দেশে প্রতি বছর ১৫ থেকে ২০ হাজার শিশু হার্টের রোগ নিয়ে জন্ম নিচ্ছে। যাদের ৪০ শতাংশের চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে। বাকি ৬০ ভাগ চিকিৎসা নিতে পারছে না। দাতব্য সহায়তায় কিছু শিশুর চিকিৎসা হচ্ছে। যেটি প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম।
শনিবার (৩১ মে) ‘নিউনেটাল কার্ডিয়াক কনফারেন্স ২০২৫’ উপলক্ষে রাজধানীর কল্যাণপুরে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে বিশেষজ্ঞরা এ তথ্য জানান।
নবজাতক ও শিশু হৃদরোগ চিকিৎসায় বৈজ্ঞানিক উৎকর্ষ সাধনের লক্ষ্যে আয়োজিত এ সম্মেলনে খ্যাতনামা নবজাতক ও শিশু বিশেষজ্ঞ, পেরিনেটাল ও গাইনোকোলজি বিশেষজ্ঞ এবং শিশু হৃদরোগ বিশেষজ্ঞরা অংশগ্রহণ করেন। কিডস হার্ট ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে জাতীয় বৈজ্ঞানিক সেমিনারের সহযোগী ছিল একমি ফার্মাসিউটিক্যালস লি.।
সেমিনারের আয়োজক ও চিফ পেট্রন হিসেবে উপস্থিত ছিলেন স্বাধীনতা পদকপ্রাপ্ত শিশু হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) অধ্যাপক ডা. নুরুন্নাহার ফাতেমা বেগম। তিনি বলেন, দেশে আমার হাত ধরে ১৯৯৮ সালের দিকে পেডিয়াট্রিক কার্ডিওলোজি সাবজেক্ট শুরু হয়। তখন অনেকে বলতো দেশে শিশু হার্টের রোগী নেই। এখন অনেক রোগী দেখি, চিকিৎসকও আছে। তবে এখনো অনেক নবজাতক হার্টের সমস্যায় মারা যাচ্ছে।
তিনি বলেন, বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে সুপার স্পেশালাইলজ হাসপাতাল রয়েছে যেখানে কোটি টাকার চিকিৎসা সরঞ্জাম অবহেলায় নষ্ট হচ্ছে। অথচ আমরা যাকাতের টাকা সংগ্রহ করে শিশুদের হার্টের চিকিৎসা করছি। প্রতিটি মেডিকেল কলেজে শিশু কার্ডিলোজি বিভাগ খুলে নিয়মিত স্ক্রিনিং প্রোগ্রাম, নিউনেটাল কার্ডিলোজি, নন-ইনভেসিভ করা দরকার। এজন্য অর্থ খরচ হয়না। আমাদের হাসপাতালের সমস্যা নেই কিন্তু প্রশিক্ষিত জনবলের সংকট আছে। সরকার পেডিয়াট্রিক চিকিৎসকদের জন্য ৬ মাস ও এক বছরের প্রশিক্ষণ চালু করতে পারে।
তিনি বলেন, আমরা সত্যি উন্নয়নশীল দেশ সেদিনই হবো, যেদিন একজন মা গর্ভধারণের পর জানতে পারবে গর্ভের সন্তানের কোনো জটিলতা নেই। হার্টের কোনো সমস্যা নেই।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা নাজমুল হোসেন বলেন, নিউনেটাল কার্ডিয়াক কেয়ার নিয়ে কনফারেন্স হচ্ছে। কার্ডিওলজি ও কার্ডিয়াক সার্জারি চার দশক আগে কোথায় ছিল আর আজকে কোথায় পৌঁছে গেছে। জাপানের বন্ধুরা আশির দশকে মাসের পর মাস এদেশে থেকে কার্ডিয়াক সার্জারি ও কার্ডিওলজি শিখিয়েছে। কিন্তু দেশে কোয়ালিটি যতটা বেড়েছে কোয়ান্টিটি ততটা বাড়েনি। হৃদরোগের চিকিৎসা শহর কেন্দ্রিক রয়ে গেছ। ঢাকার বাইরে কোনো শিশু যদি কার্ডিয়াক কোনো সমস্যা হয় তাহলে তাকে বাঁচানো কঠিন। কারণ কোনো অবকাঠামো বা জনবল নেই। সবাইকে ঢাকামুখী হওয়ার মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। চিকিৎসকদের বলবো অন্তত তিন বছর ঢাকার বাইরে সেবা দিন।
তিনি বলেন, আট বিভাগে ক্যানসার কিডনি ও হৃদরোগের যে হাসপাতালের নির্মাণ অবকাঠামো প্রায় শেষের দিকে। অথচ জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিটিউটে (এনআইসিভিডি) পেডিয়াট্রিক কার্ডিয়াক সার্জন ডেডিকেটেড আছে দুই থেকে তিনজন। তাহলে বিভাগীয় হাসপাতাল চালবে কীভাবে। এনআইসিভিডিই চালবে কীভাবে? শিগগিরই আমরা চিকিৎসকদের এ সংক্রান্ত কর্মশালা আয়োজন করতে চাচ্ছি। অন্যথায় সেন্টারগুলো বন্ধ থাকবে। যন্ত্রপাতি আসবে। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হবে না। কারিকুলামে কার্ডিয়াক কেয়ারকে মিডটার্ম রিভিউ শুরু করা হবে।
সম্মেলনে ৮টি বৈজ্ঞানিক সেশন অনুষ্ঠিত হয় যেখানে ২৫ জনের অধিক দেশি ও আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন চিকিৎসক তাদের গবেষণা ও অভিজ্ঞতাভিত্তিক সায়েন্টিফিক পেপার উপস্থাপন করেন। দেশীয় বিশেষজ্ঞদের পাশাপাশি বিশ্বের বিভিন্ন দেশের অভিজ্ঞ চিকিৎসকরাও ভার্চুয়াল প্ল্যাটফর্ম (জুম) এর মাধ্যমে অংশ নেন।
সেশনগুলোতে সভাপতিত্ব ও পরিচালনার দায়িত্ব পালন করেন দেশের অন্যতম খ্যাতনামা চিকিৎসকরা। যারা নবজাতক ও শিশু চিকিৎসা, পেরিনেটাল কেয়ার ও গাইনোকোলজির বিভিন্ন ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন।
সেমিনারের বিশেষ আকর্ষণ ছিল একটি হাতে-কলমে প্রশিক্ষণ (হ্যান্ডস-অন ট্রেনিং) সেশন, যেখানে ১৪০ জন চিকিৎসককে নিউনেটাল ইকোকার্ডিওগ্রাফি, ইসিজি, মেকানিক্যাল ভেন্টিলেশন এবং শিশু হৃদরোগ বিষয়ক যন্ত্রপাতি সম্পর্কে সরাসরি প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। এই অংশগ্রহণমূলক প্রশিক্ষণ চিকিৎসকদের জন্য একটি বাস্তবভিত্তিক ও ফলপ্রসূ অভিজ্ঞতা হিসেবে কাজ করেছে।
সমাপনী অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশ নিউরাল ফোরাম, বাংলাদেশ পেরিনেটাল সোসাইটি ও পিডিয়াট্রিক কার্ডিয়াক সোসাইটি অফ বাংলাদেশ-এর সম্মানিত সভাপতিরা। নবজাতক ও শিশুদের হৃদরোগ নির্ণয় ও চিকিৎসার মানোন্নয়নে এমন সেমিনার এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন অংশগ্রহণকারীরা
মন্তব্য করুন