নবাব সিরাজউদ্দৌলা পলাশীর যুদ্ধে পরাজিত হন। এরপর মীরজাফরের পুত্র মীরণের নির্দেশে পাটনা যাওয়ার পথে তাকে ধরে এনে ১৭৫৭ সালের ৩ জুলাই শহীদ করা হয়। বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার শেষ স্বাধীন নওয়াব সিরাজউদ্দৌলা তার ঘনিষ্ঠজনদের ষড়যন্ত্রে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির রবার্ট ক্লাইভের কাছে যুদ্ধে পরাজয় বরণ করেন ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন (সেদিন ছিল বৃহস্পতিবার)। মীর জাফর আলী খান, রাজবল্লভ, শওকত জঙ্গদের বেঈমানির কারণে পশ্চিমবঙ্গের পলাশী প্রান্তরে নওয়াবের বাহিনীর পরাজয় ঘটে। এই পরাজয়ে মধ্যদিয়ে বাংলার স্বাধীনতা সূর্য অস্তমিত হয়। পলাশীর ভাগ্য বিপর্য্যয়ে হতভাগ্য ভারতবাসীর কপালে কলঙ্কের কালিমা লেপন হয়। বাংলাসহ ভারতে ঘটে ইংরেজ শক্তির অভ্যুদয়। সিরাজউদ্দৌলা নিহত হওয়ার পর ইংরেজরা বাংলার নওয়াবদের হাতের পুতুলে পরিণত করে এবং তারাই বাংলার শাসকে পরিণত হয়।
ব্রিটিশ এবং পাকিস্তান আমলেও ৩ জুলাই ছিল অবিভক্ত বাংলাদেশে একটি জাতীয় দিবস ছিল। নির্বিশেষে সব বাঙালি দিবসটি পালন করত। দিবসটি ছিল জাতীয় উদ্দীপনামূলক। ‘পলাশী দিবস’ রূপে দিবসটি পরিচিত ছিল। বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌল্লাকে আজ থেকে ২৬৮ বছর আগে এই দিনে নির্মমভাবে বন্দিশালায় হত্যা করা হয়। সারা উপমহাদেশে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শাসনের সূচনা হয়।
কবি নজরুল দিবসটি স্মরণ করেই লিখেছিলেন- ‘কান্ডারী! তব সম্মুখে ঐ পলাশীর প্রান্তর,/ বাঙ্গালীর খুনে লাল হ’ল যেথা ক্লাইভের খঞ্জর!/ ঐ গঙ্গায় ডুবিয়াছে হায়, ভারতের দিবাকর/ উদিবে সে রবি আমাদেরি খুনে রাঙিয়া পুনর্বার।’নজরুলের ‘কাণ্ডারী হুঁশিয়ার’ শীর্ষক এই গান ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে ঘরে ঘরে গাওয়া হতো। এখন গাওয়া হয় না। এখনো শহীদ সিরাজউদ্দৌল্লা দিবস হিসেবে পশ্চিমবঙ্গে মুর্শিদাবাদসহ কয়েকটি জেলায় ৩ জুলাই পালিত হয়। উপমহাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে যথেষ্ট প্রেরণা জুগিয়েছে এই দিবস। সেনাপতি মীর জাফরের বিশ্বাসঘাতকতায় পলাশীর যুদ্ধে ইংরেজ সেনাপতি ক্লাইভ নবাবকে হত্যা করে বাংলায় ইংরেজ শাসনের সূচনা করেন। তারপর দিল্লির মোগল বাদশাহ বাহাদুর শাহকে সিংহাসনচ্যুত করে সারা উপমহাদেশে ইংরেজরা তাদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে।
