নবাবি আমলে ঘোড়ার গাড়িতে চড়া রমণী আর আজকের গাড়িতে চড়া আধুনিক রমণীর দৃশ্যপটে অনেক ফারাক থাকলেও দুই সময়ের নারী সেজেছেন মসলিন, সুতি কিংবা জামদানি শাড়িতে। আজকের ফ্যাশনে এসেছে আধুনিকতার ছোঁয়া, বৈচিত্র্য, অভিনবত্ব। কিন্তু সুপ্রাচীন কাল থেকে বাংলার সৌন্দর্যের প্রতীক মসলিন, জামদানি, সুতি কিংবা সিল্ক শাড়িকে আজও নির্দ্বিধায় সবাই বেছে নিচ্ছেন উৎসব-আয়োজনে। আর বাঙালির ঈদ মানেই নতুন ডিজাইনের বর্ণিল পোশাক। যেন নতুন শাড়ি আর পাঞ্জাবি পরনে হাজার বছরের বাঙালি জীবনের ঈদ যাপন। কালের বিবর্তনে দেশীয় পোশাকের ঐতিহ্যের সঙ্গে ঘটেছে পাশ্চাত্যের সংমিশ্রণ। সবাই চায় এখন হাল ফ্যাশন অনুযায়ী হোক ঈদ পোশাক। তবে অন্যের দেখানো পথ অনুসরণ না করা নিজের পছন্দ এবং আরামদায়ক পোশাকে আনতে পারেন ঈদ ফ্যাশনে স্বস্তি। ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যের সঙ্গে বাঙালি সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিক চেতনাকে মিল রেখেও করতে পারেন নিজের ঈদ ফ্যাশন। তাহলে দেরি কেন? বেরিয়ে পড়ুন আনন্দের ঈদ কেনাকাটায়। লিখেছেন আসাদ খান ও রঞ্জু চৌধুরী
ঈদ সকালটা আনুষ্ঠানিকতার
বাস্তবের ঈদের চেয়ে স্মৃতির ঈদ অনেক বেশি আনন্দঘন। ভালো খাবার আর ভালো পোশাকের জন্য ঈদের দিনটির জন্য সবাই অপেক্ষা করতেন। কোরবানি ঈদে জমকালো পোশাক নেওয়া বা উপহার দেওয়া-নেওয়াটা কম হলেও পরিবারের জন্য কিনতেই হয় নতুন পোশাক। ঈদ সকালটা ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতার। সুগন্ধি মেখে সাদা পাঞ্জাবি-পায়জামা পরে ঈদের জামাত আদায়। কোলাকুলি শেষে টুপি মাথায় ঝলমল রোদে মসজিদের ইমামকে নিয়ে বাড়ি ফেরা। মনের হিংসা, বিদ্বেষ, রাগ, অভিমানসহ সব কুপ্রবৃত্তি দমনে পবিত্র ও হালাল পশুকে মহান আল্লাহর নামে কোরবানি আদায়। তারপর মাংস প্রস্তুত, ভাগাভাগি আর মাংস বিতরণটা নিয়ে যায় সকাল থেকে দুপুর। এ সময় বাড়ির পুরুষদের জন্য প্রয়োজন নিত্য পরিধেয় পোশাক লুঙ্গি আর ‘স্যান্ডো গেঞ্জি’ অথবা থ্রি-কোয়ার্টার আর টি-শার্ট। তবে কোরবানির মাংস কাটাকাটিতে গামছা ছাড়া চলেই না। ঈদের দিন সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত মেয়েরাও বেশি ব্যস্ত থাকেন রান্নাবান্না এবং অতিথি আপ্যায়ন নিয়ে। তাই সকালের পোশাকটা হতে হবে খুব আরামদায়ক। এ সময় পরতে পারেন সুতির সালোয়ার-কামিজ বা কুর্তি। আর শাড়ি পছন্দ করলে পরতে পারেন পাতলা শাড়ি। সকালের ব্যস্ততার পর দুপুরে শুরু হয় ঈদের আসল আনন্দ। ঈদ-দুপুরে পরিবারের সঙ্গে নতুন পোশাক পরে এক টেবিলে খাওয়ার আনন্দটাই যেন অন্যরকম।
