শামসুল হুদা
প্রকাশ : ১১ মার্চ ২০২৪, ১১:৩৪ এএম
আপডেট : ১১ মার্চ ২০২৪, ১১:৩৮ এএম
অনলাইন সংস্করণ
শামসুল হুদার বিশেষ সাক্ষাৎকার

কৃষিনির্ভর দরিদ্র জনগোষ্ঠীর কাছ থেকে জমি কেড়ে নেওয়া হচ্ছে

এএলআরডির নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা। ছবি : কালবেলা
এএলআরডির নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা। ছবি : কালবেলা

শামসুল হুদা নির্বাহী পরিচালক, অ্যাসেসিয়েশন ফর ল্যান্ড রিফর্ম অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (এএলআরডি)। বাংলাদেশের ভূমি ব্যবহার, খাসজমি, ভূমি সংস্কার, ভূমিতে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অধিকারসহ নানা বিষয়ে কালবেলার সঙ্গে কথা বলেন তিনি।

কালবেলা : পরিকল্পনামন্ত্রী আলোচনা সভায় বলেছিলেন, ঢাকার বিভিন্ন জায়গায় দরিদ্র শ্রেণিকে উচ্ছেদ করে সেখানে ধনী ব্যক্তিদের জমির মালিকানা দেওয়া হয়েছে। মন্ত্রীর এ মন্তব্যের তাৎপর্য কী?

শামসুল হুদা : পরিকল্পনামন্ত্রী সত্য কথাটাই বলেছেন। সরকারের উচ্চ পদে থেকেও এ সত্য কথাটি এভাবে উচ্চারণ করার জন্য তাকে ধন্যবাদ জানাই। বিষয়টি শুধু রাজউকের জন্য প্রযোজ্য তা নয়, বরং ভূমি প্রশাসনসহ সমগ্র প্রশাসনব্যবস্থার সাধারণ চিত্র এটি। দরিদ্রদের ক্রমাগত ক্ষমতাহীন করা এবং তাদের উচ্ছেদ করা, তাদের অবহেলা করা এবং তাদের উপেক্ষা করা এবং দরিদ্র শ্রেণিকে অসম্মান করাটাই আমাদের প্রশাসন ও বিত্তবানদের বৈশিষ্ট্য। তবে কিছু ব্যতিক্রম অবশ্যই আছে।

দেশে এমন কিছু আইনকানুন বা বিধি-বিধান রয়েছে যেগুলো বলা যায় দরিদ্রবান্ধব। কিন্তু কখনোই সেই সব বিধি-বিধান বাস্তবায়নের মুখ দেখে না। মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে আমাদের দেশে যে পরিবর্তনগুলো হওয়ার কথা ছিল নানা কারণে সেগুলো হয়নি। তবে ৭২ সাল থেকে খাসজমি কেন্দ্রিক কিছু পরিবর্তনের সূচনা হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু এই প্রচেষ্টাটি শুরু করেছিলেন। কিন্তু সে সময় বিস্তারিত এবং সুবিন্যস্ত নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়তো সম্ভব হয়নি। পরবর্তীকালে সেই নীতিমালা প্রণয়ন করা সম্ভব হয়েছিল। কিন্তু কোনো সরকারই সেই নীতিমালা বাস্তবায়নে অগ্রসর হয়নি। নীতিমালাটি কলেবরে ক্রমাগত ছোট হতে হতে এখন প্রায় অকার্যকর অবস্থায় বহাল আছে। দরিদ্রদের পক্ষে যে বিধানগুলো ছিল সেগুলো হয় সংকুচিত হয়েছে অথবা ক্রমাগত দুর্বল থেকে দুর্বলতর হয়েছে। এক সময় এই বিধি-বিধানগুলো উধাও হয়ে গেছে। নারীদের পক্ষেও কিছু বিধি-বিধান ছিল কিন্তু সেগুলোও বেশির ভাগ ক্ষেত্রে কার্যকর হয়নি।

