সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক। আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন, নতুন নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল ও নির্বাচনে অংশগ্রহণের বিষয় নিয়ে কালবেলার সঙ্গে কথা বলেছেন তিনি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন এম এম মুসা। শ্রুতিলিখন: মুজাহিদুল ইসলাম -
কালবেলা : তৃণমূল বিএনপিতে যোগ দিয়েছেন শমসের মুবিন চৌধুরী এবং তৈমূর আলম খন্দকার। যারা পূর্বে বিএনপির রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে ছিলেন। বিষয়টিকে আপনারা কীভাবে দেখছেন?
সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স : এগুলো নিয়ে আমাদের কোনো মাথাব্যথা নেই। এটা নিয়ে আমরা উদ্বিগ্নও না এবং এটাকে আমরা কোনো ইস্যু মনে করি না। সরকার গণআন্দোলনে ভীত হয়ে পড়েছে। নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের জন্য জনগণের দাবি থেকে মানুষের দৃষ্টিকে ভিন্নখাতে প্রভাবিত করার জন্য তারা এগুলো করছে। নির্বাচনের নামে প্রহসন করার জন্য সরকার যে পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে তার অংশ এটি।
তারা তৃণমূল বিএনপি নাম দিয়ে যেগুলো করছে তা হাস্যকর। দলটি যিনি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তিনি মারা গেছেন তাই তার ব্যাপারে আমার কিছু বলার নেই। তবে এই দলে এখন যারা যোগদান করলেন তারা আমাদের দলের কেউ না। তারা কখনোই দলের কোনো প্রভাবশালী ব্যক্তি ছিল না। এসব করে তারা সরকারের পদলেহী দলে পরিণত হয়েছেন।
কালবেলা : নির্বাচন সামনে রেখে নতুন জোট গঠন হতেও দেখা যাচ্ছে...
সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স : বাংলাদেশে সক্রিয় যেসব রাজনৈতিক দল রয়েছে, যে দলগুলো নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত, তার ৯০ শতাংশ দল সরকারের পাতানো নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে না। এরই মধ্যে দলগুলো সে ঘোষণা দিয়েছে। বিএনপি নিজেও অনেক আগেই ঘোষণা দিয়েছে আমরা এই সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচনে অংশগ্রহণ করব না।
সরকার নির্বাচনী ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে দিয়েছে। তারা জনগণের অধিকারী বিশ্বাস করে না। তারা জনগণের ভোটের অধিকার ক্ষুণ্ন করে সাজানো ও পাতানো নির্বাচন করতে চায়। আর সে কারণেই আওয়ামী লীগ আজ জনবিচ্ছিন্ন হয়ে রাজনীতির নামে অপরাজনীতি করছে। তারা রাজনৈতিক দলগুলোকে ভাঙাগড়ার খেলায় মেতে উঠেছে। তারা নাম সর্বস্ব কিছু দল তৈরি করে, তাদের নিবন্ধন দিয়ে নির্বাচনে আনার পাঁয়তারা করছে। জনগণকে ধোঁকা দেওয়ার জন্য সরকার তৃণমূল বিএনপি নামে দল সৃষ্টি করেছে। তারা ভাবছে, এভাবে তারা জনগণকে এবং বহির্বিশ্বকে ধোঁকা দিতে পারবে। কিন্তু সেটি সম্ভব হবে না।
এসবই সরকারের প্রযোজিত এবং পরিচালিত নাটক। এই নাটকের চিত্রনাট্য লিখেছে সরকার। আর এই নাটক এখন মঞ্চস্থ হতে দেখছি। এই দলগুলো সরকারের হাতের পুতুল। সরকার যেভাবে চাবি দিচ্ছে তারা সেভাবেই ঘুরছে বা ঘুরবে। আওয়ামী লীগ রাজনীতিকে একটি অপরাধনীতির ধারায় নিয়ে গেছে। রাজনীতি সম্পর্কে জনগণের যে ধারণা ছিল, তা তারা নষ্ট করে দিয়েছে।
কালবেলা : সরকার যদি একটি নির্বাচন করেই ফেলে তখন আপনারা কী করবেন?
সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স : দেশের জনগণ আজ তাদের ভোটের অধিকার ফেরত চায়। তারা রাষ্ট্রের মালিকানা ফেরত চায়। আওয়ামী লীগ জনগণের ভোটের অধিকার হরণ করেছে এবং জনগণের কাছ থেকে দেশের মালিকানা কেড়ে নিয়েছে। জনগণ আজ ঐক্যবদ্ধ। ইউনিয়ন পর্যায় থেকে শুরু করে রাজধানী পর্যন্ত যে ব্যাপক আন্দোলন হচ্ছে- পদযাত্রা, গণমিছিল ও গণবিক্ষোভ এর মধ্য দিয়ে তার প্রকাশ ঘটছে। সমাবেশের মধ্য দিয়ে বিএনপির কর্মসূচিতে জনগণ ব্যাপকভাবে অংশগ্রহণ করছে। সরকার আর কোনো সাজানো পাতানো নির্বাচন করতে পারবে না। দেশে নির্বাচন হবে এবং সেই নির্বাচন হবে নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে।
দেশের জনগণই শুধু নয়, তাদের ভোট চুরির ব্যাপারটা আজ বিশ্বব্যাপী উন্মুক্ত হয়ে গেছে। বিশ্ববাসী আজ জেনে গেছে, এই সরকার নিরপেক্ষ নির্বাচন করতে চায় না। বিশ্ব জেনে গেছেন, এই সরকার সাজানো পাতানো নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করে আছে এবং তারা আবারও সেটা করতে চায়। বিশ্বে আজ যারা গণতন্ত্র নিয়ে কথা বলে, যারা মানবাধিকার নিয়ে কাজ করে সে সকল রাষ্ট্র বা সংস্থা এমনকি জাতিসংঘ পর্যন্ত বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে কথা বলছে। তারা বাংলাদেশের অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন দেখতে চায়।
আওয়ামী লীগ যদি অবাধ, নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচন করতে পারত তাহলে আজ বিদেশিদের বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে কথা বলতে হতো না। বিদেশিদের চাওয়া এবং বাংলাদেশের জনগণের চাওয়া আজ এক হয়ে গেছে।
কালবেলা : বিএনপির নেতাদের নামে অনেকগুলো মামলা চলমান রয়েছে। আপনাদের নেতাদের অনেকেই জেলেও রয়েছেন। এই পরিস্থিতিতে আপনারা আন্দোলনকে কীভাবে এগিয়ে নেবেন?
সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স : আওয়ামী লীগের এই ফ্যাসিবাদী নীতি, হামলা, মামলা সহ্য করেই গত ১৫ বছর আমরা রাজনীতি করছি। আমাদের চেয়ারপারসন দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া বাংলাদেশে সর্বাপেক্ষা জনপ্রিয় নেত্রী। এ পর্যন্ত একটি নির্বাচনেও তার পরাজয়ের কোনো ইতিহাস নেই। বেগম খালেদা জিয়া থেকে শুরু করে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান, মহাসচিব, স্থায়ী কমিটির সদস্য, ভাইস চেয়ারম্যান, সাংগঠনিক সম্পাদক, সম্পাদক, সদস্য... এমনকি একটি গ্রামের নেতাও এই সরকারের হামলা মামলা থেকে মুক্ত নয়।
গত ১৫ বছরে বিএনপির ৪৫ লাখেরও বেশি নেতাকর্মী এই সরকারের গায়েবি ও মিথ্যা মামলায় জর্জরিত হয়েছেন। এই সরকারের দ্বারা নির্যাতিত হয়েছেন। সম্প্রতি আমরা যখন নির্দলীয় সরকারের দাবিতে যুগপৎ আন্দোলনে রাস্তায় রয়েছি তখনই আমাদের আন্দোলনকে বিভ্রান্ত করার জন্য, আন্দোলনকে দমন করার জন্য আমাদের উপজেলা ও গ্রামপর্যায়ের নেতাকর্মীদের পর্যন্ত ব্যাপক ধরপাকড় করা হচ্ছে, মিথ্যা ও গায়েবি মামলা দেওয়া হচ্ছে। জেলা আদালত বলি বা হাইকোর্ট বলি সমস্ত আদালতগুলো আজ আমাদের নেতাকর্মীদের পদভারে জর্জিত। কিন্তু আমরা সেখানেও কোনো আশ্রয় পাচ্ছি না। সরকারের চাপে আদালতেও আমরা বিচার পাচ্ছি না। সেখানে বিচারের নামে অবিচার করা হচ্ছে। এগুলোকে মোকাবিলা করেই আমরা আন্দোলনে রয়েছি। আমাদের নেতাকর্মীরা সর্বোচ্চ ঝুঁকি নিয়ে এই আন্দোলনকে সফল করবেন এটাই আমাদের প্রত্যাশা ও অঙ্গীকার।
কালবেলা : আপনাদের দলের অনেকেই নির্বাচন করতে চাচ্ছেন বলে জানা যাচ্ছে। এটা কি আপনাদের দলের অভ্যন্তরীণ কোনো কোনো দলকে প্রকাশ করে?
সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স : বিএনপি একটি বিশাল রাজনৈতিক দল। এখানে হাজার হাজার নেতাকর্মী রয়েছে। সাংগঠনিকভাবে নেতৃত্বের প্রশ্নে সবাই একমত থাকবেন, এটা বলার কোনো অবকাশ নেই। কিন্তু আজ আন্দোলনের প্রশ্নে আমরা সকলেই একমত। আমরা এই সরকারকে আর ক্ষমতায় দেখতে চাই না। এই প্রতিহিংসা পরায়ণ, গণবিরোধী, গণতন্ত্র হরণকারী, ভোটের অধিকার হরণকারী সরকারের পদত্যাগ এবং নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে আমরা সকলেই একাত্মা।
কালবেলা : যাদের আপনারা দল থেকে বহিষ্কার করেছিলেন তারা ফিরে আসতে চাইলে আপনারা কি তাদের আবার দলে নেবেন?
সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স : বহিষ্কার করা হয়েছে কারণ তারা দলের শৃঙ্খলাবিরোধী কাজ করেছে। তারা এই সরকারের সঙ্গে আঁতাত করে আমাদের নীতিবিরুদ্ধ বিভিন্ন কাজে লিপ্ত ছিল। তারা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে সরকারের উদ্দেশ্য সফল করার চেষ্টা করেছে। এই কারণেই তাদের দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। যারা দলের শৃঙ্খলা বিরুদ্ধে কাজ করেছে তাদের ব্যাপারে দল জিরো টলারেন্সে রয়েছে। দলকে শক্তিশালী এবং সুশৃঙ্খল করার জন্য এবং আন্দোলনকে শক্তিশালী করার জন্য তাদের বহিষ্কার করা হয়েছে। দলের মধ্যে থেকে দলের নীতিনির্ধারণী বিষয়ে দ্বিমত পোষণ করার সুযোগ অবশ্যই রয়েছে তবে সেটা কোনোভাবেই এমন হতে পারে না যে দলের স্বার্থের বাইরে চলে যায়। এরপরেও কেউ যদি তার কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ত হয়ে দলের কাছে ক্ষমাপ্রার্থনা করে দলের কার্যক্রমে ফিরে আসতে চায় সেক্ষেত্রে দল হয়তো বিবেচনা করবে।
নির্বাচনকে কেন্দ্র করে জনগণের আন্দোলনকে বিভ্রান্ত করার জন্য সরকার নানা রকমের ষড়যন্ত্র করছে। সরকার নানা ধরনের পদক্ষেপ নিচ্ছে এবং নানা চক্রান্ত করছে। আমি আমার দলের নেতাকর্মী, সমর্থক, শুভাকাঙ্ক্ষী সকলের উদ্দেশ্যে এবং বাংলাদেশের জনগণের প্রতি আহ্বান জানাব- এসব ষড়যন্ত্রে কর্ণপাত না করে, এসবে দৃষ্টি না দিয়ে চলমান যে আন্দোলন সেই আন্দোলনকে আরও বেগবান করবেন। গ্রাম ও শহরের জনগণকে সংগঠিত করার জন্য এবং আন্দোলনকে চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য আমরা ১৫ দিনব্যাপী যে পরিকল্পনা কর্মসূচি ঘোষণা করেছি সেই কর্মসূচিতে সকলেই সম্পৃক্ত হবেন। সকল বাধা উপেক্ষা করে, সকল দমনপীড়ন উপেক্ষা করে আপনারা এই কর্মসূচিতে সম্পৃক্ত হবেন। চূড়ান্ত আন্দোলনের মধ্য দিয়ে আমরা আমাদের কাঙ্ক্ষিত বিজয় অর্জন করতে পারব এটাই আমাদের প্রত্যাশা।
মন্তব্য করুন