নবাব সিরাজকে জাতীয় বীর হিসেবে প্রথম ঘোষণা করেন নেতাজি সুভাষ বসু। কলকাতা করপোরেশনের মেয়র থাকাকালে তিনি মুর্শিদাবাদে গিয়ে নবাবের সমাধিতে পুষ্পস্তবক রেখে ঘোষণা করেন, You are not a fallen king, you are our national hero (পতিত রাজা নন, আপনি আমাদের জাতীয় বীর)। কলকাতায় ইংরেজরা একটি রাস্তার নাম রেখেছিলেন ক্লাইভ স্ট্রিট। তা পরিবর্তন করে রাখা হয়েছিল নবাব সিরাজউদ্দৌল্লা স্ট্রিট। ঢাকা শহর ব্রিটিশ আমলে ছিল একটি জেলা শহর। এই শহরেও প্রতিষ্ঠা করা হয় সিরাজউদ্দৌল্লা পার্ক। সিরাজউদ্দৌল্লা পার্কেই পাকিস্তান হওয়ার পর রাজনৈতিক সভা হতো। সভার আকার বর্ধিত হওয়ায় তারপর তা চলে আসে সদরঘাট সংলগ্ন ভিক্টোরিয়া পার্কে (বর্তমানে বাহাদুর শাহ পার্ক)। জনসমাগম যখন ভিক্টোরিয়া পার্কে ধরত না, সভাস্থল তখন চলে যায় পল্টন ময়দানে। সেখান থেকে চলে যায় পুরোনো রেসকোর্স বা শহিদ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে।
ব্রিটিশ আমলে নবাবের চরিত্রে নানা মিথ্যা অপবাদ দিয়ে ব্রিটিশ শাসকেরা অনেক ইতিহাস লিখিয়েছিল। তার মধ্যে একটি ছিল, সিরাজ কলকাতা আক্রমণের পর ২০০ ইংরেজ সৈন্যকে বন্দি করে একটি গুহায় রেখে মৃত্যুবরণে বাধ্য করেছিলেন। সেই মৃত সৈন্যদের স্মরণে কলকাতায় একটি স্মৃতিসৌধ তৈরি করা হয়েছিল, যার নাম ছিল হলওয়েল মনুমেন্ট। বিখ্যাত গবেষক ও ইতিহাসবিদ অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় গবেষণা করে প্রমাণ করেন, হলওয়েল মনুমেন্টের কিস্সা সম্পূর্ণ মিথ্যা এবং বানানো। ইংরেজরা নবাবকে হেয় করার জন্য এই মিথ্যা অপবাদ ছড়িয়েছিল। সুভাষ বসু ১৯৪১ সালে এই মনুমেন্ট ভেঙে ফেলার সিদ্ধান্ত নেন। হলওয়েল মুভমেন্ট নামে খ্যাত তার এই আন্দোলন। তিনি মনুমেন্টে যান বিরাট মিছিল নিয়ে এবং ইংরেজ শাসকদের সামনে তা ভেঙে ফেলেন। তখনকার অনেক বিখ্যাত রাজনৈতিক নেতা তার এই মিছিলে যোগ দেন। তার বাবা শেখ লুতফুর রহমান চোখের অসুখের চিকিৎসার জন্য শেখ মুজিবকে কলকাতায় পাঠিয়েছিলেন। মাত্র দুজন মুসলমান ছাত্র মনুমেন্ট ভাঙার মিছিলে যোগ দিয়েছিলেন। তাদের একজন শেখ মুজিব।
কয়েক জন বিখ্যাত ব্রিটিশ অধ্যাপক পরবর্তীকালে পর্য্যন্ত স্বীকার করেন, হলওয়েল হত্যাকাণ্ডের ঘটনাটি সম্পূর্ণ বানানো। প্রতিপক্ষকে স্বৈরাচারী, বদমাশ, গুন্ডা, অত্যাচারী, হিসেবে চিত্রিত করে তাদের জাতির কাছেই হেয় করে রেখে নিজেদের স্বার্থ ও উদ্দেশ্য পূরণ সাম্রাজ্যবাদীদের একটি পুরোনো কৌশল। এই যুগে ইরাকযুদ্ধের সময়ও প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনের কাছে বিশ্বধ্বংসের মারণাস্ত্র আছে- এই মিথ্যা প্রচারণা চালিয়ে অন্যায় যুদ্ধে ইরাক দখল করে তাকে হত্যা করা হয়।
