আল মারুফ রাসেল
প্রকাশ : ২৭ জুন ২০২৩, ০৫:১৬ পিএম
আপডেট : ২৮ জুন ২০২৩, ০৯:০৫ এএম
অনলাইন সংস্করণ

মসলা পুরাণ

মডেল: আইরিন ইরানী; গহনা: স্বাক্ষর বাই নওরীন, মেকআপ: বিউটি রুম বাই আফরিনস। ছবি : রনি বাউল
মডেল: আইরিন ইরানী; গহনা: স্বাক্ষর বাই নওরীন, মেকআপ: বিউটি রুম বাই আফরিনস। ছবি : রনি বাউল

মাংস আর মসলা—একে অন্যের পরিপূরক। মসলা ছাড়া মাংস, এ দেশে বিরল। মাংস, সেটি লাল হোক বা সাদা—কিছু না কিছু মসলা পড়বেই। তাই মাংস-মসলার সম্পর্কের ইতিহাসে একটু ঘোরাঘুরি এবার। লিখেছেন আল মারুফ রাসেল

স্পাইসের বাংলা মসলা, হার্বসের বাংলা কী? ভেষজ বা ঔষধি? কে জানে! গাছের ডালপালা, শেকড়, ফলকে মসলা বলছি, বেচারা পাতা ব্রাত্য হয়ে, হয়ে গেল হার্ব—তথা ভেষজ বা ঔষধি, তাহলে মসলার কি সেই গুণ নেই? সে অনেক তর্ক-বিতর্কের কথা। আপাতত স্পাইস আর হার্ব বিতর্কে না গিয়ে জানা যাক মাংস-মসলার, সেইসঙ্গে রান্নার ভেষজ উপকরণের সম্পর্ক।

এই জটিল সম্পর্কের শুরু ঠিক কবে থেকে তা জানে না কেউ। ইতিহাস বলছে, আফ্রিকার হোমো হাবিলিস (যে মানুষরা পৃথিবীতে ছিল ২০ লাখ বছর আগে) প্রথম মাংসের স্বাদ নিয়েছিল। গবেষকদের দাবি, এ প্রাণিজ আমিষটাই নাকি সেই আদি মানুষকে বিবর্তিত করে আজকের মানুষে পরিণত করেছে। অনেক সমাজবিজ্ঞানী আবার এক কাঠি সরেস হয়ে বলেই ফেলেছেন, মাংস খাওয়ার অভ্যাসই মানুষকে পৃথিবীতে সাম্রাজ্য গড়তে সাহায্য করেছে; রীতিমতো গবেষণা করে তাই প্রমাণ করেছেন তারা। তাই ‘শাকসবজি’ আর ‘কলাটা-মূলাটার’ মানে ফলমূলের সঙ্গে যোগ হওয়া এই আমিষ ভোজন খাটো করে দেখার অবকাশ নেই। বরং মানবসভ্যতার চাকা পেছন দিকে ঠেলে দেওয়ার অপরাধে অভিযুক্ত হতে পারেন আপনি—মাংসে অরুচি থাকলে।

রসনার শাস্ত্রাধিকার পাওয়ার প্রথম ধাপ হলো মসলার তত্ত্ব ধরতে পারা—এ কথা আমার নয়, বাংলা রসনাশাস্ত্রের গুরু সৈয়দ মুজতবা আলীর। আর মসলা নিয়ে কত যুদ্ধ, বাণিজ্য, হানাহানি হয়েছে তা ইতিহাসের পাতায় লেখা আছে। খ্রিষ্টের মর্ত্যে আগমনের ১৭০০ বছর আগেও মসলার চল ছিল, তা আবিষ্কার করা হয়েছে সিরিয়ার একটি প্রত্নতাত্ত্বিক খননে পাওয়া রসুইঘরের নমুনা থেকে। সেটাই যে প্রথম মসলার ব্যবহার নয়, এ সম্পর্কেও নিশ্চিত এখনকার বিজ্ঞানীরা। কারণ, মিশরীয় সভ্যতায় খাবারে আর মৃত্যুর পর মৃতদেহ মমি করতেও প্রয়োজন হতো মসলার। সে গল্পও খ্রিষ্টপূর্ব ৩৫০০ বছর আগেকার। মধ্যপ্রাচ্য যে তারও ১৫০০ বছর আগে মসলার ব্যবহার করত, তারও প্রমাণ মিলেছে সম্প্রতি। মাংসে স্বাদ বাড়ানোর জন্য প্রথম লবণের ব্যবহার হয়েছিল প্রায় পাঁচ হাজার বছর আগে। অবশ্য জার্মানির নয়স্টাটের একটি প্রত্নস্থল থেকে পাওয়া ছয় হাজার বছর আগেকার মৃৎপাত্রের টুকরোয় লেগে থাকা হরিণের মাংসের অবশিষ্ট থেকে স্বাদবর্ধক হিসেবে আবিষ্কার করা হয়েছে লবণ আর গার্লিক-মাস্টার্ড।