ঋতুর সঙ্গে সামঞ্জস্য
সবার কাছে ঈদ যেন আপন শহরে আনন্দের রঙিন রূপ ধারণ। রূপ যেমনই হোক সব আনন্দ নির্ভর করে প্রকৃতির ওপর। বলা যায়, প্রকৃতির আলোতে সজ্জিত জীবন। কাজী নজরুল ইসলাম তার কবিতায় যেমন বলেছেন— “চপল বিদ্যুতে হেরি সে চপলার ঝিলিক হানে কণ্ঠের মণিহার, নীল আঁচল হতে তৃষিত ধরার পথে ছুড়ে ফেলে মুঠি মুঠি বৃষ্টি শেফালিকা।” এবারের কোরবানি ঈদ আয়োজনটা বর্ষার প্রথম মাস আষাঢ়ে। তাই ঈদ ফ্যাশনে গুরুত্ব দিতে হবে রূপসী বাংলাদেশের আবহাওয়া উপযোগী কাপড়কে। সুতি, মসলিন, জামদানি বা সিল্ক—এ চার কাপড়কে প্রাধান্য দিয়ে নিজেকে সাজাতে পারেন ঈদের চার বেলা। আর বর্ষার প্রকৃতি থেকে ফুলেল মোটিফ বেছে নিতে পারেন ঈদ ফ্যাশনে। বৃষ্টি কিংবা গরম যাই হোক, ঋতুর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ পোশাক পরিধান করে নিজেকে সাজান ঈদ আয়োজনে।
আনন্দের শাড়িতে রঙিন রূপ
ঈদে যে পোশাকই পরা হোক না কেন, কাপড়ের ক্ষেত্রে সুতির কোনো বিকল্প নেই। সুতি কাপড় বৃষ্টি কিংবা গরমে স্বস্তির পাশাপাশি করে সৌন্দর্য বৃদ্ধি। এবারের ঈদ ফ্যাশনে পরতে পারেন ব্লক, টাই-ডাই, এমব্রয়ডারি, সুতার কাজ করা সুতি শাড়ি। এ ছাড়া পরতে পারেন সুতার কাজ করা সফট কটন, সুতি বা হাইব্রিড সুতার মিশ্রণে তৈরি কিছুটা হাফসিল্ক টাইপের তাঁত জামদানি শাড়ি। বেছে নিতে পারেন গ্রামীণ চেক সুতি, সিলেটের মণিপুরি, তাঁত জামদানি, সেঞ্চুরি পাতা, ন্যাচারাল ডাই, মাসলাইস কটন শাড়ি, নকশি পাড়সহ সুতি বড় পাড় শাড়ি। এ ছাড়া সুতির ছাপা শাড়ি, ব্লক, টাঙ্গাইলের শাড়ি, ব্লক-বাটিকের সুতি ট্রেন্ডি শাড়ি আর অ্যাপ্লিকের শাড়ি আপনাকে দেবে প্রশান্তি এবং পোশাকে আনবে অভিজাত্য। ঈদ অনুষ্ঠানে পরতে পারেন পাতলা চোষা কাতান, লিলেন কিংবা জামদানি শাড়ি। জ্যামিতিক নকশায় ফুটিয়ে তোলা পান্না হাজার, তেরছা, পানসি, ময়ূরপঙ্খী, বটপাতা, করলা, জাল, বুটিদার, জলপাড়, দুবলি, ডুরিয়া, বলিহার, কটিহার, কলকাপাড় ইত্যাদি জামদানির ডিজাইন আপনাকে করবে অন্যদের থেকে আলাদা। কারণ ফুল কটন জামদানি, হাফসিল্ক ও ফুলসিল্ক জামদানি শাড়ির সঙ্গে জড়িয়ে আছে আভিজাত্য এবং রুচিশীলতা।
