কালবেলা ডেস্ক
প্রকাশ : ২২ আগস্ট ২০২৩, ০৮:২৬ পিএম
অনলাইন সংস্করণ

পর্যবেক্ষক বিতর্কে বাংলাদেশের নির্বাচনের বৈধতা নিয়ে সংশয় জাপানি গণমাধ্যমের

বাংলাদেশে ২০১৮ সালের সবশেষ সাধারণ নির্বাচনে একজন নারী ভোট দিচ্ছেন। ছবি : সংগৃহীত
বাংলাদেশে ২০১৮ সালের সবশেষ সাধারণ নির্বাচনে একজন নারী ভোট দিচ্ছেন। ছবি : সংগৃহীত

আগামী বছরের শুরুতে বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। তবে নির্বাচন কমিশনকর্তৃক ঘোষিত পর্যবেক্ষকদের একটি তালিকা এই নির্বাচনের বৈধতা নিয়ে নতুন করে সংশয় তৈরি করেছে।

চলতি মাসে নির্বাচন কমিশন অনুমোদন দিয়ে ৬৮টি পর্যবেক্ষক দলের নাম অনলাইনে প্রকাশ করেছে। তাদের (পর্যবেক্ষকদের) উপস্থিতি ভোটগ্রহণ সুষ্ঠুভাবে সম্মাদনে ভূমিকা রাখার কথা। কিন্তু দেশের বিরোধী দল ও আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন, নির্বাচনে কারচুপি হতে পারে। পর্যবেক্ষকদের এই তালিকা সরকারের উদ্দেশ্য নিয়ে সংশয় আরও গভীর করেছে।

স্থানীয় গণমাধ্যমের অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ওই তালিকার প্রায় অর্ধেক পর্যবেক্ষকের কেবল ‘নাম’ রয়েছে। তাদের নির্বাচন পর্যবেক্ষণের কোনো ট্র্যাক রেকর্ড নেই অথবা ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সাথে তাদরে গভীর সম্পর্ক রয়েছে। জাপানি গণমাধ্যম নিক্কেই এশিয়া বেশ কয়েকজন পর্যবেক্ষকের সাথে যোগাযোগ করেছে এবং একই ধরনের ইস্যু খুঁজে পেয়েছে।

পর্যবেক্ষকদের একটি হলো ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের একজন সাবেক প্রেসিডেন্ট এবং ঢাকায় একটি ওয়ার্ড কমিটির সদস্য মিজানুর রহমানের ‘শিশু প্রতিভা বিকাশ কেন্দ্র’। যোগাযোগ করা হলে মিজানুর রহমান বলেন, তার সংস্থার স্থানীয় বা জাতীয় নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করার কোনো অভিজ্ঞতা নেই। যদিও তিনি দাবি করেছেন, তার সংগঠনের পর্যবেক্ষক হওয়ার ‘পূর্ণ ক্ষমতা’ রয়েছে।

নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তারাও এই বিতর্কের কথা নিক্কেই এশিয়ার কাছে স্বীকার করেছেন। তারা বলেছেন, পর্যবেক্ষক তালিকা সংশোধন করার সুযোগ আছে। কোনো নামের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ পেলে তারা এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। বর্তমান নির্বাচন কমিশনে ৬ সদস্যের প্যানেলের একজন কমিশনার আনিসুর রহমান। তিনি নিক্কেইকে বলেছেন, কমিশনের ওয়েবসাইটে একটি নোটিশ পোস্ট করা হয়েছে। তাতে এমন তদন্তকে স্বাগত জানানো হয়েছে। যদি কোনো অভিযোগ পাওয়া যায় তাহলে তা অনুসন্ধানের পর আমরা চূড়ান্ত তালিকা প্রস্তুত করব। আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য ও কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য মোহাম্মদ আলি আরাফাতও নিশ্চিত করেছেন যে, যদি নিরেট প্রমাণ দিয়ে কোনো অভিযোগ করা হয় তাহলে সংশ্লিষ্ট সংগঠনকে চূড়ান্ত অনুমোদন দেবে না নির্বাচন কমিশন।