এখন পৃথিবীতে বাণিজ্য-যুদ্ধের ক্ষেত্র যদি তেল-গ্যাস হয়, পৃথিবীর ইতিহাসের প্রাচীন মধ্যযুগের যুদ্ধ আর বাণিজ্য তাহলে শুধুই ছিল মসলার। এ মসলার খেই ধরে মধ্যপ্রাচ্য আর দক্ষিণ এশিয়ার সম্পর্ক হয় খ্রিষ্টের জন্মেরও ২০০০ বছর আগে। ভারত থেকে দক্ষিণ ভারতের কালো গোলমরিচ আর দারচিনি যেত মধ্যপ্রাচ্যে। ইন্দোনেশিয়ার জায়ফল ভারত হয়ে মধ্যপ্রাচ্যে যেত খ্রিষ্টের জন্মের ৬০০ বছর আগে। রামায়ণেও লবঙ্গের উল্লেখ রয়েছে, আবার খ্রিষ্টের জন্মের পর প্রথম শতকেই রোমানরাও জেনে গিয়েছিল লবঙ্গের ব্যবহার। ইন্দোনেশিয়ার ব্যবসায়ীরা চীন, ভারত, মধ্যপ্রাচ্য আর আফ্রিকার পূর্ব উপকূলে যেত মসলার বহর নিয়ে। আফ্রিকার পূর্ব উপকূলে যেতে এই বহরকে পার করতে হতো ভারত আর মিশরের আলেক্সান্দ্রিয়া। তাই ভারতের বেশ কয়েকটি বন্দর আর মিশরের আলেক্সান্দ্রিয়া প্রাচীনকাল থেকেই হয়ে উঠেছিল রমরমা। এরপর খ্রিষ্টের জন্মের প্রথম শতকেই সিল্ক রুটের আবিষ্কার প্রাচ্যের ব্যবসায়ীদের পশ্চিমে নিয়ে গেল। এভাবেই প্রাচীনকালে মসলার আদান-প্রদানে প্রাচ্য প্রতীচ্যেও ভেদাভেদ অনেকটাই ঘুচে গিয়েছিল—অন্তত মসলার কারণে। এমনকি মসলার আরবি প্রতিশব্দ ‘বাহারাত’! ভারত থেকে উৎপন্ন কি?

ভারতীয় উপমহাদেশে বৈদিক যুগে খাবারকে ভাবা হতো পবিত্র। তাতে থাকত অন্তর্নিহিত ভালোবাসা আর দেহ পবিত্র করার সব উপকরণ। আর সেই সুবাদে তাতে পড়ত মসলা। বৈদিক যুগের আগেকার সিন্ধু সভ্যতায় পাওয়া যায় প্রাণিজ আমিষ গ্রহণের প্রমাণ। সিন্ধু সভ্যতার সময়ে যে মসলা রপ্তানি হতো, তা আগেই বলা হয়েছে। তাই সিন্ধু সভ্যতার খাবারদাবারকে মোটেই অবহেলা করা যাবে না। এমনকি এখন জোর রব উঠেছে, ইংল্যান্ডের জাতীয় খাবার কারির জন্ম নাকি সিন্ধু সভ্যতার কোনো এক নগরেই।

বলা হয়, ভারতে বৈদিক যুগের শুরু হয় আর্যদের হাত ধরে, খ্রিষ্টপূর্ব ১৬০০ সাল নাগাদ। এই আর্যরা মাংস-মসলার যুগলবন্দি আরও ভালোমতো জানত। একদল যাযাবর মেষপালক ভোল্গার তীর থেকে পাঞ্জাবে এসে বসতি স্থাপন করে, আর দুটি দল যায় জার্মানি আর ইরানে। তাই জার্মান বা ইরানি খাবারে এখনো ‘হট অ্যান্ড স্পাইসি’ তকমাটা লেগে আছে। বলা হয় আর্য-অনার্য রন্ধনপ্রণালির মিথস্ক্রিয়ায় ভারতবর্ষে নতুন রন্ধন শিল্পের সূচনা হয়। খ্রিষ্টের জন্মেরও বহু আগে ভারতে তিলের চাষ করেছিল তারাই। হলুদ, এলাচ, গোলমরিচ, সরিষা খাদ্যতালিকায় যোগ করার পুরো কৃতিত্বই আর্যদের। বলা বাহুল্য, কোনো প্রাণীর মাংসেই অরুচি ছিল না আর্য গোষ্ঠীর মানুষদের।

মাংস আর মসলার যুগলবন্দির কথা অজানা ছিল না মঙ্গোলিয়ান জাতিগোষ্ঠীরও। যাযাবর মঙ্গোলিয়ান দলপতি চেঙ্গিস খানের দিগ্বিজয়ের কালে মঙ্গোলিয়ান আর আফগানরা এক হয়। তৈরি হয় আবারও খাবারের নতুন ধারা। যাযাবর মঙ্গোলিয়ানরা অভ্যস্ত ছিল অল্প মসলায় কয়লা বা আগুনে ঝলসানো মাংস আর জাউভাতে। আফগানিস্তানে এসে তাদের পরিচয় হয় শুকনো, ঝরঝরে, সুগন্ধি চালের। তবে মসলা যে সঙ্গে সঙ্গেই ঢোকেনি তার প্রমাণ মেলে আফগান তরিকার দো-গোশা পোলাওয়ে। তবে এখানে আসল গল্পটা মুঘলদের নিয়ে। তেল, মসলা, সুগন্ধি—তিনে মিলে যে অনবদ্য মুঘল খানা, তার শুরু কিন্তু চেঙ্গিস, তিমুরের হাত ধরে। বিরিয়ানির উৎপত্তি নাকি এ সেনাবাহিনীর হাতেই। বিশাল যাযাবর সৈন্য বাহিনীর জন্য বারবার গোটাখানেক পদ তৈরির বদলে একবারে খাবার তৈরির পন্থাই হলো বিরিয়ানি রান্নার ইতিহাস। মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা বাবর যখন ভারতে আসেন, সঙ্গে করে নিয়ে আসেন আফগান রান্নার এ পন্থাকে। সঙ্গে অবশ্য বাদাম, কিশমিশ, জাফরানসহ আরও কিছু মসলা এনেছিল তারা। এরপর দরকারি এসব খাবারে যোগ হলো ভারতীয় সব মসলা। এভাবেই ভারতে তৈরি হলো পুরো ফিউশন; কিন্তু অপ্রতিদ্বন্দ্বী রান্নার ধারা—মোগলাই। যার অথেনটিক স্বাদ এখন আর নেই, কালের গর্ভে হারিয়ে গেছে সব, তবে নামটা এখনো বহাল রয়েছে—মোগলাই খাবার। বহু রকমের কাবাব, বিরিয়ানি আর মাংসের ঝালকারির চল হয় এ সময়েই।

ভারতের গোয়া আর হুগলি অঞ্চলের খাবারে পর্তুগিজদের অবদান প্রচুর। ভারতে ভিন্দালু নামের যে খাবারটি সব জায়গায় প্রচলিত সেটি ‘কার্নো দ্য ভিলোস ই আলুস’-এর গোয়া সংস্করণ। তেজপাতা, পেঁয়াজ, রসুন, আদা, ধনিয়া, জিরা, হলুদ, সরিষা, পর্তুগিজ লাল মরিচ (পেরি পেরি), কাঁচামরিচ, শুকনা মরিচ দিয়ে অসাধারণ একটি খাবার এই ভিন্দালু। আমাদের চেনাজানা অনেক খাবারই পর্তুগিজ ঘরানা থেকে আসা। মূলত মাংস নিয়েই কারবার ছিল পর্তুগিজদের। আর এ মাংস রান্নার পাচক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হতো বাংলার বৌদ্ধ মগদের।