শাড়ির মধ্যে নারীদের সবসময়ের অন্যতম পছন্দ সিল্ক শাড়ি। ঈদের অনুষ্ঠানে পরতে পারেন মসলিন সিল্ক শাড়ি, জামদানি সিল্ক, ব্লকের ডিজাইন বিভিন্ন রঙের পিওর সিল্ক, বলাকা, সফট, টাঙ্গাইল হাফসিল্ক কটকি, এক্সক্লুসিভ সিল্ক কাতান, টাঙ্গাইলের হাতের কাজের সিল্ক শাড়ি, ব্লক প্রিন্টেড হাফসিল্ক, হাফসিল্ক, ধূপিয়ান, তসর, ধূপিয়ান, টাঙ্গাইল সিল্ক শাড়িসহ বিভিন্ন স্টাইলের সিল্ক শাড়ি। এ ছাড়া পরতে পারেন মসলিন শাড়ি, শিফন, কোটা, ধূপিয়ান, লিলেন, বাটিকের শাড়ি। পাতলা সাটিন অথবা জর্জেটের শাড়িও গরমের জন্য আরামদায়ক। বিভিন্ন ডিজাইনের শাড়িতে মোটিফের ব্যবহার, কালার কম্বিনেশন এবং ভ্যালু অ্যাডিশনে নানা মিডিয়ার ব্যবহার করেছে পোশাকের ব্র্যান্ড ও ফ্যাশন হাউসগুলো।
ব্লাউজ ডিজাইনে ভিন্নতা
ব্লাউজের ডিজাইন সবসময় সুন্দর হয় যদি গলার কাট সুন্দর ও পারফেক্ট হয়। ঈদে সুতি শাড়ির ব্লাউজের ক্ষেত্রে পেছনের গলা বড় রাখতে পারেন। থ্রি-কোয়ার্টার বা হাফহাতা হলেও বেশ আরামদায়ক হবে। সুতির শাড়ির একরঙা ব্লাউজের গলার ডিজাইন এরকম বানিয়ে একবার ট্রাই করতে পারেন। পুরোনো দিনের বাড়ির বড় গিন্নির স্টাইলে ব্লাউজ বানানোর শখ থাকলে ভাঁজ করা কলার স্টাইল ডিজাইন করতে পারেন। এ ছাড়া নেকলেস স্টাইল গলার ডিজাইনের ব্লাউজ যদি কোনো শাড়ির জন্য বানিয়ে নিয়ে পরেন, তাহলে আলাদা করে আর গলায় হার পরার প্রয়োজন পরবে না। একটু আলাদা রকমের স্টাইলে ব্লাউজ বানানোর ইচ্ছে থাকলে ভি-কাট কলার ডিজাইনের নেক কাটটি দেখতে পারেন। তাঁতের সুতির শাড়ির সঙ্গে মানানসই লাগবে। কলমকরি প্রিন্টের কাপড়ে ব্লাউজ বানাতে গেলে সিম্পল কলার স্টাইল গলার ডিজাইনটি বেশ মানাসই হয়। স্মল হার্ট নেক আর বোতাম স্টাইল নেক ডিজাইনের ব্লাউজ সব রকমের শাড়ির সঙ্গে মানায়। এ ছাড়া রূপবতী রমণীর সাজে সাজতে হলে এক্সক্লুসিভ ও ইউনিক নেক ডিজাইনের ব্লাউজ পরতে পারেন। পরতে পারেন বক্স স্টাইল গলার, ক্লোজ টাইপ বোট নেক, প্লিট স্টাইল নেক, বোতাম স্টাইল নেক, কলার স্টাইল বোট নেক, হাফ জ্যাকেট স্টাইল নেক, শার্ট স্টাইল নেক ডিজাইনের ব্লাউজ। আর দর্জিপাড়ায় গেলেই বানাতে পারবেন পছন্দের শাড়ির সঙ্গে মানানসই ডিজাইনের এসব ব্লাউজ। তার সঙ্গে গরমে স্বস্তি পেতে ঈদ অনুষ্ঠানে উল্টো আঁচল দিয়ে শাড়ি পরতে পারেন।
উৎসবে পাঞ্জাবির বাহার