এই নীতিমালায় নারীদের বাড়তি বৈষম্যের শিকার হতে হয়। সেখানে বিধান রাখা হয়েছে- নারীদের খাস জমি দেওয়া যাবে, কিন্তু শর্ত হচ্ছে তার সক্ষম পুত্র সন্তান থাকতে হবে। দরিদ্র এবং কৃষি জীবিকার ওপর নির্ভরশীল সকল নারীর জন্য এটা প্রযোজ্য হতে পারে না। নারী বিধবা হতে পারেন, তিনি নিঃসন্তান হতে পারেন, তিনি কন্যা সন্তানের মা হতে পারেন। সুতরাং সক্ষম পুত্র সন্তান থাকতে হবে এই বিধানটি বৈষম্যমূলক। আমরা গত ২০-৩০ বছর ধরে প্রচেষ্টা চালিয়েও এই বিধানটি পরিবর্তন করতে পারিনি।

আমাদের কৃষি জমিকে যেভাবে সুরক্ষা দেওয়া দরকার আমরা কি সেভাবে সুরক্ষা দিচ্ছি? দিনে দিনে আমাদের কৃষি জমি হারিয়ে যাচ্ছে। প্রতি বছর গড়ে এক শতাংশ করে আমাদের কৃষি জমি কমে যাচ্ছে।‌

প্রতি বছর আমরা যে কৃষি জমি হারাচ্ছি তার মধ্যে সম্পূর্ণটাই যে অপ্রয়োজনীয় তা আমি বলব না। যেহেতু আমাদের দেশের জনসংখ্যা প্রতিনিয়ত বাড়ছে, নগরায়নের প্রক্রিয়া চলছে, শিল্পায়ন এবং রাস্তাঘাটের পরিমাণ বাড়ছে ফলে এসবের কারণে কৃষি জমির ওপর হাত পড়ছে। এগুলোকে যদি আমরা প্রয়োজনীয় বলি তবুও যতটা প্রয়োজনীয় তার চেয়ে বেশি পরিমাণ জমি অপ্রয়োজনীয় কাজে নষ্ট করে ফেলা হচ্ছে। অর্থাৎ আমাদের কৃষি জমির ওপর এক ধরনের নির্দয় আক্রমণ চলছে। হাউজিংয়ের নামে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে হাজার হাজার একর কৃষি জমি নষ্ট করে ফেলা হচ্ছে। ইটের ভাটা এবং সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে কৃষি জমি নষ্ট করা হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী বহুবার ঘোষণা করেছেন দুই ফসলি বা তিন ফসলি কৃষি জমিতে কোনো প্রকল্প নেওয়া যাবে না এবং বিশেষ প্রয়োজনে দরকার হলে সরকারের অনুমতি নিতে হবে। কিন্তু আমাদের জানামতে অনেক ক্ষেত্রে এই নির্দেশনা মানা হয়নি এবং মানা হচ্ছে না।

আমরা কৃষি জমি হারাচ্ছি, আর নিজেদেরই বিপদের মুখে ঠেলে দিচ্ছি। কৃষির ওপর নির্ভরশীল দরিদ্র জনগোষ্ঠীর কাছ থেকেই এসব জমি কেড়ে নেওয়া হচ্ছে। যেমন- খাস জমি ভূমিহীনদের দেওয়ার নীতি থাকলেও এখন শতকরা ৮০-৯০ ভাগ খাস জমিভূমিহীনদের দেওয়া হচ্ছে না। প্রশাসন থেকে বলা হচ্ছে, আমরা খাস জমি ভূমিহীনদেরই দিচ্ছি। তাদের ঘরবাড়ি বানিয়ে দিচ্ছি, থাকার জায়গা দিচ্ছি। কিন্তু এসব প্রকল্পের বিভিন্ন জায়গায় আমরা লক্ষ্য করেছি, যাদের দেওয়া হচ্ছে বলে দাবি করা হচ্ছে অনেকে শুধু একটি ঘরই পেয়েছেন আর কিছু নয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে একটি ঘরের বাইরে অতিরিক্ত কোনো জমি না থাকায় সেটা বসবাসের জন্য তেমন উপযোগী নয় এবং প্রকৃতপক্ষে কিছুদিন পর তারা ওই ঘরে আর বসবাসও করেন না। কারণ জীবন ও জীবিকার জন্য তাদের অন্যত্র চলে যেতে হয়। ওই ঘর তাদের আর কোনো কাজে লাগে না। এ ছাড়া কিছু ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের অনিয়ম ও দুর্নীতির কথাও শোনা যায়।

কালবেলা : চরাঞ্চলের খাস জমিগুলোর ব্যবস্থাপনা কীভাবে করা হয়?