বাংলায় মুসলিম শাসন শুরু হওয়ার পরই এখানে খাদ্যাভ্যাস পাল্টাতে থাকে। তবে অনার্য চর্চায় অনেক আগে থেকেই ছিল মাংস-মসলার চল। প্রাচীনকাল থেকেই মাংস-মসলার তত্ত্ব জানত বাংলার অধিবাসীরা। মুসলিম শাসনের সময় গো-মাংসের চল হয় বাংলায়। আর এখনকার বহুল প্রচলিত কাঁচামরিচ আসে ঔপনিবেশিক পর্তুগিজদের হাত ধরে। এর আগে পুরো ভারত উপমহাদেশে মরিচ বলতে গোলমরিচ আর পিপুলকেই বোঝানো হতো। বাংলায় নতুন নতুন পদের মাংস প্রচলিত করার কৃতিত্ব অল্প হলেও দিতে হয় অযোধ্যার শেষ নবাব ওয়াজিদ আলী শাহর পাচকদের। অযোধ্যা থেকে যখন মাটিয়াবুরুজে নির্বাসন দেওয়া হলো নবাবকে, তখন তার সঙ্গে ছিল শত শত পাচক আর মসলার মিশ্রণকারী। নবাবের মৃত্যুর পরই বেকারত্বের হাত থেকে রক্ষা পেতে কলকাতার আশপাশে খাবারের দোকান খোলে তারা। ভুনা মাংস, চাপ, কোরমা ছাড়াও রেজালা, বিরিয়ানি আর কাবাবের কয়েকটি নতুন ধারা এ পাচক আর মসলা পিষনেওয়ালাদের অবদান।

ঔপনিবেশিক ঢাকায় গ্রিক আর আর্মেনীয় খাবারের প্রভাব পড়েছিল রান্নায়। পোলাওয়ের মধ্যে মাংসের কিমার কোফতা বা মাংসের টুকরা মিলিয়ে তাহেরি (অধুনা তেহারি) এ প্রভাবেরই পরিচয় বহন করছে আজও। সুবেদার ইসলাম খাঁর ঢাকা জয় করার আগেই আফগান-পাঠানরা ব্যবসায়িক কাজে ঢাকায় বসত গেড়েছিল। তবে মুঘলদের ঢাকা জয়ের পর আরও অভিজাত হয়ে উঠেছিল ঢাকাই খাবার, হাজার হোক রাজধানীর খাবার। কালের বিবর্তনে ইংরেজ ঢাকার নবাবরাও প্রভাবশালী হয়ে ওঠে। আর তাদের রসুইঘরে ঠাঁই হয় নায়েব নাজিমের পাচকের উত্তরসূরিদের। এদের মধ্যেও আবার অনেকে নবাবের রসুই ছেড়ে আবারও বাজারে খাবারের দোকান দিয়ে বসতে থাকে।

গ্লোবাল ক্যুইজিনে মাংস রান্নার ধরনকে মোটা দাগে চার ভাগে ভাগ করা যায়। ভূমধ্যসাগরীয়, এশীয়, ইউরোপীয় আর মার্কিনি। ভূমধ্যসাগরীয় খাবারে লেবুর আধিক্য থাকে, দারচিনি, বেদানা নিয়েই তাদের বেশিরভাগ কারবার। এর বাইরে অল স্পাইস, জিরা, এলাচ, গোলমরিচ, পেঁয়াজ আর রসুনের ব্যবহার দেখা যায়। অনেকেই ভারতীয় খাবারের সঙ্গে ভূমধ্যসাগরীয় খাবারের এক ধরন—আরব্য খাবারের ঠিক পার্থক্য খুঁজে পান না। পার্থক্যটা হলো মসলার ব্যবহারে। ভারতীয় খাবারের মতো এত মসলা আরব্য খাবারে অনুপস্থিত। আবার মরক্কোর ভেড়ার তাজিনে হলুদ, জিরা, জায়ফল, লবঙ্গ, দারচিনি, আদা আর গোলমরিচের ব্যবহারে যে কেউ ভুল করতে পারেন দক্ষিণ এশীয় খাবার ভেবে। এশিয়ার এই দক্ষিণ-পূর্বে মসলার ব্যবহারটা একটু বেশিই হয় আর এখানকার মানুষ সবকিছুই একটু ঝাল হলে ভালোবাসে। আবার যত পশ্চিমে যাওয়া হয়, ঝালের মাত্রা, মসলার মাত্রা কমতে থাকে। ইউরোপে কম মসলার খাবার চলে। আয়ারল্যান্ডের আইরিশ স্টু, ইংল্যান্ডের রোস্ট বিফ অথবা ফ্রেঞ্চ বিফ স্টুয়ের মসলার তালিকায় তাকালেই স্পষ্ট হয়।