ছেলেদের সাজ মানেই পাঞ্জাবি-পায়জামা। সকাল, বিকেল বা রাতের ঈদ অনুষ্ঠানে পাঞ্জাবি-পায়জামা সবারই প্রথম পছন্দ। পাঞ্জাবি বলতে শুধু একরঙা সোজাসাপ্টা বা স্ট্রেট প্যাটার্ন নয়, উৎসবে পাঞ্জাবি মানেই আধুনিক ও ঐতিহ্যবাহী। এখন কাটছাঁট, রং আর বৈচিত্র্যে পাঞ্জাবিতে এসেছে নতুনত্বের ছোঁয়া। এবারের ঈদ ফ্যাশনে পাবেন রেগুলার ও ফিটেড পাঞ্জাবি। এ ছাড়া রয়েছে কাট বেইজড একরঙা পাঞ্জাবিও। এবার বেশিরভাগ পাঞ্জাবির কাট সেমি লং। আবহাওয়া উপযোগী স্বাচ্ছন্দ্যময় পোশাকের স্টাইলের সঙ্গে মসলিন, সুতি, সিল্ক, টিস্যু বা অ্যান্ডিসিল্কের পাঞ্জাবি যেমন প্রশান্তি আনে, তেমনি মন থাকে প্রফুল্ল। পাঞ্জাবিকে অলংকৃত করা হয়েছে এমব্রয়ডারি, স্ক্রিন ও ব্লক প্রিন্ট, কারচুপি, মেটালিক হাতের কাজ ও টাই-ডাইয়ের মাধ্যমে। প্রিন্টের প্রভাব কিছুটা কমলেও এবার পাবেন জ্যামিতিক প্যাটার্নের প্রিন্টের পাঞ্জাবি। বুকের একপাশে রয়েছে বাটনপ্লেটের চারপাশে হাতের কাজ বা মেশিন এমব্রয়ডারির কাজ। আছে এসিমেট্রিক্যাল প্যাটার্নও। আরও আছে মিডল প্ল্যাকেট থেকে সরে সাইড প্ল্যাকেটের পাঞ্জাবি। আধুনিকতার আলোয় ঐতিহ্যকে ফুটিয়ে তুলতে পাঞ্জাবিতে এবার ফুটে উঠেছে কাঁথার ফোঁড়, অরনামেন্টাল বিডস, মোগল শৈলী, মোগলীয় আর্ট, উইভিং মোটিফের অনুপ্রেরণা। এ ছাড়া গুজরাটি, ইক্কত, কলকা আর্ট, জামদানি, ফ্লোরাল, ট্র্যাডিশনাল, টার্কিশ আর্ট ও ইসলামিক মোটিফের ছোঁয়ায় সেজেছে ছেলেদের ঈদের পাঞ্জাবি। অনুষঙ্গ হিসেবে বেছে নিতে পারেন কাতান, সিল্ক, লিনেন, অ্যান্ডি কটন এবং সুতি কাপড়ে হালকা ও ভারী প্রিন্ট করা কটি।
ইতিহাস বদলানো ডিজাইন
ফ্যাশন জগতের ইতিহাস বদলে দেওয়া ফিটেড, হি-প্যাডেড, বার জ্যাকেট কিংবা ফুল স্কার্টের স্রষ্টা ফরাসি ফ্যাশন ডিজাইনার ক্রিশ্চিয়ান ডিওর। তিনি ফ্যাশন ডিজাইনিংয়ের মাধ্যমে প্যারিসসহ পুরো বিশ্বকে কাঁপিয়ে দিয়েছিলেন। বাংলাদেশে কাপড়ে হাজার বছরের ঐতিহ্য থাকলেও ফ্যাশন ডিজাইনিংয়ে ইতিহাস বদলানো তেমন কোনো ডিজাইন নেই। দেশীয় কাপড়, দেশীয় বুননে রং ও নকশার বৈচিত্র্যে বিভিন্ন পোশাক উৎসব-পার্বণে ক্রমেই হয়ে ওঠে সবার পছন্দের। সাংস্কৃতিক, জাতীয় কিংবা ধর্মীয় উৎসবে পুরোনো ডিজাইন আসছে নতুন করে। ফ্যাশন হাউস আলমিরার ডিজাইনার শাহরুখ আমিন টিংকু বলেন, ‘পৃথিবীতেই খুব তাড়াতাড়ি বদলে যাচ্ছে ফ্যাশনটা। ইন্টারনেট যুগে পুরো পৃথিবী এখন সবার হাতের মুঠোয়। বিংশ শতাব্দীতে এসে নতুন প্রজন্মের ডিজাইনাররা এখনকার মতো করে কাজ করছেন। সাংস্কৃতিক, জাতীয় বা ধর্মীয় উৎসবে নতুন করে আসছে পুরোনো ডিজাইন। সত্তর দশকের যে ফ্যাশনটা ছিল, সেটা আসছে ২০২৩ সালেরও মতো করেই। এখনকার ডিজাইনাররা পুরোনো ডিজাইনে যোগ করেছেন নিজের চিন্তা। ফরাসি ডিজাইনারদের সঙ্গে বাংলাদেশের ডিজাইনারদের মধ্যে যেমন পার্থক্য আছে, তেমনই পাশ্চাত্য বা পশ্চিমাদের সঙ্গে আমাদের পোশাকের ডিজাইনেও পার্থক্য আছে। আমাদের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, বিশ্বাস ব্যবস্থা, রাজনৈতিক ব্যবস্থা, শিল্পকর্ম, ধর্মীয় বিষয় চিন্তা করেই ডিজাইন করতে হয়। এ ক্ষেত্রে কাট, রং বা স্টাইলে আমরা পরিবর্তন আনতে পারি। তবে নতুন কিছু ডিজাইনে করার ক্ষেত্রে গ্রহণযোগ্যতারও একটা বিষয় আছে। সেটা খেয়াল করেই কাজ করতে হয়। ডিজাইনাররা চিন্তা করে বাৎসরিক পোশাকে কী ধরনের রং, কী ধরনের কাট এবং কী ধরনের প্রিন্ট বা কাজ হতে পারে তা পরিবর্তন আনার কাজ করছেন। শারীরিক গঠন চিন্তা করে পোশাকের কাটিং করতে হয়। সব ধরনের কাট ব্যবহার করা যায় না। দুই বছর আগের রং বা কাট আজকের দিনে চোখে আরাম দেয় না। কারণ ফ্যাশন চোখ খুব তাড়াতাড়ি বদলায়।’
সময়ের সঙ্গে বদলানো পোশাক
শাড়ির পর মেয়েদের প্রথম পছন্দ সালোয়ার-কামিজ। এখন ডাবল লেয়ারড সালোয়ার-কামিজ বেশ জনপ্রিয়। ঈদ ফ্যাশনে পরতে পারেন সুতি জামদানি, হাফসিল্ক, সিল্ক, জামদানি, ন্যাচারাল ডাইয়ের ট্র্যাডিশনাল ক্ল্যাসিক, রেট্রো, ফিউশন, এ লাইন, আংরাখা, কাট বেইজডসহ বৈচিত্র্যময় নানা প্যাটার্নের সালোয়ার কামিজ। বর্তমানে নারীদের পছন্দ কুর্তি। জুট কটনের বোহেমিয়ান কাট কুর্তিসহ ঈদ ফ্যাশনে পাবেন নতুন নতুন কুর্তি, লং-কুর্তি, রেগুলার কুর্তি, টপস, ডাবল লেয়ারড কুর্তি। লম্বা কামিজ বা গোল হলেও কুর্তি আরামদায়ক। এ ছাড়া নিতে পারেন সুইচ কটন বাটিক কুর্তি, এক-কাপ-চা কুর্তি, সুইচ কটন আফসান রাউন্ড কুর্তি, সুইচ কটন আফসান রাউন্ড কুর্তি। ফ্যাশনে ফতুয়ার জনপ্রিয়তা কম নয়। নারীরা জিন্সের সঙ্গে পরতে পারেন ফতুয়া। এ ছাড়া ফতুয়ার সঙ্গে ধুতি সালোয়ার, পালাজো বা জমকালো স্কার্টও পরতে পারবেন। টাই-ডাইয়ের কামিজ বা ফতুয়া খুব সহজেই মানিয়ে যায় সবাইকে। আরামের সঙ্গে থাকবে ট্রেন্ডি লুকও। কাপড়ের ধরন ও হালকা রং দেখে গরমে অনেকেই টি-শার্ট পরেন। নারীদের ফ্যাশন ধারায় জনপ্রিয় এক স্টাইল হলো কো-অর্ডিনেট সেট। সংক্ষেপে সবাই বলে কো-অর্ড। যে কোনো কাটের পোশাকেই হতে পারে কো-অর্ড। রয়েছে কুর্তা বা পাঞ্জাবির মতো কাট। সঙ্গে থাকছে প্যান্ট, চাপা সালোয়ার কিংবা টিউলিপ প্যান্ট। আধুনিক ধারায় অনেক হাউস এনেছে কাফতান। আরও রয়েছে উঁচু-নিচু কাটের শার্ট। আরও থাকছে কোমর