কিন্তু সমালোচকরা বলছেন, আগের নির্বাচনগুলোতে ভোট কারচুপির অভিযোগ থাকার পর এ ঘটনা কমিশনের বিশ্বাসযোগ্যতাকে আরও ক্ষুণ্ন করেছে। তবে তা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার সরকার অস্বীকার করেছেন। বিরোধী রাজনৈতিক দলের সদস্যরা বিশ্বাস করেন, নির্বাচন কমিশন একটি দলের প্রতি পক্ষপাতী, তারা ক্ষমতাসীন দলের হয়ে কাজ করছে।

বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপির অন্য এমপিদের সঙ্গে জাতীয় সংসদ থেকে গত বছর শেষের দিকে পদত্যাগ করেন রুমিন ফারহানা। তিনি বলেছেন, আরেকটি লজ্জার নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার অব্যাহতভাবে ক্ষমতা ধরে রাখতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। নির্বাচন পর্যবেক্ষকদের এই তালিকা তাই প্রমাণ করে।

এরই মধ্যে আসন্ন নির্বাচনকে কেন্দ্র করে উত্তেজনা ‘বয়লিং পয়েন্টে’ উঠে গেছে। বিএনপি ও তার মিত্ররা নিয়মিত রাজপথে প্রতিবাদ বিক্ষোভ করছে। তারা নির্বাচন অনুষ্ঠানে নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার দাবি জানিয়ে আসছে। আওয়ামী লীগের টানা তিন মেয়াদের প্রথম মেয়াদে ২০১১ সালে এই ধরনের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আইনি ধারা বাতিল করে দেয় দেশের সর্বোচ্চ আদালত।

বাংলাদেশের শত শত কোটি ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানির প্রধান দুটি গন্তব্য হলো যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন। তারাসহ বৈশ্বিক শক্তিগুলো ঢাকায় বর্তমান সরকারের অধীনে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের সম্ভাব্যতা নিয়ে বার বার সংশয় প্রকাশ করছে। এই বছর যুক্তরাষ্ট্র একটি কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। তারা বলেছে, বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক নির্বাচনকে যারাই বাধাগ্রস্ত করবে, তাদের বিরুদ্ধে ভিসায় নিষেধাজ্ঞা দেবে যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু আভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক চাপ থাকা সত্ত্বেও তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনঃস্থাপনের দাবি প্রত্যাখ্যান করছে শেখ হাসিনার সরকার। পক্ষান্তরে তারা বলছে, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে তারা নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করেছে।

ওয়েস্টার্ন সিডনি ইউনিভার্সিটির রিসার্চ ফেলো মুবাশ্বার হাসানও বাংলাদেশে সুষ্ঠু নির্বাচন নিয়ে সন্দিহান। তিনি বলেন, ভুয়া পর্যবেক্ষক ব্যবহার করা হচ্ছে- কর্তৃত্ববাদী শাসকগোষ্ঠীর একটি সাধারণ কৌশল। তিনি বাংলাদেশে নির্বাচন পর্যবেক্ষকদের বর্তমান তালিকাকে এমন একটি চিহ্ন হিসেবে আখ্যায়িত করেন, যা বলে দেয় কমিশন অবাধ ও পক্ষপাতিত্বহীন নয়। আওয়ামী লীগ সম্ভবত এমন একটি নির্বাচন করার পরিকল্পনা করছে, যা এসব পক্ষপাতী পক্ষবেক্ষকরা অনুমোদন দেবে।

যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেটস ইউনিভার্সিটির রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর ড. আলী রীয়াজ বলেন, সরকার ও নির্বাচন কমিশনের বার বার দেওয়া ন্যায্যতার প্রতিশ্রুতি যদি সত্য হয়, তাহলে তাদেরকে আইন লঙ্ঘন করা বা কিছু পর্যবেক্ষক সংগঠনকে বেছে নেওয়ার প্রয়োজন হবে না। অন্য সব পদক্ষেপের সঙ্গে এই ঘটনাটি (পর্যবেক্ষক বাছাই) এমন একটি ইঙ্গিত যে, বর্তমান পরিস্থিতির অধীনে একটি অবাধ, সুষ্ঠু এবং গ্রহণযোগ্য নির্বাচন, যেখানে ভোটারদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত হবে- সরকার বা নির্বাচন কমিশনের লক্ষ্য তেমন নয়।