শামসুল হুদা : আমাদের চর এলাকায় হাজার হাজার একর জমি রয়েছে যেগুলো মূলত কৃষি জমি। পটুয়াখালী, ভোলা, লক্ষ্মীপুর, নোয়াখালীসহ উপকূলীয় বিভিন্ন জেলা এবং উত্তরবঙ্গে কিছু জেলায় চর রয়েছে। কৃষি হচ্ছে সেখানকার মানুষের জীবিকার প্রধান অবলম্বন। এসব জমিতে কৃষির আবাদ হচ্ছে কিন্তু এসব জায়গার দিয়ারা জরিপ সময় মতো হয় না। দিয়ারা জরিপ না হওয়ার কারণে এসব ভূমি বন্দোবস্ত দেওয়া হয় না। ফলে অত্যন্ত প্রভাবশালী এবং ক্ষমতাবান একটি শ্রেণি এসব জমি দখলে রেখেছে। ক্ষমতাবানদের কৃষি মজুর হিসেবে ভূমিহীনরা সেখানে কাজ করে। প্রভাবশালী শ্রেণির দয়া এবং অনুগ্রহের ওপর জীবন জীবিকা নির্ভর করে ভূমিহীনদের। যেসব এলাকায় ভূমিহীনরা সচেতন ও সংঘবদ্ধ হয়ে নিজেদের সংগঠন গড়ে তোলে, প্রশাসনের কাছে গিয়ে তাদের দাবি দাওয়া জানায়, আবেদন করে এবং দরখাস্ত করে তখন ওই প্রভাবশালী গোষ্ঠীর লাঠিয়ালরা তাদের ওপর অত্যাচার করে। এরকম একাধিক ঘটনা আমাদের জানা আছে যেখানে হত্যা পর্যন্ত হয়েছে। কিন্তু এসব ঘটনার কোনো তদন্ত হচ্ছে না, কোনো বিচার হচ্ছে না। পুলিশ মামলা নিচ্ছে না। অথচ নীতিমালা ওই কৃষি খাস জমি ভূমিহীন নারী-পুরুষদের মধ্যে স্থায়ীভাবে বন্দোবস্ত দেওয়ার কথা।

কালবেলা : আমরা জানি পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী, ধর্মীয় সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী বা দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জমি বেশি দখল করা হয়। আপনার মূল্যায়ন কী?

শামসুল হুদা : অবশ্যই! ধর্মীয় সংখ্যালঘু, প্রান্তিক দরিদ্র মানুষ এবং সমতলের আদিবাসীদের জমি বেশি জবর দখলের শিকার হয়। পাহাড়ের আদিবাসীদের জমিও দখলের শিকার হয় তবে সেটা অন্য ইতিহাস। সেখানে চুক্তি হয়েছে কিন্তু চুক্তির বাস্তবায়ন যথাযথভাবে হচ্ছে না, ভূমি কমিশন হয়েছে সেটা কার্যকর হচ্ছে না। এখন শুধু ভূমিহীনরা নয় বরং প্রান্তিক ও দরিদ্র কৃষকরাও বিপন্ন। তাদের জমিগুলো দখল হয়ে যাচ্ছে বিভিন্ন কোম্পানির নামে। দখল হচ্ছে বিভিন্ন করপোরেট প্রতিষ্ঠানের নামে এবং কখনো কখনো অধিগ্রহণও হচ্ছে। অধিগ্রহণ হচ্ছে কোনো একটি প্রকল্পের নামে। যে প্রকল্পের জন্য জমির প্রয়োজন ৫ একর সেখানে অধিগ্রহণ করা হচ্ছে ১৫ একর। এর সঙ্গে আমাদের আমলাতন্ত্রের একটি অংশ খুবই সক্রিয়ভাবে যুক্ত।

