আবু আজাদ
প্রকাশ : ০১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১০:২৫ এএম
আপডেট : ০২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১০:৩৭ পিএম
অনলাইন সংস্করণ

চিরতরে হারিয়ে যাচ্ছে মেছোবিড়াল

নিরীহ প্রকৃতির বন্যপ্রাণী মেছোবিড়াল। ছবি : সংগৃহীত
নিরীহ প্রকৃতির বন্যপ্রাণী মেছোবিড়াল। ছবি : সংগৃহীত

মেছোবিড়াল। শান্ত ও লাজুক স্বভাবের নিরীহ এক বন্যপ্রাণী। এক সময় যার বিচরণ ছিল দেশের সর্বত্র। হাওর, বাঁওড়, বিলসহ জলাভূমি এলাকা ছিল প্রাণীটির নিরাপদ আশ্রয়। কিন্তু সময়ের ব্যবধানে এ বন্যপ্রাণীটিকে মানুষ শত্রুজ্ঞান করছে, হত্যা করা হচ্ছে গণহারে। এতে অচিরেই বিলুপ্তির ঝুঁকিতে আছে প্রাণীটি। বন্যপ্রাণী বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের ভারসাম্য রক্ষায় দ্রুত মেছোবিড়াল সংরক্ষণের উদ্যোগ নিতে হবে; নয়তো অচিরেই হারিয়ে যাবে প্রাণ-প্রকৃতির এই বন্ধু।

দেশের বনাঞ্চলে যে আট প্রজাতির বুনো বিড়ালের বাস, তার একটি এই মেছো বিড়াল (Fishing Cat)। স্থানীয় নাম বাঘুইলা। কিন্তু সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ অনেক গণমাধ্যমেও প্রাণীটিকে মেছোবাঘ হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হচ্ছে। নামের সঙ্গে বাঘ যুক্ত হওয়ার কারণেই হয়তো প্রাণীটি সম্পর্কে মানুষের নেতিবাচক মনোভাব গড়ে উঠেছে। এ ঘটনাটিই হয়তো বিড়ালটির সর্বনাশকে ত্বরান্বিত করেছে।

এমন পরিস্থিতিতে দেশে আজ ১ ফেব্রুয়ারি প্রথমবারের মতো মেছোবিড়াল দিবস পালিত হচ্ছে। মূলত উপকারী এ প্রাণীটির গুরুত্ব তুলে ধরার পাশাপাশি এটি সংরক্ষণে মানুষকে সচেতন করতে দিবসটি পালনের উদ্যোগ নিয়েছে বন বিভাগ।

বিড়ালকে বাঘ আখ্যা, হয়ে গেল শত্রু

বাংলাদেশের প্রায় সর্বত্রই মেছোবিড়ালের বিচরণ রয়েছে। জলাভূমি আছে এমন এলাকায় বেশি দেখা যায়। প্রাণীটি জলাশয়ের মরা ও রোগাক্রান্ত মাছ খেয়ে মাছের রোগ নিয়ন্ত্রণ করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এছাড়া ব্যাঙ, কাঁকড়া, ছোট পাখি ছাড়াও পোকামাকড় ও ইঁদুর খেয়ে কৃষকের উপকার করে।

তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে মানুষের সঙ্গে মেছোবিড়ালের দ্বন্দ্ব বাড়ছে। এতে প্রায়ই আক্রান্ত হচ্ছে প্রাণীটি। হত্যা করা হচ্ছে নির্মমভাবে। সাম্প্রতিক এক গবেষণায় ২০০৫ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত মেছোবিড়াল সম্পর্কিত ৩৬১টি সংবাদ সংগ্রহ করা হয়। এর ১৬০টি সংবাদই ছিল মেছোবিড়াল হত্যার। যার ৪৬ শতাংশ সংবাদে বলা হয়, মেছোবিড়াল দেখামাত্র ধাওয়া করেছে মানুষ। ৮৩ শতাংশ সংবাদে মেছোবিড়ালকে বাঘ বা বাঘের বাচ্চা হিসেবে উল্লেখ করা হয়। গবেষণাটি কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘স্টুডেন্ট কনফারেন্স অন কনজারভেশন সায়েন্স’ পুরস্কার জেতে।

বন বিভাগের বন্যপ্রাণী ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ কর্মকর্তা জোহরা মিলা কালবেলাকে বলেন, প্রাণীটির প্রকৃত নাম মেছোবিড়াল হলেও অনেকে একে মেছোবাঘ নামেও ডাকে। বাঘ নামে ডাকার কারণে শুধু শুধু আতঙ্ক ছড়িয়েছে। প্রাণীটি মানুষকে আক্রমণ করে না, বরং মানুষ দেখলেই পালিয়ে যায়। কিন্তু এ ধরনের একটি নাম নিরীহ বিড়ালটিকে আরও বিপদগ্রস্ত করে তুলেছে। জনবসতি স্থাপন, বন ও জলাভূমি ধ্বংস, পিটিয়ে হত্যা ইত্যাদি কারণে বিগত কয়েক দশকে এই প্রাণীটির সংখ্যা আশঙ্কাজনকভাবে হ্রাস পেয়েছে।

