভাবাচ্ছে এনসিপিকে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক সদস্য সচিব ও বর্তমানে এনসিপির যুগ্ম সদস্য সচিব আরিফ সোহেল বলেছেন, যদি বাগছাস ঢাকা ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভালো ফল করতে পারতো, তার ইতিবাচক প্রভাব এনসিপির রাজনীতিতেও পড়তো। তবে তারা এটিও মনে করছেন, গণঅভ্যুত্থানের পর বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থীদের কিছু কিছু কর্মকাণ্ডের নেতিবাচক প্রভাব ছাত্র সংসদ নির্বাচনে পড়েছে। যে কারণে হতাশাজনক ফলাফল এসেছে ডাকসু কিংবা জাকসুতে।
বিশ্লেষকদের কেউ কেউ মনে করেন, দলীয় লেজুড়বৃত্তিক ছাত্ররাজনীতির কারণে ছাত্রদল এবং ‘কিংস পার্টি’ হিসেবে এনসিপির পরিচিতি তৈরি হওয়ার বিষয়টি বাগছাসের ফলাফলে প্রভাব ফেলেছে।
শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর ঢাকা ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদ নির্বাচন আয়োজনের জন্য সবচেয়ে বেশি সরব ছিল বাগছাস ও বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থীরা।
বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের নেতৃত্ব যারা দিয়েছে, তারা ছাত্র সংসদ নির্বাচনে চমক দেখাতে পারলে এনসিপির রাজনীতিতে ইতিবাচক সাড়া ফেলবে, এমন ধারণা এনসিপি নেতাদের মধ্যে শুরু থেকে ছিল। যে কারণে ক্যাম্পাসগুলোয় ছাত্র সংসদ নির্বাচনের দাবিতে যে সব আন্দোলন হয়েছে, সেখানে নেতৃত্বেও ছিলেন বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থীরা।
কিন্তু ডাকসুর নির্বাচনি প্রক্রিয়া শুরুর পর দেখা গেছে, বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থী ও এনসিপির কেউ কেউ আলাদা তিনটি প্যানেলে নির্বাচনে অংশ নিয়েছে। পরে সে বিরোধ মেটানোর চেষ্টা করলেও ডাকসুর কেন্দ্রীয় সংসদের কোনো পদেই জয় পায়নি বাগছাসের নেতৃত্বাধীন প্যানেল। অন্যদিকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় সংসদের (জাকসু) ছোট দুটি পদে জয় পেয়েছে বাগছাস প্যানেল। এমন ভরাডুবির পর এ নিয়ে অসন্তোষও কাজ করছে দলটির মধ্যে। ডাকসুতে বিভিন্ন পদে বাগছাস প্যানেলের প্রার্থীরা ভোটও পেয়েছেন অনেক কম। প্যানেলগত অবস্থানের দিক থেকেও সেটা চতুর্থ কিংবা পঞ্চম।
বড় দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদ নির্বাচনের এমন ফলাফলের কারণ হিসেবে নিজেদের সাংগঠনিক দুর্বলতা ও কিছু কিছু নেতাকর্মীর নেতিবাচক ইমেজকে দায়ী করছেন এনসিপির নেতারা।
এনসিপির যুগ্ম সদস্য সচিব আরিফুল ইসলাম আদীব বলেন, একে তো প্রস্তুতি নেওয়ার ঘাটতি ছিল। অন্যদিকে বাগছাসের সাংগঠনিক কাঠামোও ছিল দুর্বল। যে কারণে আশানুরূপ ফল পায়নি এনসিপি।
অন্যদিকে গণঅভ্যুত্থানের পর সরকারের উপদেষ্টা থেকে শুরু করে দেশের বিভিন্ন জায়গায় বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থীদের নেতিবাচক কর্মকাণ্ড প্রভাব ফেলেছে বলেও মনে করছেন দলটির নেতাদের কেউ কেউ।
এনসিপির যুগ্ম সদস্য সচিব আরিফ সোহেল বলেন. ‘আমাদের কেউ কেউ রাষ্ট্র পরিচালনার খুব কাছাকাছি চলে গিয়েছিল। তাদের অনভিজ্ঞতা, অক্ষমতা কিংবা তাদের নিয়ে মিডিয়া ট্রায়ালও হয়েছে। ফলে একটা বিতর্কিত ইমেজ তৈরি হয়েছে। যার প্রভাব পড়তে পারে এই নির্বাচনে।’
এর বাইরেও দেশের বিভিন্ন স্থানে চাঁদাবাজি কিংবা অন্যান্য নেতিবাচক কর্মকাণ্ডে এনসিপি নেতাদের কেউ কেউ জড়িয়েছেন। যার কারণে ছাত্রদের এই সংগঠনটির ভোটে প্রভাব পড়েছে বলেও দলটির নেতারা মনে করছেন।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমদ বলেন, আরও একটি কারণ আছে বাগছাসের এমন পরাজয়ের পেছনে। সেটি হলো, অনেকেই এনসিপিকে কিংস পার্টি মনে করে। আর শিক্ষার্থীরা সব সময় স্টাবিলিশমেন্টের বিপক্ষে, যে কারণে এই প্রভাবও পড়েছে তাদের নির্বাচনে।
এনসিপির অধিকাংশ নেতার মতে , রাজনৈতিক অভিজ্ঞতার অভাব, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের একপাক্ষিক আচরণ এবং প্রচারণায় কৌশলগত নানা ত্রুটি থাকলেও মূলত অভ্যন্তরীণ বিবাদ ও গ্রুপিংয়ের কারণেই বাগছাসের এমন ভরাডুবি হয়েছে।
সূত্র : বিবিসি বাংলা
মন্তব্য করুন