আমি পুরো আমলাতন্ত্রকে দায়ী করব না, তবে আমলাতন্ত্রের একটি অংশ ব্যাপকভাবে দুর্নীতিগ্রস্ত। আমরা যে জমির জবর দখল বা প্রান্তিক মানুষের জমির ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা নিয়ে কথা বলছি তার সঙ্গে দুর্নীতির একটি বড় সম্পর্ক রয়েছে। আপনি যদি দেশের উত্তর, দক্ষিণ বা পূর্ব-পশ্চিম যে কোনো দিকে হাইওয়ে ধরে যেতে থাকেন, তখন দেখবেন দুপাশে অনেক জমিতে সাইনবোর্ড দিয়ে রাখা হয়েছে— এটা অমুক শিল্প মালিক গোষ্ঠীর জমি। হাউজিং প্রকল্পের জন্য সংরক্ষিত। এসব জমি পড়ে আছে। এই জমিগুলো কৃষি জমি - অধিগ্রহণ করে নেওয়া হয়েছে অথবা কিনে নেওয়া হয়েছে। কেনা হয়েছে অত্যন্ত কম দামে। কম দামে কিনে তারা এই জমি দখলে নিয়েছে। এখানে কোনো এক সময় শিল্প গড়ে উঠবে বা আবাসন গড়ে উঠবে।

আমাদের ভূমি ব্যবস্থাপনায় এক ধরনের অরাজকতা বিরাজ করছে। ভূমি ব্যবস্থাপনার এই অরাজকতাটা আমরা উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছি। আমরা আমাদের ভূমি প্রশাসন বা ভূমি ব্যবস্থাপনাকে সংস্কার করার উল্লেখযোগ্য কোনো উদ্যোগ গত ৫০ বছরেও দেখিনি। উপনিবেশিক আমলে শাসকদের রাজস্ব আয়ের অন্যতম উৎস ছিল ভূমির কর। ভূমি রাজস্বকে তারা যেভাবে ব্যবহার করেছে সেখানে তারা ভূমি ব্যবস্থাপনাকে মোটামুটি একটি সচল, সক্রিয় এবং দক্ষ ভাবেই গড়ে তোলার চেষ্টা করেছিল। তাদের স্বার্থেই এটা প্রয়োজন ছিল। কিন্তু ৪৭ পরবর্তী সময়ে সেটার আর কোনো সংস্কার করা হয়নি। কোনো সংস্কার ছাড়া যে কোনো একটি যন্ত্র যদি দীর্ঘদিন ব্যবহার করা হতে থাকে সেটা যেমন ধীরে ধীরে নষ্ট হয়ে যায় তেমনি প্রশাসন যন্ত্রটিও সংস্কার না হলে ক্রমাগত নষ্ট হতে থাকে। আমি শুধু ভুমি প্রশাসনের কথা বলব না, বরং সামগ্রিকভাবে গোটা জনপ্রশাসনের সংস্কার প্রয়োজন।

কালবেলা : স্বাধীনতার পরেও আমরা অনেক সময় পেয়েছি। এই দীর্ঘ সময়ে আমরা ভূমি ব্যবস্থাপনার কোনো সংস্কার করিনি কেন?

শামসুল হুদা : ভূমি সংস্কারটাকে সব সময় আমরা এড়িয়ে গেছি। এড়িয়ে গেছি প্রধানত দুইটি কারণে। একটি কারণ হচ্ছে- ভূমি প্রশাসন থেকে শুরু করে যারা প্রশাসনের উচ্চপদে ছিলেন তাদের ব্যাপক অংশ ছিলেন সংস্কার বিরোধী। তারা মূলত সমাজের সেই শ্রেণি থেকে আসা মানুষ যে শ্রেণি ভূমি সংস্কার না হলে বেশি লাভবান হয়। অর্থাৎ তাদের সামাজিক প্রভাব, সুবিধা, ধরে রাখতে ভূমির ওপর তাদের মালিকানা গুরুত্বপূর্ণ বিবেচিত হয়। ভূমি সংস্কারের একটি মৌলিক বিষয় হচ্ছে, ভূমির উপরে যার জীবিকা নির্ভর করে না, যে ভূমির আয় তার প্রধান উপার্জনের উৎস নয়— সেই ভূমি তার থাকার কোনো ধরনের যুক্তি নেই। যিনি ভূমিতে রয়েছেন, যিনি ভূমিতে কাজ করেন এবং শ্রম দেন, ওই ভূমির ওপর যাদের জীবিকা নির্ভর করে ভূমির মালিকানা তাদের কাছেই থাকা উচিত। ভূমি সংস্কারের মূল লক্ষ্য এটি। কিন্তু এই আমলারা এবং সমাজের বিত্তবান শ্রেণি, উঠতি ধনিকরাও এই অধিকার ছাড়তে রাজি নয়।

কালবেলা : ভারতে আমরা ভূমি সংস্কার দেখেছি। সেখানেও প্রভাবশালী এবং ধনীকশ্রেণি ক্ষমতায় ছিল অথচ সেখানে সংস্কার হলো কীভাবে?

