কাজ বন্ধের ব্যবস্থা করে দিবেন বলে ৩০ লাখ টাকা চাওয়ার অভিযোগ উঠেছে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) প্রকৌশল শাখার পূর্তনির্মাণ ও সংরক্ষণ বিভাগের উপপ্রধান প্রকৌশলী মো. আল মামুনের বিরুদ্ধে।
এ ছাড়াও তার বিরুদ্ধে টাকার বিনিময়ে বিল করিয়ে নেওয়াসহ নানা অভিযোগ করেছেন শেখ রেহানা হলের ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের সাইট প্রকৌশলী মো. আনোয়ার বিন আরাফাত (অডিও রেকর্ড সংরক্ষিত রয়েছে )।
এদিকে কাজের অনুকূল পরিবেশ চেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান প্রকৌশলী ববাবর একটি লিখিত অভিযোগও করেছেন প্রকৌশলী আরাফাত। তবে সম্পূর্ণ বিষয়টি মিথ্যা ও বানোয়াট বলে অস্বীকার করেছেন প্রকৌশলী আল মামুন।
জানা যায়, অধিকতর উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় বর্তমানে দুটি ছাত্রী হলের (শেখ হাসিনা এবং শেখ রেহানা) নির্মাণকাজ চলমান রয়েছে। হল দুটির জন্য আর্থিক বরাদ্দ ১০২ কোটি টাকা। কাজ শুরু করার জন্য ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানকে নির্দেশ দেওয়া হয় ২০২১ সালের ৭ ডিসেম্বর। ইতোমধ্যে শেখ রেহানা হলের পাইলিং কাজ শেষ হয়েছে।
মো. আনোয়ার বিন আরাফাতের সঙ্গে সরাসরি এ বিষয়ে কথা বললে তিনি জানান, মাহবুব ব্রাদার্স অ্যান্ড প্রাইভেট লিমিটেড এবং অনিক ট্রেডিং অ্যান্ড কন্সট্রাকশন লিমিটেড কোম্পানি দুটি মিলিতভাবে শেখ রেহানা হল নির্মাণের কাজ করছে। প্রকৌশলী আল মামুন আমাদের কাজকে সবসময় প্রশ্নবিদ্ধ করে কাজে বাধার সৃষ্টি করেছেন। হল নির্মাণের নির্দেশ এবং আর্থিক বরাদ্দের হিসাব ২০১৪ সাল অনুযায়ী হলেও বর্তমানে কাজ চলছে ২০২২-এর উপাদানসামগ্রীর বাড়তি দরদাম অনুযায়ী। তবুও আমরা কাজ করে যাচ্ছি। বর্তমান পরিস্থিতিতে কাজ বাতিলের কোনো সুযোগ নেই। লোকসান হলেও আমাদের কাজ চালিয়ে যেতে হবে। এমতাবস্থায় কাজ বন্ধ করার ব্যবস্থা করে দিবেন বলে ২০ থেকে ৩০ লাখ টাকা দাবি করেন প্রকৌশলী আল মামুন। তিনি আমাদের অ্যাকাউন্ট ম্যানেজারের কাছে প্রতি সপ্তাহের জন্যে ৫ হাজার টাকা দাবি করেন। তার কথা না মানায় চলমান কাজের দরপত্রের কাগজ ২১ দিন তার টেবিলে ফেলে রাখেন। বাধ্য হয়ে বিল করার জন্য টাকা দিতে হয়েছে তাকে। এ ছাড়া উপাদানসামগ্রীতে অপচয় ও খরচ বেশি হবে এরকম কাজ করেন তিনি।
তিনি আরও জানান, গত মাসের ২০ তারিখ চলমান কাজের ওপর একটি আলোচনা সভায় উপাচার্য, প্রকল্প পরিচালক, পরিকল্পনা ও উন্নয়ন শাখার অতিরিক্ত পরিচালক, প্রকল্পের টেকনিক্যাল ও মনিটরিং কমিটির সভাপতির উপস্থিতিতে মৌখিকভাবে আমি এই অভিযোগগুলো জানাই। পরে আমি প্রধান প্রকৌশলী বরাবর লিখিত অভিযোগ পাঠাই।
লিখিত অভিযোগসূত্রে জানা যায়, গত ২০ জুলাই সংশ্লিষ্ট কাজের সাইটে গঠিত কমিটির সদস্যরা পরিদর্শনকালে উল্লিখিত সাইটে নিয়োজিত ঠিকাদার ‘আর কোনো কাজ করবে না’ বলে কমিটিকে মৌখিকভাবে অভিযোগ করেন আল মামুন। এর প্রেক্ষিতে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের প্রকৌশলী আনোয়ার বিন আরাফাত তার অভিযোগ মিথ্যা ও ভিত্তিহীন বলে প্রতিবাদ করলে তিনি বাগ-বিতণ্ডে জড়িয়ে পড়েন। এ ছাড়াও তার বিরুদ্ধে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে কাজ করতে নিরুৎসাহিত করা, সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারের লোকজনের সাথে অসৌজন্যমূলক আচরণ করা এবং ঢালাই কাজ শেষে বেঁচে যাওয়া এক বস্তা সিমেন্ট শুধু পানিতে মিশ্রণ করে ফেলে দেওয়ারও অভিযোগ পাওয়া যায় লিখিত অভিযোগপত্রে।
