বাসস
প্রকাশ : ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০৮:৪২ এএম
আপডেট : ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১১:০৯ এএম
অনলাইন সংস্করণ

সন্তানের জন্য দুধ কিনতে গিয়ে শহীদ হন শাহরিয়ার শুভ

শহীদ শাহরিয়ার শুভ
শহীদ শাহরিয়ার শুভ। ছবি : সংগৃহীত

সারা দেশে ছাত্র-জনতার স্বৈরাচার হটানোর আন্দোলন তখন তুঙ্গে। রাজধানী ঢাকার রাজপথ উত্তাল। ঠিক এ সময় ১৯ জুলাই ঢাকার মিরপুর এলাকায় সন্তানের জন্য দুধ কিনতে গিয়ে মাথায় গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হন চুয়াডাঙ্গার সন্তান প্রকৌশলী শাহরিয়ার শুভ।

কৃষক পরিবারের সন্তান প্রকৌশলী শাহরিয়ার শুভ (২৮) যশোরের একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে তড়িৎ প্রকৌশলে ডিপ্লোমা শেষে ঢাকায় একটি লিফট নির্মাতা প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতেন। শাহরিয়ার শুভ চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার শংকরচন্দ্র গ্রামের মণ্ডল পাড়ার কৃষক আবু সাঈদ ও চম্পা খাতুনের ছেলে। আবু সাঈদ দম্পতির তিন ছেলে ও এক মেয়ে। শুভ মেজো।

শহীদ শাহরিয়ার শুভর স্ত্রীর নাম রাজিয়া সুলতানা। তাদের ১৪ মাস বয়সী মোস্তাফিজ মুহিন নামে এক ছেলে সন্তান রয়েছে। স্বামী শুভ মারা যাওয়ার পর ছেলেকে নিয়ে রাজিয়া ঢাকাতে বসবাস করছেন। তিনি একটি অনলাইন কোম্পানিতে চাকরি করছেন।

শাহরিয়ারের বড় ভাই সাদ্দাম হোসেন ঢাকার একটি কনস্ট্রাকশন ফার্মে প্রকৌশলী হিসেবে কর্মরত। ছোট ভাই সিয়াম আলী জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিষয়ে স্নাতক (সম্মান) তৃতীয় বর্ষের ছাত্র। একমাত্র বোন লিজা খাতুন গৃহিণী।

শাহরিয়ার শুভ ঢাকার মিরপুর-১ নম্বর এলাকায় ভাড়া বাসায় থাকতেন। স্বৈরাচার বিরোধী ছাত্র-জনতার গণ-আন্দোলন চলাকালে ১৯ জুলাই সন্ধ্যায় শুভ ছেলের জন্য দুধ কিনতে বের হন। পরে ঢাকার মিরপুর এলাকায় মাথায় গুলিবিদ্ধ হয়ে মারাত্মক আহত হন প্রকৌশলী শাহরিয়ার শুভ। ঢাকার ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস অ্যান্ড হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) চিকিৎসাধীন অবস্থায় ২৩ জুলাই মঙ্গলবার সন্ধ্যায় মৃত্যু বরণ করেন তিনি।

১৩ ফেব্রুয়ারি বৃহস্পতিবার সকাল ৯টার দিকে শাহরিয়ার শুভ গ্রামের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, বাড়িতে সুনসান নীরবতা বিরাজ করছে। বাবা আবু সাঈদ ও মা চম্পা বেগম ছাড়া বাড়িতে আর কেউ নেই। বাড়ির উঠানে কুল গাছ। কুল পেকে টসটস করছে। অথচ খাওয়ার কেউ নেই। একমাত্র উপার্জনক্ষম ছেলে মারা যাওয়ার ৭ মাস অতিবাহিত হলেও আজও স্বাভাবিক হতে পারেনি পরিবারের সদস্যরা।

শুভর বাবা আবু সাঈদ বলেন, ‘আমার তিন ছেলের মধ্যে শাহরিয়ার শুভ মেজো। ১৯ জুলাই সে ঢাকার মিরপুর এলাকায় ছেলের জন্য দুধ কিনতে বের হয়ে মাথায় গুলিবিদ্ধ হয়ে মারাত্মক আহত হয়। ২৩ জুলাই মারা যায়।’

তিনি বলেন, ‘আমার চার সন্তানকে খুব কষ্ট করে মানুষ করেছি। আমার পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী সদস্য ছিল শুভ। তার আয়ের ওপর ভরসা করে আমার ছোট ছেলে সিয়ামকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করেছিলাম। শুভ তার খরচ চালাত।’

