একটি সময় ছিল যখন পুরুষ বন্ধ্যাত্বের কোনো কার্যকর সমাধান পাওয়া যেত না। যেসব পুরুষ কোনো শুক্রাণুই উৎপন্ন করতে পারেন না, তাদের জন্য পিতৃত্বের স্বপ্ন থেকে সরে দাঁড়ানো ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না।
তবে আধুনিক জীববিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সেই সীমা অতিক্রম করতে চলেছে। আজ বিজ্ঞানীরা এমন এক গবেষণায় নিয়োজিত, যা ভবিষ্যতে মানুষের শুক্রাণু পরীক্ষাগারে উৎপাদনের সম্ভাবনা জাগিয়ে তুলেছে।
শুক্রবার (৩১ মে) দ্য কানভার্সন জার্নাল তাদের প্রকাশিত এক প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য জানা যায়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, এই অত্যাধুনিক গবেষণার নেতৃত্ব দিচ্ছেন ইউনিভার্সিটি অব লিমারিকের (আইরল্যান্ড) একদল বিজ্ঞানী। তারা এমন এক কৃত্রিম টেস্টিকুলার টিস্যু তৈরি করার চেষ্টা করছেন, যা মানবদেহের মতোই শুক্রাণু উৎপাদনে সক্ষম হবে। যদি এই প্রচেষ্টা সফল হয়, তবে পুরুষ বন্ধ্যাত্ব চিকিৎসায় এটি এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনবে।
বিশ্বব্যাপী গবেষণায় দেখা গেছে, গত ৭০ বছরে পুরুষদের গড় শুক্রাণু সংখ্যা প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে। একই সময়ে বাড়ছে টেস্টিকুলার ক্যানসার, হরমোনজনিত সমস্যা ও যৌনাঙ্গের গঠনগত ত্রুটি- যেগুলোর প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়ে প্রজনন ক্ষমতার ওপর।
এই সংকটের কারণ হিসেবে বিজ্ঞানীরা দায়ী করছেন পরিবেশগত দূষণ এবং এন্ডোক্রাইন-ডিসরাপ্টিং কেমিক্যালস নামক কিছু হরমোন-ব্যাহতকারী রাসায়নিককে। প্লাস্টিক, প্রসাধনী, কীটনাশক কিংবা ওষুধে উপস্থিত এসব উপাদান গর্ভস্থ শিশুর হরমোন বিকাশে বাধা সৃষ্টি করে, ফলে ভবিষ্যতে শুক্রাণু উৎপাদনে ব্যাঘাত ঘটে।
প্রজনন সমস্যা নিরসনে জীবনযাত্রার পরিবর্তন, হরমোন চিকিৎসা বা অস্ত্রোপচার সহায়ক হতে পারে। তবে বহু পুরুষ রয়েছেন যাদের বন্ধ্যাত্বের কোনো নির্দিষ্ট কারণ শনাক্ত করা যায় না- এদের বলা হয় 'আইডিওপ্যাথিক ইনফার্টিলিটি'।
এসব ক্ষেত্রে ভরসা করা হয় অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে শুক্রাণু সংগ্রহের (Surgical Sperm Retrieval) ওপর। কিন্তু এতে সফলতার হার সর্বোচ্চ ৪০ শতাংশ। তাছাড়া, পুরুষের দেহে সঠিক শুক্রাণু না থাকলে (In Vitro Fertilization) বা অন্যান্য প্রজনন প্রযুক্তি প্রয়োগ করতে হয় নারীর দেহে- ফলে চিকিৎসার পুরো চাপটা গিয়ে পড়ে নারীর শরীর ও মানসিকতার ওপর। সবশেষ যখন SSR ব্যর্থ হয়, তখন দম্পতিকে ডোনার শুক্রাণুর কথা ভাবতে হয়, যা অনেকের জন্য মানসিকভাবে খুবই কঠিন সিদ্ধান্ত।
বিজ্ঞানীরা জানেন, সমস্যার স্থায়ী সমাধান চাইলে শুক্রাণু উৎপাদনের প্রক্রিয়াটাকেই কৃত্রিমভাবে পুনর্নির্মাণ করতে হবে। কিন্তু মানুষের দেহে সরাসরি পরীক্ষা করা নৈতিকভাবে গ্রহণযোগ্য নয়। তাই গবেষণায় ব্যবহার করা হচ্ছে এক্স ভিভো টিস্যু (শরীরের বাইরে রাখা মানব/প্রাণীর টিস্যু), ইন ভিট্রো কোষ চাষ এবং প্রাণী মডেল (যেমন ইঁদুর বা প্রাইমেট)।
তবে মানুষের শুক্রাণু উৎপাদনের প্রক্রিয়া অন্যান্য স্তন্যপায়ীর চেয়ে অনেক জটিল। এজন্য গবেষণায় ব্যবহার করা প্রাণী মডেলগুলো সঠিক ফলাফল দেয় না।
এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় গবেষক দল জীববিজ্ঞান, যন্ত্র প্রকৌশল ও উপাদান বিজ্ঞানকে একত্রিত করে তৈরি করছেন এমন এক পরীক্ষাগার মডেল, যা টেস্টিস টিস্যুর গঠন, কোষীয় পারিপার্শ্বিকতা ও কার্যকারিতাকে অনুকরণ করতে পারে।
তাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য- একটি ‘বায়োইঞ্জিনিয়ার্ড হিউম্যান টেস্টিস’ তৈরি করা, যা পরীক্ষাগারে কার্যকর শুক্রাণু তৈরি করতে পারবে।
ল্যাবে তৈরি শুক্রাণু ভবিষ্যতে অনেক জটিল সমস্যার সমাধান দিতে পারে, যেমন- SSR পদ্ধতিতে ব্যর্থ রোগীদের জন্য নতুন সুযোগ, শৈশবে ক্যানসার চিকিৎসায় প্রজনন ক্ষমতা হারানোদের জন্য বিকল্প রাস্তা, অজানা কারণে বন্ধ্যাত্বে ভোগা পুরুষদের জন্য কার্যকর চিকিৎসা। এর ফলে কেবল প্রজনন নয়, পুরুষের সার্বিক স্বাস্থ্যঝুঁকি কমানোর পথও উন্মুক্ত হবে।
এই গবেষণাটি নিছক একটি বৈজ্ঞানিক প্রচেষ্টা নয়। এটি একটি মানবিক প্রয়াস- একটি নতুন আশার হাতছানি। যে সব পুরুষ আজ ‘নিঃসন্তান’ শব্দটির ভার বহন করছেন, যাদের জন্য প্রচলিত চিকিৎসায় কোনো উপায় অবশিষ্ট নেই, তাদের জন্য ভবিষ্যতের পরীক্ষাগারে তৈরি শুক্রাণু হতে পারে সন্তান ধারণের নতুন সম্ভাবনা।
মন্তব্য করুন