গোটা ইউরোপে খানিকটা ঝাল খায় ফ্রান্স। রসুন, গোলমরিচ, তেজপাতা, পার্সলে, জোয়ান, লবঙ্গ, পেঁয়াজপাতা, ট্যারেগন, সরিষা ইত্যাদি মসলা মিলে তৈরি হয় ফরাসি বিফ স্টু। আইরিশ বিফ স্টু রসুন, জোয়ান, তেজপাতা, পেঁয়াজ, মরিচ আর পার্সলেতে সীমাবদ্ধ, তাও মসলা পরিমাণে বেশ কম ব্যবহার করা হয়। ইংল্যান্ডের রোস্ট বিফে মসলার সংখ্যা মাত্র দুটি। রসুন আর গোলমরিচ। আমেরিকার নিজস্ব কোনো ক্যুইজিন নেই। ধার করা ক্যুইজিন নিয়ে চলছে তারা। আর এ ধারায় রয়েছে বার্গার, স্টেকের মতো খাবার। বার্গারের প্যাটি তৈরিতে হয়তো খানিকটা পেঁয়াজ আর গোলমরিচের দেখা হতে পারে। আর যে স্টেকে দুনিয়া মাতোয়ারা, তার মেরিনেশন হয় মাত্র দুটো জিনিসে—গোলমরিচ আর নুনে। ভূমধ্যসাগরীয় এলাকায়ও অন্তত পাঁচ ধরনের মসলার মিক্স ব্যবহার করা হয়, যেমনটা আমরা করি—গরম মসলা মিক্স।

গ্লোবাল ক্যুইজিনের তুলনায় আমাদের খাবারের ধারা অনেক ধনী। আমাদের এখানে অনেক ধরনের প্রভাব আছে, আমরা সবই গ্রহণ করেছি, দক্ষিণাত্য থেকে আসা সেন, গরমশির থেকে আসা খলজি, দিল্লি থেকে আসা বলবান বুগরা খান, বিহারের ফরিদ খান শের শাহ, মুঘল শাহজাদাদের ছাড়াও পর্তুগিজ, ফরাসি, দিনেমার, ওলন্দাজ, ইংরেজদের খাবারের ধারাগুলো। পাশাপাশি চিরাচরিত রান্নার ধারাও কিন্তু বহাল ছিল স্বমহিমায়। বিভিন্ন ধরনের দেশি মসলার সঙ্গে যোগ হয় বণিকের সঙ্গে করে নিয়ে আসা বিদেশি মসলা। মালয়-জাভা থেকে আনা সুগন্ধি মসলা, দেশীয় ঔষধি ফলমূল মিলিয়ে তৈরি হয়েছিল দেশীয় ধারা। আর এ ধারায় এসে বদলাতে থাকে খাবারের রান্নার প্রণালি। আবার নিতান্তই দেশীয় মসলা ঘেঁটে নতুন নতুন পদও আসতে থাকে আঞ্চলিকভাবেই।

ঢাকায় এ ছাড়াও ছিল খালাসিদের খাবার। দূরের বাণিজ্য যাত্রায় শুকনো খাবার নিতে হতো তাদের। তাই অনেকটা ঝুরি মাংসের আদলে এক ধরনের খাবার তৈরি করে নিয়ে যেত তারা। পেঁয়াজ, কাঁচামরিচ, আদা, রসুন, গোলমরিচ, তেঁতুল আর তেজপাতার সঙ্গে সেখানে উপস্থিত থাকত জাফরান। এ জাফরানের ব্যবহারে নাকি শুকনো মাংস অক্ষত থাকত দিনের পর দিন। আবার জাফরান না পেলে ব্যবহার করা হতো কুসুম ফুল।

