অধ্যাপক ড. এ বি এম শওকত আলী
প্রকাশ : ১৪ মে ২০২৫, ০৫:৪৩ পিএম
অনলাইন সংস্করণ

শিক্ষার ওপর ভ্যাট নয়, প্রয়োজন সহযোগিতা

অধ্যাপক ড. এ বি এম শওকত আলী। ছবি : সংগৃহীত
অধ্যাপক ড. এ বি এম শওকত আলী। ছবি : সংগৃহীত

বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থায় গত দুই দশকে গুরত্বপূর্ণ পরিবর্তন এসেছে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়সমূহকে কেন্দ্র করে। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আসনসংখ্যা সীমিত ফলে প্রতি বছর বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষার জন্য বিকল্প পথ হিসেবে বেছে নেয় বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে। এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলো শুধু শিক্ষা প্রদানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয় বরং দক্ষ মানবসম্পদ গঠনের পাশাপাশি গবেষণা, উদ্ভাবন এবং আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার উপযোগী শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলার ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলেছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে, এই গুরুত্বপূর্ণ খাতটির ওপর সরকার ১৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপ করেছে, যা শিক্ষার্থী এবং তাদের পরিবারের অপ্রয়োজনীয় আর্থিক চাপ সৃষ্টি করছে।

শিক্ষা কখনোই বিলাসবস্তু নয় এটি মৌলিক মানবাধিকার। একটি রাষ্ট্রের উন্নয়ন, অগ্রগতি ও আত্মনির্ভরশীলতার ভিত্তি। শিক্ষা খাতে ভ্যাট আরোপ মানে সেই অধিকারকে আর্থিক শর্ত বেঁধে দেওয়া। বিশেষ করে অধিকাংশ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় অলাভজনক প্রতিষ্ঠানের নীতিতে পরিচালিত হচ্ছে। শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে প্রাপ্ত অর্থ গবেষণা, বৃত্তি ও অবকাঠামো উন্নয়নের কাজে ব্যয় করা হচ্ছে। সেখানে ১৫ শতাংশ ভ্যাট অযৌক্তিক ও প্রতিকূল সরকারি সিদ্ধান্ত হিসেবেই প্রতীয়মান হয় যা উচ্চশিক্ষার পথ রোধে সামানে এসে দাঁড়ায়। উচ্চশিক্ষার পরিসরে সীমিত কর তোলে।

বিশ্বের উন্নত দেশগুলো বেসরকারি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বিকাশ ও উন্নয়নে সরকার সক্রিয় ভূমিকা পালন করে। জাপানের কথাই ধরা যাক সেখানে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে দেশের মোট বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় ৭৫ শতাংশ। সরকার এই প্রতিষ্ঠানগুলোকে করছাড়, গবেষণা অনুদান এবং শিক্ষার্থীদের জন্য ফি কমিয়ে দেওয়ার মতো নানা সুযোগ সরকারের পক্ষ থেকেই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে দেওয়া হয়। দক্ষিণ কোরিয়া উচ্চশিক্ষায় সফল এক দেশ, তারাও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জন্য গবেষণাভিত্তিক অনুদান এবং স্কলারশিপ প্রদানের নীতিমালা অনুসরণ করে। সৌদি আরব, ভিশন-২০৩০ এর আওতায়, শিক্ষাক্ষেত্রে বেসরকারি খাতকে উন্নয়নের অংশীদার হিসেবে বিবেচনা করছে। যুক্তরাষ্ট্রে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো, বিশেষত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো লোন এবং কোটি কোটি ডলারের গবেষণা অনুদান পায় ফেডারেল সরকারের পক্ষ থেকে। অস্ট্রেলিয়ায় হেল্প (হায়ার এডুকেশন লোন প্রোগ্রাম)- এর মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা সরকারি ঋণের সুবিধা নিয়ে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করতে পারে। এমনকি, সরকারি উচ্চশিক্ষার কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত জার্মানিও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর স্বীকৃতি, আর্থিক সহায়তা এবং স্কলারশিপ প্রাপ্তির সুযোগ নিশ্চিত করেছে ইতোমধ্যে।