আড়মোড়া ভেঙেছিল বন বিভাগ

প্রকৃতিতে মেছোবিড়ালের সংখ্যা দ্রুত কমে যাওয়ার বিষয়টি কয়েক বছর আগে বন বিভাগের নজরে আসে। প্রাণীটির অস্তিত্ব নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়ে সরকারি এই সংস্থাটি। সীমিত আকারে হলেও শুরু হয় গবেষণা।

২০২৩ সালের ২৫ মার্চ সিলেটে একটি পুরুষ মেছো বিড়ালের গলায় স্যাটেলাইট কলার বসিয়ে প্রকৃতিতে ছেড়ে দেওয়া হয়। উদ্দেশ্য- প্রাণীটির গতিবিধি ও জীবনধারা সম্পর্কে জানা। বিশেষ করে বর্ষা মৌসুমে হাওরে থাকলেও শুষ্ক মৌসুমে প্রাণীটি কোথায় যায়। যাতে ভবিষ্যতে সে এলাকায় বিড়ালটির নিরাপত্তার জন্য নজরদারি বাড়ানো সম্ভব হয়। কিন্তু মাত্র ২৮ দিনের মধ্যে বিড়ালটিকে হত্যা করেন এক কৃষক। এরপর সেখানেই থেমে যায় বন বিভাগ।

এ বিষয়ে গবেষণা দলের প্রধান ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. এমএ আজিজ কালবেলাকে বলেন, স্যাটেলাইট কলার পরানো মেছোবিড়ালটি প্রকৃতিতে ছেড়ে দেবার এক মাসও পেরোয়নি অথচ সেটিকে হত্যা করা হয়। এটিই প্রমাণ করে প্রাণীটির অস্তিত্ব কতটা হুমকির মুখে রয়েছে।

আছে সমন্বয়হীনতা ও স্বার্থের সাংঘর্ষ

হাওরাঞ্চলে মেছোবিড়ালের আধিক্য বেশি। কিন্তু হাওরের দেখভাল করে পরিবেশ অধিদপ্তর। আবার মেছোবিড়াল বন বিভাগের সম্পত্তি। তাই প্রাণীটি নিয়ে চিন্তিতও নয় পরিবেশ অধিদপ্তর। এ বিষয়ে নেই তাদের কোনো প্রশিক্ষণও! পরিবেশ ও বন, এই দুই বিভাগের সমন্বয়হীনতার অভাবও মেছোবিড়ালকে সংকটে ঠেলে দিয়েছে।

এ বিষয়ে অধ্যাপক এমএ আজিজ হতাশা প্রকাশ করে বলেন, একই মন্ত্রণালয়ের বিভাগের দুটি সমন্বয়হীনতার জন্য একটি বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ কঠিন হয়ে উঠেছে, এটি বিস্ময়কর!

তবে পরিবেশ অধিদপ্তরের অসহযোগিতার বিষয়টি এড়িয়ে যান বন অধিদপ্তরের বন্যপ্রাণী ও প্রকৃতি সংরক্ষণ অঞ্চলের বন সংরক্ষক ইমরান আহমেদ। তিনি বরং প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের সমন্বয়হীনতার ইঙ্গিত করেন। এই বন কর্মকর্তা বলেন, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে হাওরে হাঁসের চাষাবাদ অতিমাত্রায় বেড়েছে। এতে সেখানকার স্বাভাবিক প্রতিবেশ ব্যাহত হচ্ছে এবং পরিযায়ী পাখি, মেছোবিড়ালের অস্তিত্বসহ জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়েছে।

আইন ও প্রয়োগের দুর্বলতা

মেছোবিড়ালকে বিশ্বব্যাপী সংকটাপন্ন হিসেবে তালিকাভুক্ত করেছে আন্তর্জাতিক প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ সংঘ (আইইউসিএন)। প্রাণীটি দেশের আইনে সংরক্ষিত। ২০১২ সালের বন্যপ্রাণী আইনেও মেছোবিড়াল হত্যা বা এর কোনো ক্ষতিকরা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। কিন্তু আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়ার নজির নেই বললেই চলে।

যদিও অধ্যাপক আজিজ মনে করেন, শুধু আইন দিয়ে মেছোবিড়াল রক্ষা করা সম্ভব নয়। সবার আগে প্রয়োজন স্থানীয় মানুষকে প্রাণীটির উপকারিতা বোঝানো, সংরক্ষণে তাদের সম্পৃক্ত করা। আর এ জন্য বন বিভাগকে আদাজল খেয়ে নামতে হবে। আর এখানেই ব্যাপক ঘাটতি আছে বলে মনে করেন এই গবেষক।

