দরিয়া-ই-নূর নামটি যেমন চমৎকার, তার অর্থও তেমনই সুন্দর—‘আলোর সমুদ্র’। এই হীরাটি শুধু দক্ষিণ এশিয়ার নয়, বিশ্বের অন্যতম বিখ্যাত ও মূল্যবান রত্নগুলোর একটি। দেখতে অনেকটা কোহিনূরের মতো দরিয়া-ই-নূরের আকৃতি আয়তাকার এবং এর ওজন ২৬ ক্যারেট। এর চারপাশে ছিল আরও দশটি ছোট ডিম্বাকৃতির হীরা, যেগুলোর প্রতিটির ওজন ছিল প্রায় ৫ ক্যারেট করে। সব মিলিয়ে এই হীরাটির মোট ওজন দাঁড়ায় ৭৬ ক্যারেট। ধারণা করা হয়, এই হীরাটিও কোহিনূরের মতো দক্ষিণ ভারতের গলকোন্ডা খনি থেকেই পাওয়া গিয়েছিল।
প্রথমে দরিয়া-ই-নূর ছিল মারাঠা রাজাদের দখলে। এরপর হায়দরাবাদের নওয়াব সিরাজুল মুলক এটি কিনে নেন ১ লক্ষ ৩০ হাজার টাকায়। কিছুদিন পর হীরাটি পারস্য সম্রাটের হাতে চলে যায়, এবং সম্ভবত তখনই এর নামকরণ হয় দরিয়া-ই-নূর। পরবর্তীতে এটি পাঞ্জাবের শাসক রণজিৎ সিংহের কাছে আসে। ১৮৪৯ সালে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি যখন পাঞ্জাব দখল করে, তখন কোহিনূরের সঙ্গে দরিয়া-ই-নূরও তাদের দখলে চলে যায়। সেই সময় এর মূল্য নির্ধারণ করা হয় ৬৩ হাজার টাকা।
১৮৫০ সালে লন্ডনের হাইড পার্কে রানী ভিক্টোরিয়ার সম্মানে এক প্রদর্শনী মেলা হয়। সেখানে দরিয়া-ই-নূরসহ বহু মূল্যবান রত্ন প্রদর্শন করা হয়। কিন্তু দর্শকদের মাঝে এটি আশানুরূপ আগ্রহ সৃষ্টি করতে পারেনি। তাই সিদ্ধান্ত হয় হীরাটি ভারতে ফেরত এনে নিলামের মাধ্যমে বিক্রি করা হবে। ১৮৫২ সালে কলকাতায় হ্যামিলটন অ্যান্ড কোম্পানির ব্যবস্থাপনায় দরিয়া-ই-নূরের নিলাম হয় এবং ঢাকার নওয়াব খাজা আলীমুল্লাহ এটি ৭৫ হাজার টাকায় কিনে নেন। নওয়াব পরিবার হীরাটি একটি স্বর্ণের বাজুবন্দে বসিয়ে অলংকার হিসেবে ব্যবহার করতে থাকেন। পরবর্তীতে হ্যামিলটন অ্যান্ড কোম্পানির সহায়তায় ঢাকার নওয়াবদের রত্নভাণ্ডার নিয়ে একটি অ্যালবাম প্রকাশিত হয়, যেখানে দরিয়া-ই-নূর ছিল অন্যতম আকর্ষণ।
১৮৮৭ সালে ভাইসরয় লর্ড ডাফরিন ও লেডি ডাফরিন কলকাতার বালিগঞ্জের নওয়াব ভবনে এসে হীরাটি প্রত্যক্ষ করেন। ১৯০৮ সালে নওয়াব খাজা সলিমুল্লাহ এটি বন্ধক রেখে সরকারের কাছ থেকে ঋণ গ্রহণ করেন। তখন এর মূল্য নির্ধারণ করা হয় ৫ লক্ষ টাকা। ঋণ শোধ করতে না পেরে তিনি সিদ্ধান্ত নেন হীরাটি বিক্রি করবেন। ১৯১১ সালে এটি আবার ইংল্যান্ডে পাঠানো হয়, কিন্তু ইউরোপীয় বাজারেও এটি কাঙ্ক্ষিত মূল্য পায়নি। সর্বোচ্চ দাম ওঠে মাত্র ১৫০০ পাউন্ড। পরে হীরাটি ফেরত এনে ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত কলকাতার হ্যামিলটন অ্যান্ড কোম্পানির অধীনে সংরক্ষিত রাখা হয়।
১৯১২ সালে ব্রিটিশ সম্রাট পঞ্চম জর্জ ও রানী মেরী ভারতের সফরে এসে হীরাটি দেখেন। সলিমুল্লাহর মৃত্যুর পর হীরাটি ঢাকার নওয়াব এস্টেটের কোর্ট অব ওয়ার্ডসের তত্ত্বাবধানে চলে আসে। ভারত ভাগের পর এটি কলকাতা থেকে এনে ঢাকার ইম্পেরিয়াল ব্যাংকে রাখা হয়। বর্তমানে হীরাটি সোনালী ব্যাংকের ভল্টে সংরক্ষিত আছে, যেখানে কড়া নিরাপত্তায় এটি রাখা হয়েছে। ১৯৮৫ সালে বিশেষজ্ঞদের পরীক্ষায় প্রমাণিত হয়, দরিয়া-ই-নূর একটি সম্পূর্ণ খাঁটি এবং অকৃত্রিম হীরক।
এ হীরাটি শুধু একটি মূল্যবান রত্ন নয়, বরং এটি দক্ষিণ এশিয়ার একটি ঐতিহাসিক প্রতীক। বিভিন্ন রাজবংশ, উপনিবেশিক শাসন এবং আধুনিক রাষ্ট্রগঠনের মধ্য দিয়ে যে ইতিহাস গড়ে উঠেছে, দরিয়া-ই-নূর তারই নীরব সাক্ষী। এটি পৃথিবীর অন্যতম বড় গোলাপি রঙের হীরা এবং অনেকে মনে করেন, এটি এক বিশাল হীরার অংশ—যার আরেকটি অংশ ইরানে সংরক্ষিত, যার নাম ‘নূর-উল-আইন’। বহু হাত ঘুরে, বহু দেশে প্রদর্শিত হয়ে এখন এটি বাংলাদেশেই সংরক্ষিত রয়েছে, যা আমাদের জাতীয় ইতিহাসের একটি গর্বিত অংশ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।
মন্তব্য করুন