রীতিমতো মসলার আর স্বাদের রায়ট চট্টগ্রামের কালাভুনায়। মসলার বাড়াবাড়ি থাকলেও স্বাদের ক্ষতি নেই এখানে। উল্টো আরও মসলার বাড়াবাড়িতেই যেন খোলতাই হয় ইরানি তরিকার এ খাবারের। মগ আদিবাসীরা প্রথমে আরব বণিক জাহাজগুলোতে পাচকের চাকরি করত। ফলে নতুন নতুন মসলার ব্যবহার শিখে যায় তারা। এরপর আসে পর্তুগিজরা। চট্টগ্রাম, গোয়ার দখল নেয় তারা। তবে পাচক হিসেবে টিকে যায় মগরা। পর্তুগিজ-আরবদের মূল খাবারই মাংস। চট্টগ্রামে আরবদের সংস্পর্শে থেকে তারা পারস্যের খাবারের অনুকরণ করে তৈরি করে কালাভুনা। হলুদ, জিরা, ধনিয়া, পেঁয়াজ, রসুন, আদা, দারচিনি, এলাচ, কাঁচামরিচ, তেজপাতা দিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা চুলোয় রেখে মাংসকে প্রায় শুকনো আর কালো করে ফেলা হয় এই প্রক্রিয়ায়।

আর আঞ্চলিক রান্নার প্রসঙ্গে বলা যেতে পারে সিলেটের সাতকরা দিয়ে মাংসের রান্না। পুরো রান্নায় হয় ঘরোয়া মাংসের মসলা দিয়েই, তবে মাংস নামিয়ে নেওয়ার মিনিট দশেক আগে সাতকরা নামের লেবুর কয়েক টুকরো দিয়ে দিতে হয় অল্প আঁচে। আবার যশোর-খুলনার চুইঝালের কথা না বললেই নয়। চুইঝালের আদি নিবাস ইন্দো-বার্মিজ হটস্পট অর্থাৎ বান্দরবান থেকে শুরু করে মিয়ানমার হয়ে থাইল্যান্ড পর্যন্ত। কীভাবে এ ভেষজ উদ্ভিদ যশোর এলাকায় এলো তা বলা মুশকিল। তবে ধারণা করা যেতে পারে, পর্তুগিজরা যখন আরাকানিদের সঙ্গে নিয়ে সুন্দরবনে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল, তখনই এ গাছ চলে এসেছিল আরাকানের কোনো এক জায়গা থেকে। চুইঝাল দিয়ে খাসির মাংস খুলনা-যশোর-সাতক্ষীরার সবচেয়ে জনপ্রিয় খাবার। সাধারণ মসলা দিয়েই খাসি রান্না করতে হয়, রান্না শেষ হওয়ার ঠিক ১৫ মিনিট আগে চুইঝালের টুকরো দিতে হয় মাংসে। চুইঝাল দিলে ঝাঁজালো এক স্বাদ পাওয়া যায়। অনেকে মরিচের বিকল্প হিসেবেও এই চুইঝাল ব্যবহার করে।

মসলার প্রাথমিক কাজ হলো খাবারের স্বাদ-গন্ধ (ফ্লেভার), স্বাদ (টেস্ট), সুগন্ধ (অ্যারোমা), গঠন বা ঘনত্ব (টেক্সচার বা কনসিস্টেন্সি) আর রং তৈরি করা। এর পাশাপাশি কিছু মসলা ব্যবহার করা হয় খাবার সংরক্ষক, জীবাণুরোধী, অক্সিডেন্ট প্রতিরোধী হিসেবে।