শামসুল হুদা : আমরা লক্ষ্য করলে দেখব- ভারতে মূলত সেসব রাজ্যে ভূমি সংস্কার হয়েছে যেখানে বাম প্রগতিশীল একটি সরকার ক্ষমতায় দীর্ঘদিন আসীন ছিল। তাদের অনেকে হয়তো সমাজের কোনো সুবিধাভোগী শ্রেণি থেকে এসেছেন কিন্তু তারা আদর্শগতভাবে সেই শ্রেণি থেকে নিজেদের বিচ্ছিন্ন করেছেন। পশ্চিমবাংলার জ্যোতি বসু থেকে শুরু করে এরকম অনেককেই পাওয়া যাবে যারা নিজেদের শ্রেণির স্বার্থ নয় বরং দেশের দরিদ্র এবং প্রান্তিক শ্রেণির মানুষের স্বার্থ নিয়ে কাজ করেছেন। কেরালা বা পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যে যে সংস্কারগুলো হয়েছে অন্যান্য রাজ্যগুলোতে হয়তো সে ধরনের সংস্কার হয়নি। কিন্তু কৃষির অন্যান্য ক্ষেত্রে সংস্কার সেখানে হয়েছে। ভারতের অনেক জায়গায় ভূমি সংস্কার না হওয়ার কারণে কৃষকদের ক্ষোভ আমরা দেখেছি। ভারতে কৃষকদের সাম্প্রতিক আন্দোলন আমরা দেখেছি। কৃষকরা ১৪ মাসব্যাপী আন্দোলন করে তাদের ক্ষোভ, দাবির কথা প্রকাশ করেছেন। কৃষক বিরোধী বেশ কিছু আইন বাতিল করার দাবি পূরণের পরই তারা মাঠ ছেড়েছেন। ভারতে এটি সম্ভব হয়েছে কারণ বিভিন্ন সংগঠনের মধ্যে ঐক্য এবং সংহতি তারা গড়ে তুলতে পেরেছিলেন। ভারতের বাইরে যে প্রবাসী ভারতীয়রা থাকেন তারাও নানাভাবে এই আন্দোলনে সমর্থন দিয়েছেন।

আমাদের দেশে শক্তিশালী কৃষক সংগঠন না থাকাটাও ভূমি সংস্কার না হওয়ার একটি অন্যতম কারণ। ভূমি সংস্কারের জন্য এখনো শক্তিশালী কোনো সামাজিক বা রাজনৈতিক চাপ তৈরি করা সম্ভব হয়নি। প্রবলভাবে তেমন কোনো জনমত তৈরি করা সম্ভব হয়নি। আমরা যারা বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এসব বিষয় নিয়ে কাজ করি তারা কথা বলতে পারি, চেষ্টা করতে পারি, বিভিন্ন ছোটখাট সফলতা হয়তো আমরা পাই, কিন্তু সামগ্রিকভাবে সিস্টেম পরিবর্তন করার ক্ষমতা সামাজিক সংগঠনের এককভাবে নেই।

কালবেলা : আগে ভূমিতে ছোট ছোট মালিকানা দেখা যেত। এখন দেখা যাচ্ছে ভূমি করপোরেট প্রতিষ্ঠানের মালিকানায় চলে যাচ্ছে অথবা রাষ্ট্রীয় অধিগ্রহণে চলে যাচ্ছে। এটি কতটা টেকসই উন্নয়ন মডেল?

শামসুল হুদা : ভূমি করপোরেট মালিকানায় চলে যাওয়ার কারণে ক্রমাগত বৈষম্য অনেক বৃদ্ধি পাচ্ছে। আমাদের অর্থনীতিবিদ ও গবেষকরা দেখিয়েছেন, আমাদের দেশে দৃশ্যমান অনেক উন্নয়ন হয়েছে। বড় বড় বিল্ডিং হয়েছে, ব্রিজ হয়েছে, অনেক রাস্তা হয়েছে। মেট্রোরেল এবং টানেল হয়েছে। এগুলো অবশ্যই উন্নয়নের অংশ কিন্তু এটাই যে একমাত্র উন্নয়ন তা নয়। বাংলাদেশে দরিদ্র শ্রেণির মানুষের জীবনমান ক্রমাগত নিচের দিকে নেমে যাচ্ছে। সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায়ে যারা রয়েছেন তাদের সঙ্গে দরিদ্র শ্রেণির আয় বৈষম্য, ব্যয়-বৈষম্য এবং সুযোগ-সুবিধার বৈষম্য এখন গত ৪-৫ দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ। ক্রমাগত বৈষম্য বেড়েই চলেছে যা অবশ্যই গভীর আশঙ্কার কারণ।