অভিযোগের ব্যাপারে প্রকৌশলী মো. আল মামুন বলেন, আমার বিরুদ্ধে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান কর্তৃক আনীত সকল অভিযোগ বানোয়াট ও ভিত্তিহীন। আর্থিক লেনদেন বিষয়ে আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকলে গত ২১ আগস্ট আলোচনা সভায় তিনি বিষয়টি উত্থাপন করতে পারতেন। প্রকৌশল শাখা ও মনিটরিং শাখার উপস্থিতিতে একাধিক আলোচনা অনুষ্ঠিত হলেও তারা আমার বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগই জানাননি। বরং আমি তাদের বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির প্রতিবাদ করেছি জন্য তারা আমার ওপর ক্ষিপ্ত। ঢালাই কাজে সিইএম-১ ক্যাটাগরির সিমেন্ট ব্যবহার করার কথা থাকলেও তারা সিইএম-২ নিয়ে আসেন। ৩৩ নম্বর পাইলের ক্ষেত্রে ২০ মিলিমিটার ব্যাসের ৩টি এবং ১৬ মিলিমিটার ব্যাসের ৭টি রডের জায়গায় তারা যথাক্রমে ২টি এবং ৮টি রড দেন। এমনকি পাইলিং করার সময় একটি পাইলের রডের খাঁচা খুলে যাওয়ার পরেও ওরকম অবস্থাতেই কাজ চালিয়ে যেতে থাকেন। আমি এসব বিষয় আমার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনা করে পরবর্তীতে সমাধান করেছি। তাদের এ সকল অনৈতিক কর্মকাণ্ডের প্রমাণ ছবিসহ আমার কাছে আছে।
মামুন আরও বলেন, ঢালাই শেষে মিশ্রণ যন্ত্রে বালি ও পাথরের পরিমাণ তালিকায় বর্ণিত অনুপাতের চেয়ে বেশি দেওয়ায় আমি ওই অতিরিক্ত এক বস্তা সিমেন্ট বেশি যুক্ত করতে বলি।
এবিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৌশল শাখার প্রধান প্রকৌশলী মো. শাহীন ইসলাম খান বলেন- যে কোনো কাজের ক্ষেত্রে একে অপরের মতের অসামঞ্জস্যতা আসা স্বাভাবিক। ঠিকাদারের সাইট ইঞ্জিনিয়ার আমাদের কাছে যে লিখিত অভিযোগপত্রটি দিয়েছেন তার প্রেক্ষিতে প্রকৌশলী আল মামুনকে সতর্ক করা হয়েছে। তবে লিখিত অভিযোগে টাকা-পয়সা দাবি বা এরকম লেনদেনবিষয়ক কোনো কিছু বলা হয়নি।
অধিকতর উন্নয়ন প্রকল্পের পরিচালক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রবিষয়ক উপদেষ্টা অধ্যাপক মো. হারুন-অর-রশিদ বলেন, আমার কাছে ঠিকাদারের সাইট ইঞ্জিনিয়ারের করা লিখিত অভিযোগের একটি অনুলিপি এসেছে। সেখানে প্রকৌশল শাখার প্রকৌশলীর টাকা-পয়সা দাবি বা চাঁদাবাজির কোনো অভিযোগ দেওয়া হয়নি। ঠিকাদারের পক্ষ থেকে মৌখিকভাবেও আমাকে লেনদেনবিষয়ক কোনো অভিযোগ দেওয়া হয়নি।
মৌখিক অভিযোগের বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিকল্পনা ও উন্নয়ন শাখার অতিরিক্ত পরিচালক কৃষিবিদ মো. রবিউল ইসলাম বলেন, মৌখিক অভিযোগ আসলে ভিত্তিহীন। কোনোরকম লিখিত বা প্রতিষ্ঠিত প্রমাণ ছাড়া এরকম চাঁদাবাজির অভিযোগ গৃহীত হতে পারে না।
প্রকল্পের টেকনিক্যাল ও মনিটরিং কমিটির সভাপতি অধ্যাপক মো. এনামুল হক বলেন, অভিযোগের একটি অনুলিপি আমাকে পাঠানো হয়েছে। সেখানে টাকার কথা নেই। মনিটরিং কমিটির দায়িত্ব হচ্ছে কাজ হচ্ছে কি না সেটা দেখা। প্রকৌশলীদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে মনিটরিং কমিটির হস্তক্ষেপ নেই।
এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মো. এমদাদুল হক চৌধুরী বলেন, আমার জানামতে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের প্রকৌশলীর অভিযোগের ভিত্তিতে প্রকৌশলী আল মামুনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এব্যাপারে লেনদেনজনিত কোনো অভিযোগ আমার কাছে এখনও পর্যন্ত আসেনি। আমার কাছে অভিযোগ আসলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে। অনিয়ম বা দুর্নীতি করে কেউ ছাড় পাবে না।
এসময় মৌখিকভাবে লেনদেনের অভিযোগের ব্যাপারে তিনি বলেন, মৌখিক কথার ভিত্তিতে কখনই কোনো পদক্ষেপ নেওয়া যায় না। যে কোনো অভিযোগের পেছনে প্রতিষ্ঠিত প্রমাণ থাকতে হবে।
মন্তব্য করুন