উঁচু প্যান্ট, প্যান্টের নিচের অংশে চওড়া কাট এবং সোজা কাটের প্যান্ট। রিসোর্ট ওয়্যার, লাউঞ্জ ওয়্যার বা বিচ ওয়্যার হিসেবে কো-অর্ডের প্রচলন আগে থেকেই ছিল। সময়ের সঙ্গে বদলেছে শুধু প্যাটার্ন আর কাট। এখনকার কো-অর্ড পোশাকগুলো কাটের কারণেই যেন নজর কেড়েছে বেশি। বেশিরভাগ কো-অর্ড সেট বানানো হচ্ছে বেশ ঢিলেঢালা কাটে। উপকরণও রাখা হচ্ছে আরামদায়ক। বেছে নিতে পারেন প্রিন্ট কিংবা একরঙা কো-অর্ড। ফুলের মোটিফ, জ্যামিতিক মোটিফ কিংবা টাই-ডাইয়ের কো-অর্ড দেখতেও সুন্দর। ফ্যাশনে এবার বেশ জোরালোভাবেই যোগ হয়েছে সোজা কাটের পালাজো, প্যান্ট, সালোয়ার ও চুড়িদার। এ ছাড়া নিতে পারেন টিউনিক, শ্রাগ, কাফটান, প্যান্টসহ টপস, টপস-স্কার্ট, টপস-পালাজো সেট, বিভিন্ন প্যাটার্নের প্যান্ট।
ছেলেদের অন্য কিছু
ফ্যাশন সচেতন ছেলেদের জন্য পোশাক শুধু আরামদায়ক হলেই চলে না, চিন্তায় থাকতে হয় ট্রেন্ডের বিষয়টিও। তাই স্বস্তিদায়ক এবং ফ্যাশনের কথা চিন্তা করে বেছে নিতে পারেন প্রিমিয়াম কটন ফেব্রিকে তৈরি পোলো শার্ট অথবা টি-শার্ট। দিনভর ব্যস্ততায় স্বাচ্ছন্দ্যে থাকার পাশাপাশি পলো শার্ট অথবা টি-শার্ট দেবে স্মার্ট ক্যাজুয়াল আর সেমিফরমাল লুক। ছেলেদের জন্য রয়েছে স্মার্ট ক্যাজুয়াল শার্ট, এথনিক শার্ট, ফতুয়া, পলো শার্ট ও টি-শার্ট। এখন পোলো শার্টের রয়েছে বিশেষ কদর। অফিস ছাড়াও ক্যাজুয়াল আর সেমিফরমাল লুকে পার্টি, ডে আউট বা বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডায় পরতে পারেন পোলো শার্ট। ডেনিম জিন্স, ফরমাল প্যান্ট কিংবা চিনোসের সঙ্গে মিলিয়ে পরার ক্ষেত্রেও পোলো শার্টের জুড়ি নেই। পোলোর পাশাপাশি এবার ঈদে পাবেন নতুন ডিজাইনের টি-শার্ট। আধুনিকতার সঙ্গে দেশীয় সংস্কৃতিকেও প্রিন্টের মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে টি-শার্টের নকশায়।
রঙের বাহার
শাড়ি বা সালোয়ার কামিজের রং হিসেবে বেছে নিতে পারেন মেরুন, রেড, ক্রিমসন রেড, পেস্ট, ব্ল্যাক, টারকুইস, নেভি, অরেঞ্জ, পিচ, আপ্রিকট, কোরাল পিঙ্ক, লাইট পিঙ্ক, অ্যাশ, অলিভ, গ্রিন, অ্যাকুয়া গ্রিন, ভায়োলেট, ল্যাভেন্ডার, ব্রাউন, হোয়াইট, অফ-হোয়াইট, সিলভার, ইন্ডিগো, ম্যাজেন্টা, মাস্টার্ড ইয়েলোসহ নানান রং। এবার ব্ল্যাক, টেন গোল্ড, মেরুন, ম্যাজেন্টা, ফিরোজা, কফি, পার্পল, ভায়োলেট, ল্যাভেন্ডার, চেরি রেড, অরেঞ্জ, হট ও কোরাল পিঙ্ক, অলিভ গ্রিন, ফরেস্ট গ্রিন, মিন্ট গ্রিন