২০১৮ সালে নির্বাচনের সময় কমিশন বিদেশি পর্যবেক্ষকদের স্বাগত জানিয়েছিল। তবে তারা সেইসব পর্যবেক্ষক, যাদের কোনো অভিজ্ঞতা নেই বলে স্থানীয় এবং আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় রিপোর্ট প্রকাশ হয়েছে। ওইসব পর্যবেক্ষক নির্বাচনের ফলকে অবাধ ও সুষ্ঠু বলে সাফাই গেয়েছে। কিন্তু ওয়াশিংটন পোস্ট ওই নির্বাচনকে তুলনা করেছে উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে। ওই নির্বাচনে শতকরা ৯৬ ভাগ জয়ী হয়েছে আওয়ামী লীগ। ওয়াশিংটন পোস্ট বলেছে, এমন ঘটনা প্রত্যাশা করা যায় উত্তর কোরিয়ায়।

বাংলাদেশের সুপরিচিত একটি নির্বাচনী গ্রুপ হিসেবে পরিচিত জানিপপ। এর প্রেসিডেন্ট ড. নাজমুল আহসান কলিমুল্লাহ। তিনি বলেছেন, ২০১৮ সালে যেসব পর্যবেক্ষক এসেছিলেন তারা নির্বাচন পর্যবেক্ষকের বদলে ছিলেন ‘ইলেকশন ট্যুরিস্ট’। নির্বাচন পর্যবেক্ষক হতে হলে আপনার কিছু বৈশিষ্ট্য এবং ট্র্যাক রেকর্ড থাকতে হয়। স্পষ্টতই তাদের তা ছিল না।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ অধ্যায়ের নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেছেন, ২০১৮ সালের ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা নেওয়া উচিত বর্তমান নির্বাচন কমিশনের। বর্তমান যে আইন আছে তাতে কমিশনকে প্রচুর কর্তৃত্ব দিয়েছে। তারা নিরপেক্ষ এবং পক্ষপাতিত্বহীন পর্যবেক্ষক বাছাই করতে পারে, যাদের কোনো স্বার্থ নেই। এটা করতে ব্যর্থ হওয়া শুধু নির্বাচন পর্যবেক্ষণকে নিয়ে উপহাসই করা হবে না, কমিশন এরই মধ্যে যে বিশ্বাসযোগ্যতার সংকটের মুখোমুখি হচ্ছে, তা আরও গভীর ও প্রশস্ত হবে।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

নিয়ন্ত্রিত বোলিংয়ের পরও দলকে জেতাতে পারলেন না সাকিব

দলকে ফাইনালে তুলে যা বললেন মেসি

চাকরি দিচ্ছে মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক, থাকছে না বয়সসীমা

আর্জেন্টিনার প্রেসিডেন্টকে ইটপাটকেল নিক্ষেপ উত্তেজিত জনতার

আবু সাইদ হত্যা মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ আজ

কেন নিজের ‘বিকিনি’ ছবির পোস্টার ছিঁড়ে ফেলেন শর্মিলা?

বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের ৪ প্রতিনিধি যোগ দিলেন ছাত্রদলে

ধীরে ধীরে খেলে কি সত্যি ওজন কমে?

চীন সফরে কিম-পুতিনসহ ২৬ রাষ্ট্রপ্রধান

বিকেলে ব্যাংকে ঢুকে লুকিয়ে ছিল সহিদুল, রাতে ডাকাতির চেষ্টা

১০

সকালে ঘুম থেকে উঠতে কষ্ট হয়? মেনে চলুন এই ৬ টিপস

১১

মেসি ঝলকে ফাইনালে মায়ামি

১২

চাঁদা না দেওয়ায় গণঅধিকার নেতার হাতে ইউপি চেয়ারম্যান লাঞ্ছিত

১৩

মাদকসেবন করে মাতলামি করায় যুবকের কারাদণ্ড

১৪

আমাদের কেউ আলাদা করতে পারবে না: সুনীতা আহুজা 

১৫

রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের পদমর্যাদাক্রম নিয়ে পরবর্তী আপিল শুনানি ৪ নভেম্বর 

১৬

শহিদের সঙ্গে প্রেম-বিচ্ছেদের কারণ জানালেন কারিনা

১৭

গাজায় তীব্র রূপ ধারণ করেছে দুর্ভিক্ষ, অনাহারে মৃত্যু ৩১৩ জনের

১৮

রাজধানীতে লরির ধাক্কায় দুমড়ে-মুচড়ে গেল সিএনজি, নিহত ১

১৯

টিয়া পাখি নিয়ে ভিডিও করে বিপাকে শিক্ষিকা 

২০
X