এই আন্তর্জাতিক বাস্তবতা পর্যালোচনা করলেই বোঝা যায়, উন্নত দেশগুলো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে সম্ভাবনা ও শক্তি দেখছে। তাদের নীতিমালা সে ভাবেই পরিচালনা করছে যাতে করে এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রমবিকাশ ঘটে। অন্যদিকে, আমাদের দেশে এই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে সম্ভাবনার উৎস হিসেবে না দেখে, চাপ সৃষ্টির মাধ্যমে নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে। এতে শুধু শিক্ষার্থীদের ওপর বোঝা বাড়ছে না, বরং দেশের সমগ্র জ্ঞানভিত্তিক অগ্রগতি ব্যাহত হচ্ছে।

সরকার চাইলে ভ্যাট প্রত্যাহার করে সেই অর্থ গবেষণায় পুনঃবিনিয়োগের সুযোগ সৃষ্টি করতে পারে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে বলা যেতে পারে, আগে ভ্যাট বাবদ যে অর্থ নেওয়া হতো, তা গবেষণা বৃত্তি এবং গবেষণাগার উন্নয়নের কাজে ব্যবহার করতে হবে। এর ফলে সরকারের রাজস্ব ঘাটতি হবে না, শিক্ষা খাতেও কার্যকর উন্নতি হবে। এই নীতি প্রয়োগ হলে তা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রতি সরকারের ইতিবাচক অবস্থানেরও প্রতিফলন ঘটাবে।

এছাড়া, সরকার শিক্ষার্থীদের জন্য বৃত্তি ও ঋণ কর্মসূচি চালু করতে পারে, যাতে করে তারা উচ্চশিক্ষায় প্রবেশাধিকারের সহায়তা পায়। এর মাধ্যমে নিম্নবিত্ত মেধাবী শিক্ষার্থীরাও পড়াশোনার সুযোগ পাবে এবং আর্থিক কারণে উচ্চশিক্ষা থেকে পিছিয়ে পড়বে না। একইভাবে, অলাভজনক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে করছাড় দেওয়া যেতে পারে। দাতাদের অনুদানে কর রেয়াতের ব্যবস্থা করে অনুদান প্রবাহের হারও বাড়ানো যেতে পারে। সরকার যদি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে স্বাধীনভাবে কার্যক্রম পরিচালনার স্বাধীনতা দেয় তাহলে নির্দিষ্ট মানদণ্ড ও গুণগত মান বজায় রেখে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো পরিচালিত হতে পারে।

আমরা যদি সত্যিই একটি উদ্ভাবনী, জ্ঞাননির্ভর, এবং দক্ষ মানবসম্পদনির্ভর জাতি গড়ে তুলতে চাই, তবে উচ্চশিক্ষায় অন্তর্ভুক্তিমূলক নীতিমালা গ্রহণ করা দরকার। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এই লক্ষ্য অর্জনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। তাই এই প্রতিষ্ঠানগুলোতে পৃষ্ঠপোষকতা, সহযোগিতা এবং সমর্থনের হাত বাড়িয়ে দেওয়া সরকারের কর্তব্য।

বলা হয়ে থাকে, ‘A nation that invests in education, invests in its future.’ আমরা যদি এই বিনিয়োগকে ব্যয় হিসেবে দেখি, তাহলে কেবল শিক্ষাক্ষেত্রেই না, জাতির অগ্রগতিই বাধাগ্রস্ত হবে। উন্নত বিশ্বের মতো বাংলাদেশেরও উচিত শিক্ষাকে উৎপাদনশীল খাত হিসেবে বিবেচনা করে সেখানে করছাড়, গবেষণা অনুদান, এবং কাঠামোগত উন্নয়নে অংশীদারত্বের মাধ্যমে এগিয়ে আসা।

সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়—দুই দেশের সম্পদ। তাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টা বাংলাদেশিদের একটি উন্নত, আত্মনির্ভর ও প্রযুক্তিনির্ভর জাতি হিসেবে গড়ে তুলতে পারে। আর সে লক্ষ্য অর্জনের প্রথম ধাপ হতে পারে — শিক্ষার ওপর ১৫% ভ্যাট প্রত্যাহার এবং প্রতিষ্ঠানকে বাধ্যবাধকতায় বেধে দিয়ে সেই অর্থের ব্যবহার গবেষণার ক্ষেত্রে নিশ্চিত করা। তাহলেই সম্ভবত আমরা জাতীয়ভাবে গবেষণা নির্ভর জাতি হিসেবে যাত্রা শুরু করতে পারব।

লেখক : অধ্যাপক ড. এ বি এম শওকত আলী।

উপাচার্য, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস অ্যান্ড টেকনোলজি (বিইউবিটি)

[ নিবন্ধ, সাক্ষাৎকার, প্রতিক্রিয়া প্রভৃতিতে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। দৈনিক কালবেলার সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে নিবন্ধ ও সাক্ষাৎকারে প্রকাশিত মত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির ব্যাখ্যা বা বিশ্লেষণ, তথ্য-উপাত্ত, রাজনৈতিক, আইনগতসহ যাবতীয় বিষয়ের দায়ভার লেখকের, দৈনিক কালবেলা কর্তৃপক্ষের নয়। ]
কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

নানকসহ ১২ জনের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা

মাহফুজকে বোতল নিক্ষেপে তীব্র প্রতিক্রিয়া জানালেন হাসনাত

উপদেষ্টা মাহফুজের মাথায় বোতল নিক্ষেপ

পরীক্ষা দিতে গিয়ে সন্তান জন্ম দিলেন হাজেরা

শিক্ষকের বিরুদ্ধে মামলার প্রতিবাদে রাস্তায় নামলেন শিক্ষার্থীরা

দেড় যুগ পর নিজ গ্রামের বাড়িতে গেলেন ড. ইউনূস

ওয়ানডে র‌্যাঙ্কিংয়ে সুখবর পেল জ্যোতিরা

মা-দাদির কবরের পাশে চিরনিদ্রায় শায়িত হলেন সাম্য

সাংবাদিকদের হামলা করে মামলা দিলেন যুবক

জবি শিক্ষার্থীদের লং মার্চে গুরুতর আহত সাংবাদিক হাসপাতালে

১০

বার্ষিক সাধারণ সভার তারিখ জানাল বিবেকানন্দ শিক্ষা ও সংস্কৃতি পরিষদ

১১

করিডোরের নামে এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে না, যা হুমকিস্বরূপ : আমিনুল হক 

১২

আনচেলত্তির ব্রাজিল কোচিং স্টাফে ফিরছেন কাকা?

১৩

চাকরি পাচ্ছেন সেই অটোরিকশা চালকরা

১৪

ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় দুপক্ষের সংঘর্ষে নিহত ১, আহত ১৫

১৫

কানাইঘাট সীমান্তে ১৬ জনকে বিএসএফের পুশইন

১৬

তালিকায় ‘ভুয়া আহত’ অন্তর্ভুক্তি / যশোরে আহত জুলাইযোদ্ধাদের অনুদানের চেক বিতরণে হট্টগোল

১৭

কমিশনারের অবৈধ শেয়ার ব্যবসার অভিযোগের ব্যাখ্যা দিল বিএসইসি

১৮

সৌদি নিয়োগকর্তাদের গাফিলতিতে মারা যাচ্ছেন বহু বাংলাদেশি শ্রমিক

১৯

অসীম-অপুর ১৪ ফ্ল্যাট ও ৫ দোকান দেখভালে রিসিভার নিয়োগ

২০
X