ও ব্রোঞ্জ গ্রিন রঙের বৈচিত্র্য পাঞ্জাবিতে সবচেয়ে বেশি। এক নীলেরই কত ধরন—রয়্যাল, নেভি, মেরিনো, ক্যাডেট, স্কাই। ফ্যাশন সচেতন নারীরা পরতে পারেন সাদা, হালকা বেগুনি ও নীল, চেক, একরঙা রঙের ওপর বিভিন্ন সুতার কারুকাজ করা ফতুয়া। রং ও ডিজাইনের পার্থক্যে পরতে পারেন হালকা নীল, সাদা, গোলাপি, লেমন কালার, হালকা বেগুনি, আকাশি রঙের সুতি বা হালকা ফেব্রিকসের কুর্তি। পীতাভ সবুজ, হালকা বেগুনি, পাউডার পিঙ্ক, পাউডার ব্লু কিংবা ক্রিমরোজ ইয়েলো রঙের কো-অর্ড অনেকেরই পছন্দ। তবে নিউট্রাল রঙের বাইরেও সবুজ, নীল, নিয়ন, সরষে হলুদ, হট পিঙ্কের মতো উজ্জ্বল কিংবা গাঢ় রঙের কো-অর্ডও পাবেন। এ ছাড়া নেভি, স্কাই, অফ-হোয়াইট, গ্রে, হোয়াইট, বটল গ্রিন, রেড, গ্রিন, মেরুন, ইয়েলো, ফিরোজা, পেস্ট, অ্যাশ, ম্যাজেন্টা, ব্ল্যাক কালার ছাড়াও হালকা লাইট কালার থেকে সহজেই বেছে নিতে পারেন পছন্দের আরামের পোলো অথবা টি-শার্ট।
সৌন্দর্য প্রকাশের উপকরণ
অলংকার শুধু সৌন্দর্য প্রকাশের উপকরণ নয়, বলা যায় মর্যাদার প্রতীক বা সঞ্চয়ের প্রতিরূপ। অলংকার সৌন্দর্য বৃদ্ধির পাশাপাশি আছে বিভিন্ন সংস্কার ও ধর্মবিশ্বাস। ঈদ সাজে নিজেকে সুন্দর ও প্রশংসনীয় করে তোলার জন্য সময় উপযোগী পোশাকের সঙ্গে মানানসই অলংকার না হলেই নয়। ঈদ আনন্দ একার না হলেও নিজেকে সাজাতে পারেন নিজের মতো। ঈদে পরিবার, ভাই-বন্ধুদের সঙ্গে বা নিকটাত্মীয়দের বাসায় নিমন্ত্রণে যাওয়া কিংবা তাদের আমন্ত্রণ আয়োজনে পরতে পারেন পাড়সহ অথবা পাড়ছাড়া শাড়ির সঙ্গে হাতভর্তি চুড়ি, কপালে সূর্যরাঙা টিপ, কানে-গলায় গহনা, মাটির কিংবা মসলার গহনা। সঙ্গে খোঁপায় বা বেণিতে রঙিন ফুলের মিষ্টি সাজ নিজেকে নিয়ে যাবে ঈদ আনন্দের রূপবতী মাত্রায়। পায়ে পোশাকের রঙের সঙ্গে মানানসই জুতা। ফিউশনধর্মী এ লুকে আরও ভিন্নতা এনেছে চুলে আটকানো ফুল নকশার কাঁটাগুলো। শাড়ি বাদে অন্য পোশাকে পরতে পারেন হাতে রুপার মোটা ব্রেসলেট, রুপার ভারী বালা, আংটি ও দুল আর পায়ে কালো ফুলেল নকশার জুতা। নিতে পারেন জুতার সঙ্গে মিলিয়ে বেল্ট বা ব্যাগ আর পায়ে বেজ রঙের ব্লক হিল। চুলগুলো করতে পারেন দুই-তিন রঙের মোটা কাপড়ের রাবার ব্যান্ডের মাধ্যমে খোঁপা।
ঈদে লাইফস্টাইল ব্র্যান্ড
ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতিকে ধারণ করে নানাভাবে ঈদ পোশাকে তুলে ধরছে অনেক ফ্যাশন হাউস। তারুণ্যের ফ্যাশনের কথা মাথায় রেখেই ফ্যাশনে নতুনত্ব আনার লক্ষ্যে কাজ করছেন ডিজাইনাররা। ‘বিদেশি পোশাক মানে ভালো’—এ ধারণা থেকে বেরিয়ে এসেছেন ক্রেতারা। বৈচিত্র্যময় ডিজাইন, নান্দনিকতা আর দেশীয় ভাবধারায় দেশীয় পোশাক সবার আগে বেছে নিচ্ছেন সবাই। চাহিদার বাড়ার সঙ্গে প্রতিনিয়তই প্রসার ঘটছে দেশীয় পোশাকের বাজার। কে-ক্রাফটের স্বত্বাধিকারী ও ডিজাইনার খালিদ মাহমুদ খান বলেন, ‘সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নগর উন্নয়ন, কাজের সুযোগ সৃষ্টি, ক্রেতার ক্রয় করার সামর্থ্য বৃদ্ধি, জীবনযাপনের উন্নয়ন ও রুচির পরিবর্তন ঘটে থাকে, ফলে পণ্যের চাহিদা বাড়ে, বাজার সম্প্রসারিত হয়। কোরবানির ঈদের বাজারও প্রসারিত হয়েছে। দেশি, বিদেশি উভয় পোশাকেই ভালোমন্দ আছে। ক্রেতা এখন আগের চেয়ে অনেকখানি দেখে বুঝে যাচাই করে পোশাক কেনাকাটা করে থাকেন। সামর্থ্যের মধ্যে থেকে নিজ ব্যক্তিত্বের সঙ্গে মানানসই, সেরা সৃজনশীল পোশাকটি ক্রেতা নিজের করে নিতে চান। এ ছাড়া দেশের বাইরে দেশীয় পোশাকের চাহিদা অনেকটাই বেড়েছে। কম খরচে দেশের বাইরে কম সময়ে পণ্য পাঠানো সম্ভব হলে, বাজার অতি দ্রুত অনেক বড় হবে। দেশের বাইরে নতুন নতুন মার্কেটে ব্যবসা সম্প্রসারণে নানারকম নতুন নতুন উদ্যোগ গ্রহণে সরকার ও ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোর আরও ভূমিকা রাখার সুযোগ রয়েছে।’
ঈদ কেন্দ্র করে পোশাক ব্র্যান্ড ও ফ্যাশন হাউসগুলো নিয়ে এসেছে আরামদায়ক ও জাঁকজমক সংগ্রহ। প্রশান্তি, বাহারি রং, ফুলের মোটিভ এবং দেশীয় ও পশ্চিমা ধাঁচের মিশেলে তৈরি করেছে এবারের ঈদ পোশাক। আড়ং, অঞ্জন’স, নিপুণ, কে-ক্র্যাফট, রঙ, প্রবর্তনা, বাংলার মেলা, নগরদোলা, বিবিআনা, দেশাল, শঙ্খবার, দর্জিবাড়ি, রঙ বাংলাদেশ, বিশ্বরঙ, এক্সট্যাসি, ইয়েলো, রিচম্যান, ক্যাটস আইসসহ বিভিন্ন ব্যান্ডের ফ্যাশন হাউসে পাবেন আপনার পছন্দের ঈদ পোশাক। এ ছাড়া কারু ও পোশাকশিল্পকে দেশজ ভাবনায় আছে কুমুদিনী, টাঙ্গাইল শাড়ি কুটির, জয়া, অন্যমেলা, এম ক্র্যাফট, নবরূপা, ম্যাকয়, স্মার্টেক্স, শৈল্পিক ও স্টুডিও এমদাদসহ আরও বেশ কয়েকটি ফ্যাশন হাউসে পাবেন পছন্দের সব পোশাক। নিপুণ, রঙ, কে-ক্র্যাফট, সাদাকালো, অঞ্জন’স, বিবিয়ানা, দেশাল, প্রবর্তনা, নগরদোলা ও বাংলার মেলা নিয়ে ১০টি দেশীয় ব্র্যান্ডের ‘দেশী দশ’ দিচ্ছে ঈদ কেনাকাটায় বিশেষ মূল্যছাড়। চাইলে অনলাইনে কেনাকাটা করতে পারবেন শাড়ি, পাঞ্জাবিসহ বিভিন্ন ঈদ পোশাক।
মন্তব্য করুন