আমাদের অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা, ভূমি ব্যবস্থাপনা এবং বণ্টনব্যবস্থা ব্যাপক বৈষম্যের শিকার। সব ক্ষেত্রে বৈষম্য এমন একটি পর্যায়ে চলে গেছে যে অর্থ না থাকলে সঠিক বিচারটিও পাওয়া যায় না। একজন মানুষ বিচার পেতে গেলে তাকে আদালতে যেতে হবে। কিন্তু সেই আদালত পর্যন্ত যাওয়ার সামর্থ্যই হারিয়ে ফেলছে অসংখ্য মানুষ।

পুলিশ মামলা নেবে না। একজন দরিদ্র বা অসহায় মানুষ মামলা দিতে গেলে তার মামলা নেওয়া হয় না। কিন্তু অর্থনৈতিকভাবে, সামাজিকভাবে এবং রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী হলে তার মামলা পুলিশ নেয় সেই মামলার সারবস্তু যেমনই হোক। গরিব অসহায় মানুষের মামলা কোনোভাবে পুলিশ নিলেও দেখা যায় মামলার তদন্ত হচ্ছে না। আবার তদন্ত হলে প্রকৃত আসামি চার্জশিট থেকে উধাও হয়ে যাচ্ছে। সমাজে বিচার বৈষম্য রয়েছে এবং বাড়ছে, শিক্ষায় বৈষম্য বেড়ে চলেছে এবং ভোগের বৈষম্য অনেক দ্রুত কল্পনার চেয়ে দ্রুত গতিতে বাড়ছে। আর এই বৈষম্য দিনে দিনে বেড়ে সমাজে অসহনীয় ভারসাম্যহীনতা সৃষ্টি হবে।

কালবেলা : বিচার ব্যবস্থার মধ্যে সবচেয়ে জট পড়ে আছে ভূমিসংক্রান্ত মামলায়। লাখ লাখ মামলা বিচারাধীন। ভূমিসংক্রান্ত মামলা এভাবে জমলো কেন এবং এর কী কোনো সমাধান নেই?

শামসুল হুদা : নিম্ন আদালত এবং উচ্চ আদালত মিলে ভূমিসংক্রান্ত প্রায় ৩৫ লাখ মামলা বিচারাধীন রয়েছে। এর মধ্যে ফৌজদারি এবং দেওয়ানী দুই ধরনের মামলায় রয়েছে। বিভিন্ন তথ্য প্রমাণ থেকে আমরা জানি এই মামলার প্রায় ৮০ শতাংশই ভূমিসংক্রান্ত। এখানে ভূমি সংস্কারের বিষয়টি চলে আসে। মুক্তিযুদ্ধের পরের প্রথম ১০ বছরে আমরা যদি ভূমি সংস্কারের বিষয়টিকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারে নিয়ে আসতে পারতাম তাহলে আজ এই অবস্থার সৃষ্টি হতো না।

ভূমি বিরোধের অনেক বিষয়ই মালিকানাসংক্রান্ত। দাবি পাল্টা দাবি এবং ভাগ বাটোয়ারাসংক্রান্ত। বহু মামলা দখল এবং অবৈধ দখলসংক্রান্ত। সুতরাং এই বিষয়গুলো তৈরি হয়েছে আমরা ভূমি ব্যবস্থা সংস্কার না করার কারণেই। আমাদের প্রয়োজন ছিল বিচার ব্যবস্থার দিকে আরো নজর দেওয়া। সাধারণ মানুষ যাতে সহজে এবং স্বল্প খরচে বিচার পায় সেজন্য বিচার ব্যবস্থার সংস্কার প্রয়োজন ছিল। ভূমিসংক্রান্ত এবং অন্য সব মামলার জন্য সময়সীমা নির্দিষ্ট করে দেওয়া প্রয়োজন। কোনো ধরনের মামলা কতদিনের মধ্যে নিষ্পত্তি করতে হবে।