সিয়াম বর্তমানে টিউশনি করে বিশ্ববিদ্যালয়ের লেখাপড়ার খরচ চালাচ্ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘ছোট বেলা থেকে মেধাবী ছিল শাহরিয়ার শুভ। জেলার ডিঙ্গেদহ আলিয়া মাদ্রাসা থেকে দাখিল পাস করে। এরপর যশোর বিসিএমসি পলিটেকনিক্যাল কলেজ থেকে ডিপ্লোমা করেন। পরে ঢাকার একটি লিফট নির্মাতা প্রতিষ্ঠানে চাকুরি করত। এর মাঝে শুভ ও বিয়ে হয়। তার শ্বশুরবাড়ি মাগুরা জেলার সদর উপজেলার কাপাসাটি গ্রামে।’

আবু সাইদ আরও বলেন, ‘বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি সংগঠন কিছু নগদ সহায়তা করেছে আমাদের পরিবারে। এর মধ্যে জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন থেকে ৫ লাখ, বিজিবি থেকে ৫০ হাজার, জেলা প্রশাসন থেকে ৩০ হাজার, জামায়াত ইসলামি ২ লাখ ২০ হাজার, বিএনপি ২০ হাজার টাকাসহ বিভিন্ন ব্যক্তি আর্থিক সহায়তা করেছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘আর্থিক সহযোগিতার থেকেও এখন জরুরি আমার দুই ছেলে ও শুভর স্ত্রীর একটি সরকারি চাকুরির ব্যবস্থা করা। সেই জন্য আমি বর্তমান সরকারের কাছে দাবি জানাচ্ছি।’

শুভর মা চম্পা বেগম কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘১৯ জুলাই দুপুরে শুভর সাথে মোবাইল ফোনে আমার শেষ কথা হয়। আমি তখন জোহরের নামাজের জন্য ওজু করছি। এ সময় শুভ ফোন দিল ‘মা, তুমি কী করছো?‘আমি বললাম, ওজু করছি। ঠিক আছে মা তুমি ওজু করে নামাজ পড়ে নাও। আমি পরে ফোন দেব।’ তখন কি আমি জানতাম আমার ছেলের সাথে এটাই আমার শেষ কথা!

তিনি বলেন, ‘ওই দিনই অনেক রাতে জানতে পারলাম শুভ মাথায় গুলিবিদ্ধ হয়ে হাসপাতালে। সেই থেকে আমাদের সাজানো সংসার উল্টাপাল্টা হয়ে গেছে।’

চম্পা বেগম আক্ষেপ করে আরও বলেন, ‘অভাবের সংসারে লেখাপড়া শেখাতে গিয়ে তাদের জন্য মাছ, মাংস, ভালো জামা, কাপড় কিনে দিতে পারেনি। অত্যন্ত কষ্ট করে তারা বেড়ে উঠেছে। শুভর স্মৃতি বলতে ওর রেখে যাওয়া কয়েকটি পোশাক ও একটি মোটরসাইকেল।’

১৯ জুলাইয়ের ঘটনার বর্ণনা করতে গিয়ে শুভর ছোট ভাই সিয়াম বলেন, ‘বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় অস্থিতিশীল হয়ে পড়ায় ১৮ জুলাই তিনি ঢাকার মিরপুরে ভাই শাহরিয়ারের বাসায় গিয়ে ওঠেন। পরদিন দুপুরে খাওয়া-দাওয়া শেষে শিশু মুহিনকে নিয়ে দুই ভাই ঘুমান। বিকেল সাড়ে পাঁচটার দিকে ঘুম থেকে উঠে শাহরিয়ার ছোট ভাই ও ছেলের জন্য খাবার কিনতে বাইরে বের হন। বাইরে যাবার সময় ভাইয়ের সাথে আমার শেষ কথা হয়।

তখন ভাই আমাকে জিজ্ঞাসা করেন, তুই কী খাবি? আমি বললাম আমার জন্য কিছু আনতে হবে না। বাসা থেকে বের হয়ে কিডনি ফাউন্ডেশনের সামনে আসলে পুলিশের ছোঁড়া একটি গুলি শুভর মাথায় লাগে। মিরপুর ২ থেকে ১০ নম্বর সড়কের মাঝামাঝি জায়গা থেকে শুভকে উদ্ধারকারীরা উদ্ধার করে হাসপাতালে নেয়।