জিরা, ধনিয়া, সরিষা, মেথি, হিং, আমচুর এই মসলাগুলো মাংসে ফ্লেভার অ্যাড করে। আবার চটপটে ঝাল করার জন্য রয়েছে গোল, শুকনা আর কাঁচামরিচ। খাবারে সুগন্ধ আনার জন্য রয়েছে মসলা-আদা, তেজপাতা, দারচিনি, এলাচ, লবঙ্গ। খাবারে রং আনে হলুদ। এভাবে বিভিন্ন পাতার নামও উল্লেখ করা যেতে পারে যেগুলো হার্ব হিসেবে ব্যবহার হতে পারে। যেমন ধনেপাতা, লেবুপাতা, পুদিনাপাতা, কারিপাতা, অল স্পাইস পাতা। খাবারে মসলার ব্যবহার শুধু স্বাদবর্ধক হিসেবেই হয়েছিল কি না, তার জন্য বিস্তর গবেষণার প্রয়োজন। তবে মাংসে যেসব হার্ব আর স্পাইস ব্যবহার করা হয়, তার কিন্তু ঔষধি গুণও কম নয়। সাধারণত রসুন, মরিচ, আদা, জিরা, পেঁয়াজ, ধনেপাতা, শুকনো মরিচ, দারচিনি, তেজপাতা, হলুদ নিয়েই কারবার। এসব মসলা আর হার্বের ব্যবহার যেমন স্বাদে বৈচিত্র্য আনে, তেমনি এগুলোর ঔষধি গুণও কিন্তু কম নয়। রসুন হার্টের জন্য উপকারী, রক্তচাপ ও কোলেস্টরেল নিয়ন্ত্রণ করে। হজমের জন্যও উপকারী। আদা ক্লান্তি দূর করে, পেশি আর জোড়ার ব্যথা উপশম করে, রক্ত সঞ্চালনেও সাহায্য করে। পেঁয়াজ ক্যান্সার প্রতিরোধী, হজম শক্তি বাড়ায়—এভাবে প্রতিটি মসলারই কোনো না কোনো উপকারিতা রয়েছে। তবে সমস্যাটা দাঁড়ায় তখনই, যখন খাবারে মসলার পরিমাণ বেশি হয় বা কোনো একটা জিনিসের পরিমাণ কম হয়। এজন্যই মাস্টারশেফ আর ঘরের হেঁসেলের কর্তারা বলেন, রান্না যত সিম্পল—তত ভালো তার স্বাদ। তবে এ ধরনের ‘দোষ’ সারানোর মসলাও রয়েছে। মসলা আর মাংসের পারফেক্ট কম্বিনেশন করানোর জন্য প্রয়োজন পারফেক্ট সেন্স অব কুকিং!

মাংস আর মসলা পাশাপাশি পথ চলছে সেই আদিকাল থেকেই, আমরা খাওয়ার জন্যই বাঁচি আর বাঁচার জন্যই খাই, খাওয়াটাই মুখ্য, ধ্রুব সত্য। মাংস মসলার যুগলবন্দি চলুক, পেটের ক্ষুধা নিবারিত হোক সুখাদ্যে, চোখের ক্ষুধা তৃপ্ত হোক ঝলমলে সব মসলার রঙে।

(লেখক : খাদ্য ও ইতিহাস গবেষক)

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

অনেক সাংস্কৃতিক কর্মী স্বৈরাচারের জন্য মায়াকান্না করছে : সেলিমা রহমান

চাকসু নির্বাচনে তপশিলের তারিখ ঘোষণা

অজু শেষে যে দোয়া পড়লে জান্নাতের ৮টি দরজা খুলে যায়

ম্যাচ চলাকালে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে ফুটবলারের মৃত্যু

লন্ডনে বোরকা পরে চুরির সময় ধরা ভারতীয় নাগরিক লক্ষ্মণ লাল

বন বিভাগের সামনেই অবাধে আসছে শিকার করা পণ্য

ধামরাইয়ে শ্রমিকদের বিক্ষোভ, মহাসড়ক অবরোধ

শিশুকে ধর্ষণের পর হত্যা, যুবকের মৃত্যুদণ্ড

জরুরি সংবাদ সম্মেলন ডেকেছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন

শাহবাগ অবরোধ বুয়েট শিক্ষার্থীদের 

১০

সাদাপাথর পরিদর্শনে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের তদন্ত কমিটি

১১

যেসব দেশে বিয়ে করলেই নাগরিকত্ব পেতে পারেন আপনিও

১২

‘মামাতো ভাইকে দিয়ে যুবদল নেতাকে খুন করান স্ত্রী’

১৩

জার্মান যুবদলের কর্মীসভা অনুষ্ঠিত 

১৪

জমি নিয়ে বিরোধ, প্রতিপক্ষের হামলায় বাবা-ছেলে খুন

১৫

নিউইয়র্কে কনস্যুলেটের ঘটনায় ব্যবস্থা নিতে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরে চিঠি

১৬

‘শেষবার মানিক আমাকে মা বলে ডেকেছিল’

১৭

ঢাকা সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটির ভর্তি পরীক্ষার ফল প্রকাশ 

১৮

অনলাইনে যেভাবে কাটবেন বাংলাদেশ-নেদারল্যান্ডস সিরিজের টিকিট

১৯

পালানোর প্রস্তুতি নিচ্ছেন ব্রাজিলের সাবেক প্রেসিডেন্ট?

২০
X