অনেক মামলা হয় ভুয়া কাগজপত্রসংক্রান্ত কারণে। ভুয়া দলিল এবং ভুয়া আমলনামার এসব মামলা বছরের পর বছর ধরে চলতে থাকে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ভূমি প্রশাসনের দুর্নীতিগ্রস্ত একটি অংশের সহযোগিতা থাকে। ভূমি প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরের অনেকেই এসব অবৈধ কাজে সহযোগিতা করে। তাদের এই অন্যায় তৎপরতার কারণেই বিভিন্ন ধরনের দালাল ও প্রতারকরা ভুয়া দলিল ও কাগজপত্রগুলো তৈরি করতে পারে। এসব বিষয় বিচার ব্যবস্থায়ও বড় ধরনের সমস্যা তৈরি করছে। একই জমি একাধিক একদিকে কিছু আইনি বিধি-বিধানের পরিবর্তন দরকার আরেকদিকে প্রতিষ্ঠানগুলোকে সক্রিয় এবং অত্যন্ত স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতার সঙ্গে কাজ করার পরিবেশ তৈরি করা প্রয়োজন। প্রশিক্ষণ দিয়ে ভূমি প্রশাসন দক্ষ এবং সৎ লোকবল গড়ে তোলা দরকার।

শ্রুতিলিখন- মুজাহিদুল ইসলাম

[ নিবন্ধ, সাক্ষাৎকার, প্রতিক্রিয়া প্রভৃতিতে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। দৈনিক কালবেলার সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে নিবন্ধ ও সাক্ষাৎকারে প্রকাশিত মত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির ব্যাখ্যা বা বিশ্লেষণ, তথ্য-উপাত্ত, রাজনৈতিক, আইনগতসহ যাবতীয় বিষয়ের দায়ভার লেখকের, দৈনিক কালবেলা কর্তৃপক্ষের নয়। ]
কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

রাতেই ৬০ কিমি বেগে ঝড়-বৃষ্টির শঙ্কা

‘প্রচণ্ড গরমে’ ক্লাসেই অজ্ঞান হলো শিক্ষার্থী

চট্টগ্রামে গণপরিবহন ধর্মঘট স্থগিত

ক্লাস চলাকালে খুলে পড়ল সিলিং ফ্যান, আহত শিক্ষার্থী

থাইল্যান্ড সফর শেষে সোমবার দেশে ফিরবেন প্রধানমন্ত্রী 

কাপ্তাইয়ে বৃষ্টির জন্য নামাজ আদায়

হাকালুকি হাওরে ধান কাটার ধুম

একুশে পদকপ্রাপ্ত বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ প্রণব বড়ুয়া আর নেই

রানা প্লাজার ধসে ১১৩৬ মৃত্যু / আরও ছয়জনের সাক্ষ্যগ্রহণ 

যুদ্ধের মধ্যেই বিক্ষোভে উত্তাল ইসরায়েল, চরম বিপাকে নেতানিয়াহু

১০

মানুষের মুক্তির জন্য জীবন উৎসর্গ করেছেন সরদার ফজলুল করিম

১১

বিরোধীদল নিধনে বেপরোয়া কর্মকাণ্ড চলছে : মির্জা ফখরুল

১২

নিউইয়র্কে গুলিতে ২ বাংলাদেশি নিহত, বাড়িতে শোকের মাতম

১৩

প্রাথমিকের শিক্ষক নিয়োগে তৃতীয় ধাপে উত্তীর্ণদের বিশেষ নির্দেশনা

১৪

চলতি বছর ডেঙ্গুতে ৪০ হাজার মৃত্যুর শঙ্কা

১৫

যে কারণে ভোট শেষ হওয়ার আগেই নির্বাচন স্থগিত 

১৬

‘নিরাপত্তায় জাতীয় নির্বাচনকেও ছাড়িয়ে যাবে উপজেলা ভোট’

১৭

কালবৈশাখী ঝড়ে লন্ডভন্ড শ্রীমঙ্গল

১৮

মিল্টন সমাদ্দারের বিরুদ্ধে অভিযোগ আমলে নিয়েছে মানবাধিকার কমিশন

১৯

ইউএস-বাংলা গ্রুপে ম্যানেজার পদে নিয়োগ, কর্মস্থল ঢাকা

২০
*/ ?>
X