ভাই বাসায় আসছে না দেখে ভাবি ভাইয়ের নম্বরে ফোন দিলে কয়েকবার রিং হয়ে বন্ধ হয়ে যায়। ভাইয়ের সাথে যোগাযোগ করতে না পেরে আমাদের উৎকণ্ঠা বাড়তে থাকে। এরই মধ্যে রাত সাড়ে ১০টার দিকে চুয়াডাঙ্গার গ্রামের বাড়ি থেকে খবর আসে শাহরিয়ার ঢাকায় গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। শাহরিয়ারর কাছে থাকা জাতীয় পরিচয়পত্রের সূত্র ধরে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস অ্যান্ড হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ৯৯৯ নম্বরে বিষয়টি জানায়। সেখান থেকে চুয়াডাঙ্গা সদর থানা-পুলিশের মাধ্যমে পরিবারকে জানানো হয়।’

চুয়াডাঙ্গার ডিঙ্গেদহের ব্যবসায়ী আবু ওবায়দা বলেন, ‘সে ডিঙ্গেদহ মাদ্রাসার ছাত্র ছিল। তার আকস্মিক মৃত্যুতে পরিবারটি দিশাহারা হয়ে পড়েছে। অন্তর্বর্তী সরকার যদি পরিবারের দিকে দৃষ্টি দেয়, তাহলে পরিবাওে হয়তো সচ্ছলতা ফিরবে।’

প্রতিবেশী প্রভাষক ইব্রাহিম কুদ্দুস বলেন, ‘কোনো কিছুর বিনিময়ে শুভকে আমরা ফিরে পাব না। তাদের পরিবারকে সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা আমাদের নেই। ইতোমধ্যে অনেকেই তাদেরকে মানসিক ও আর্থিকভাবে সহযোগিতা করেছেন। এই মুহূর্তে সবচেয়ে বড় প্রয়োজন শুভর স্ত্রীর ও সন্তানের মাথাগোঁজার মত একটি ব্যবস্থা করা।’

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের চুয়াডাঙ্গা জেলা শাখার আহ্বায়ক আসলাম হোসেন অর্ক বলেন, ‘শুভকে রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃতি ও সামাজিকভাবে মর্যাদা দিতে হবে। অর্থনৈতিক সাপোর্ট নিশ্চিত করতে হবে। শুভর স্মৃতি রক্ষার্থে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের উদ্যোগে স্মৃতি ফলক নির্মাণ করা হয়েছে।’

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

বাংলাদেশ-ওয়েস্ট ইন্ডিজ সিরিজের সূচিতে পরিবর্তন

আবরার হত্যার বিচার করলেই আ.লীগ নিষিদ্ধ হওয়া উচিত : চরমোনাই পীর

ফুসফুস ক্যানসারের এই ৫ উপসর্গ সাধারণ অসুখ ভেবে এড়িয়ে যাচ্ছেন না তো?

ভৈরবে স্থানীয় অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও পাদুকা খাতে উদ্ভাবন শীর্ষক আঞ্চলিক ক্যাম্পেইন

বিসিবিতে নতুন দায়িত্ব বণ্টন: কোন কমিটির নেতৃত্বে কে?

চট্টগ্রামে যুবদলের দুই নেতাকে বহিষ্কার

মানসিক ভারসাম্যহীন মা, ফুটফুটে কন্যা সন্তান পেল নতুন ঠিকানা

ট্রাম্পের ‘ডাক্তার দেখানো উচিত’ মন্তব্যে গ্রেটা থুনবার্গের পাল্টা জবাব

১৭ মাসে কোরআনে হাফেজ, উপহার পেল রাদিফ

তিন মাসে ৫০ দিন অনুপস্থিত মেডিকেল অফিসার

১০

কমিউনিটি ব্যাংকের স্বতন্ত্র পরিচালক হলেন ঢাবির অধ্যাপক মোর্শেদ

১১

‘দেশের বিরুদ্ধে আগ্রাসনের চেষ্টা চালাচ্ছে ৩ পরাশক্তি’

১২

ডাকসুর এজিএস মহিউদ্দীনকে শৈশবের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সংবর্ধনা

১৩

মেদ কমাতে হিমশিম খাচ্ছেন? মাত্র ২ মিনিটের কার্যকর কৌশল জেনে নিন 

১৪

‘জুনায়েদ বাবুনগরীকে কোটি টাকায়ও কিনতে পারেনি শেখ হাসিনা’

১৫

শাপলা প্রতীক না পেলে কী করবে এনসিপি?

১৬

বাংলাদেশকে সুখবর দিল বিশ্বব্যাংক

১৭

অপরাধীদের দল-মতের ঊর্ধ্বে আইনের আওতায় আনা হবে : পুলিশ সুপার

১৮

আইসিসি থেকে সুখবর পেলেন বাংলাদেশের একাধিক ক্রিকেটার

১৯

বছরের প্রথম সুপারমুন আজ, বাংলাদেশ থেকে দেখা যাবে কি?

২০
X