নেই কোনো প্রকল্প, পরিকল্পনাও

২০২৩ সালে শুরু হওয়া গবেষণাটি থেমে যাওয়ার পর আর কোনো উদ্যোগ নেয়নি বন বিভাগ। এই মুহূর্তে নেই কোনো প্রকল্প। এমনকি বিড়ালটি সংরক্ষণে সুর্নিদিষ্ট কোনো পরিকল্পনাও করেনি সরকারি সংস্থাটি। তবে মেছোবিড়াল সংরক্ষণে উদ্যোগ জরুরি হয়ে পড়েছে বলে স্বীকার করেছেন বন সংরক্ষক ইমরান আহমেদ।

তিনি বলেন, মেছোবিড়ালের কলার পরানোর পর গুরুত্বপূর্ণ কিছু তথ্য পাওয়া গিয়েছিল। কিন্তু দুঃখজনকভাবে ওই গবেষণাটি থেমে যায়। তবে এরপর নতুন করে আর উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। যদিও এ নিয়ে আমরা পরিকল্পনা করছি।

ইমরান আহমেদ বলেন, আসলে বন বিভাগের পরিকল্পনা ও প্রকল্পগুলো বড়প্রাণী বিশেষ করে মহাবিপন্ন প্রাণীগুলো নিয়ে আবর্তিত। তবে এখন সময় এসেছে ছোটপ্রাণীগুলোকে নিয়ে ভাবার।

তবে কি বিলুপ্ত হয়ে যাবে মেছোবিড়াল?

জাপানের দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থায়নে ২০১৭ সাল থেকে প্রাণীটি নিয়ে গবেষণা করছেন অধ্যাপক আজিজ। তারমতে, দেশে মাংসাশী প্রাণীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি হত্যা করা হয় মেছোবিড়াল। হত্যার শিকার সব প্রজাতির বন্যপ্রাণীর মধ্যেও এটি প্রথম দিকেই আছে।

তিনি বলেন, বড় বন্যপ্রাণীর জন্য নানা প্রকল্প পরিচালনা করছে বন বিভাগ। কিন্তু মেছোবিড়াল ছোটপ্রাণী হওয়ায় হয়তো সেভাবে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে না। নেই প্রচার-প্রচারণাও। এরই ফাঁকে প্রাণীটি হারিয়ে যেতে বসেছে।

‘সারা দেশে যেভাবে গণহারে প্রাণীটিকে হত্যা করা হচ্ছে, তাতে দ্রুত বিজ্ঞানভিত্তিক ও কার্যকর ব্যবস্থা না নিলে দ্রুতই দেশ থেকে চিরতরে বিলুপ্ত হয়ে যাবে মেছোবিড়াল,’ যোগ করেন অধ্যাপক।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

খালেদা জিয়ার মৃত্যুতে ডিক্যাবের শোক

কর্মসূচি স্থগিত করে নতুন ঘোষণা ইনকিলাব মঞ্চের

মানিক মিয়া অ্যাভিনিউজুড়ে জানাজা অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি 

খালেদা জিয়ার রুহের মাগফিরাতে নিউমার্কেট বিএনপির দোয়া

প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী সায়েদুর রহমানের পদত্যাগ

গণতন্ত্র হারাল এক অভিভাবক, জাতির জন্য অপূরণীয় ক্ষতি : এবিএম ওবায়দুল

প্রকৌশল খাতে খালেদা জিয়ার অবদান অনস্বীকার্য : আইইবি

রুমিন ফারহানাসহ যে ৯ জনকে বহিষ্কার করল বিএনপি

খালেদা জিয়ার জানাজা উপলক্ষে যেসব সড়ক বন্ধ থাকবে 

বেগম খালেদা জিয়ার জানাজায় নারীদের অংশগ্রহণ নিয়ে যা জানা গেল

১০

বহিষ্কারের পর নির্বাচন করার ঘোষণা ১ বিএনপি নেতার

১১

ইজতেমার ময়দানে সমাবেশ নিয়ে নতুন সিদ্ধান্ত জানাল সরকার

১২

রাস্তায় ফেলে যাওয়া ২ শিশুর দায়িত্ব নিলেন জেলা প্রশাসক

১৩

খালেদা জিয়ার মৃত্যু / ৩ দিনের রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণায় স্থগিত হলো যেসব পরীক্ষা

১৪

বিএনপি নেতার প্রার্থিতা গ্রহণ না করতে রিটার্নিং কর্মকর্তাকে ব্যাংকের চিঠি

১৫

খালেদা জিয়ার ‘মাতৃস্নেহ’ নিয়ে অধ্যাপক জাহিদের স্মৃতিচারণা

১৬

খালেদা জিয়ার জানাজায় অংশ নিতে ঢাবির বিশেষ পরিবহন ব্যবস্থা

১৭

ওয়েস্টিন, শেরাটন ও হানসার ৩১ ডিসেম্বরের সব অনুষ্ঠান বাতিল

১৮

বেগম খালেদা জিয়া গণতন্ত্রের প্রতীক : ডা. তাহের

১৯

খালেদা জিয়ার জানাজায় নারীদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা

২০
X