মহান শিক্ষা দিবস উপলক্ষে এক আলোচনা সভায় বক্তারা যুগোপযোগী সর্বজনীন বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষানীতি প্রণয়ন করার ওপর গুরুত্ব আরোপ করে বলেছেন, শিক্ষা ক্ষেত্রে যে নৈরাজ্য চলছে তার প্রতিফলন ঘটছে সমাজে। ১৯৬২ সালে বাংলাদেশের মানুষ পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর গণবিরোধী শিক্ষানীতি বাতিল এবং সর্বজনীন বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষানীতি প্রণয়নের দাবিতে আন্দোলন করেছিল, তা আজও অপূর্ণ রয়ে গেছে। বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষার বদলে হেফাজতসহ ধর্মান্ধ গোষ্ঠীর সাথে আপসকামিতায় সরকার শিক্ষাকে সাম্প্রদায়িককরণ করেছ। বিগত পঞ্চাশ বছরে শিক্ষাব্যবস্হায় চলছে শিক্ষার সাম্প্রদায়িককরণ ও বাণিজ্যিকিকরণের নীতিমালা। এতে ধ্বংস প্রায় বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা।
শনিবার ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি (ডিআরইউ) মিলনায়তনে জাতীয় শিক্ষা ও সংস্কৃতি আন্দোলন কর্তৃক মহান শিক্ষা দিবস উপলক্ষে আয়োজিত এক সেমিনারে বক্তারা এ বক্তব্য উপস্থাপন করেন।
‘সর্বজনীন গণমুখী বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষানীতি প্রণয়ন : বর্তমান প্রেক্ষিতে, নাগরিক ভাবনা’ শীর্ষক সেমিনারে মুল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা ও গণযোগাযোগ বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ড. কাবেরী গায়েন। শিক্ষা ও সংস্কৃতি আন্দোলনের আহ্বায়ক একুশে পদকপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধা মাহমুদ সেলিমের সভাপতিত্বে ও সদস্য সচিব রুস্তম আলী খোকনের সঞ্চালনায় এ সেমিনারে আলোচনা করেন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ অধ্যাপক এ এন রাশেদা, অধ্যাপক জোবাইদা নাসরীন, ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সাবেক সাধারণ সম্পাদক রাজু আহমেদ, শিক্ষক নেতা অধ্যক্ষ আকমল হোসেন, লেখক আলী আকবর টাবি, সাবেক ছাত্রনেতা ও পরিবেশ বার্তার সম্পাদক ফেরদৌস আহমেদ উজ্জ্বল প্রমুখ।
আলোচনায় শিক্ষা ক্ষেত্রসহ সমাজের অসংগতি ও অরাজকতা নিরসনে সঠিক শিক্ষাপদ্ধতির প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্ব আরোপ করে বক্তারা বলেন, ২০১০ সালে প্রণীত শিক্ষানীতি সমাজের দাবি পূরণে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হচ্ছে। এখানে ধর্মীয় শিক্ষা যেমন ধর্মান্ধ মানুষ সৃষ্টি করছে তেমনি আধুনিক শিক্ষার নামে ইংরেজি শিক্ষা বাঙালী জাতির চেতনা পরিপন্থি আরেক ধরনের মানুষ সৃষ্টি করছে। শিক্ষা ক্ষেত্রে নৈতিকতার মান এমন পর্যায়ে শিক্ষাপ্রতিস্ঠান যুগোপযোগী বিজ্ঞান মনস্ক যুক্তিবাদী সৎ আদর্শিক মানুষ গড়ে তুলতে যথাযথ ভুমিকা পালন করতে পারছে না।
মূল প্রবন্ধে অধ্যাপক কাবেরী গায়েন বলেন, মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে ড. কুদরত ই খুদা শিক্ষা কমিশন শিক্ষা কমিশন সংবিধানের চার মুলনীতির সাথে সমন্বয় ঘটিয়ে লক্ষ্য স্হির করেছিল। তাতে জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র, দেশাত্মবোধও আলোকিত নাগরিকত্ব, নৈতিক মূল্যবোধ, সামাজিক রূপান্তরের হাতিয়ার হিসেবে শিক্ষা, অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য শিক্ষা, কায়িক শ্রমের প্রতি যথাযথ মর্যাদা, প্রাতিস্ঠানিক ও নেতৃত্বের দক্ষতা, মৌলিক গবেষণা ও সামাজিক অগ্রগতি, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অগ্রগতির জন্য শিক্ষা সন্নেবেশিত ছিল।
আলোচকরা বলেন, একটি বিজ্ঞানমনস্ক যুক্তিবাদী তারুণ্যের সমাজের বদলে বিভিন্ন সময়ে ক্ষমতাসীন সরকার পশ্চাৎপদ সমাজ গড়ে তুলেছে। হেফাজতের নিকট সব সরকারই আত্মসমর্পণ করে কওমি মাদ্রাসার শিক্ষাকে স্বীকৃত প্রদান করা হয়েছে। গ্রামাঞ্চলে কারিগরী শিক্ষার বদলে মাদ্রাসা শিক্ষার প্রসার ঘটিয়ে এমন এক সমাজ গড়ে তোলা হয়েছে, যে সমাজ চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের মতন যুগান্তকারী বৈশ্বয়িক পরিবর্তন মোকাবিলায় পুরোপুরি অক্ষম।
আলোচকরা আরও বলেন, একটি মননশীল ও বিজ্ঞানমনস্ক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে হলে সকল জাতি ধর্ম বর্ন নির্বিশেষে সবার জন্য গ্রহণযোগ্য একই ধারার শিক্ষানীতির বিকল্প নেই। কোনো একটি গোষ্ঠীকে খুশি করে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জন করা এই দেশকে শোষণহীন বৈষম্যহীন ও অসাম্প্রদায়িক ধারায় পরিচালনা করা অসম্ভব। বিগত বাহান্ন বছরে আমরা এই শিক্ষাব্যবস্থার দ্বারা একটি দুর্নীতি পরায়ণ ও সাম্প্রদায়িক বিকাশের ধারাকেই বিকশিত হতে দেখেছি। আজকে আমাদের নতুনভাবে সমাজকে বিশ্লেষণ করে তা মেরামত করতে হবে আর তার জন্য চাই একটি বিজ্ঞানমনস্ক সার্বজনিক একইধারার শিক্ষানীতি।
মন্তব্য করুন