করোনা ভাইরাসের হামলায় বাংলাদেশসহ সারা বিশ্ব যেমন বিপন্ন ছিল, নবাবি আমলে তখন সুবে বাংলা (বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যা) বিপন্ন ভয়াবহ দস্যুদল বর্গি, হার্মাদ ও ওলন্দাজদের হামলায়। শয়ে শয়ে নরনারী হত্যা তারা করত। ফসল ও অন্যান্য সম্পদ লুট করত। দাসী হিসেবে বিক্রয়ের জন্য সুন্দরী নারীদের ধরে নিয়ে যেত। এদের ভয়ে তখন ছড়া তৈরি হয়েছিল, ‘ছেলে ঘুমালো, পাড়া জুড়ালো বর্গি এলো দেশে।’বর্গিদের নেতা ছিল দস্যু ভার্গব । অসম্ভব নিষ্ঠুর চরিত্রের লোক। নবাব আলিবর্দীর পত্মী তার স্বামীকে পরামর্শ দিয়েছিলেন বর্গিদের পরাজিত ও ভার্গবকে হত্যা করার জন্য। আলিবর্দী তা-ই করেছিলেন। তিনি সুবে বাংলাকে কার্যত স্বাধীন করেছিলেন দিল্লির অধীনতা অগ্রাজ্য করে । মুঙ্গের ও গঙ্গাতীরের যুদ্ধে হার্মাদ ও ওলন্দাজ দস্যুদের পরাজিত করে সিরাজউদ্দৌলা সুবে বাংলাকে তাদের নিয়মিত অত্যাচার ও লুণ্ঠন থেকে মুক্ত করেন। তিনি কলকাতা-যুদ্ধেও ক্লাইভকে পরাজিত করেন। ক্লাইভ প্রাণ বাঁচানোর জন্য মাদ্রাজে পলায়ন করেন। ইংরেজ সৈন্যরা পলাশীর যুদ্ধেও শুধু পরাজিত হওয়া নয়, নির্মূল হয়ে যেত, মীরজাফর ও তার সহযোগী নব্য ব্যবসায়ী দল যদি নবাবের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা না করত।
১৭৫৭ সালের ২৩ জুন বৃহস্পতিবার নবাবের পক্ষে অশ্বারোহীতে পদাতিক মিলে প্রায় অর্ধলক্ষ সেনা আর ৪০টি কামান এবং অভিজ্ঞ সেনানায়কবৃন্দ থাকার পরও প্রধান সেনাপতি মীর জাফর আলীর ইশারায় সৈন্যরা পুতুলের মতো দাঁড়িয়ে রইলো। আর এরফল দাঁড়ালো নবাব সিরাজউদ্দৌলার পতন। নবাব সিরাজউদ্দৌলা যুদ্ধের ময়দান থেকে পালাতে গিয়ে বন্দী হন। পরবর্তীতে মীর জাফর আলীর পুত্র মীর মীরনের নির্দেশে নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে হত্যা করা হয়। বাংলার স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হবার দুইশত বছরের মাথায় হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে এই বাংলা আবারো স্বাধীন হলো। ২৩ জুন পলাশীর প্রান্তরে তথাকথিত যুদ্ধে পরাজয়ের পর সিরাজউদ্দৌলা শিশুকন্যা জোহরাকে নিয়ে গোপনে নৌকাযোগে মুর্শিদাবাদ ছেড়ে যেতে বাধ্য হন। পথিমধ্যে রাতযাপনের জন্যে রাজমহলের এক মসজিদে আশ্রয় নিলে এর মোতাওয়াল্লি দানেশ ফকির বিশ্বাসঘাতকতা করে নবাবকে শত্রুপক্ষের হাতে তুলে দেন। সিরাজকে গোসল করান হয় ভাগীরথী নদীর পানি দিয়ে। নবাব আলীবর্দী খাঁর সমাধিসৌধের বারান্দায় খোশবাগে তাকে দাফন করেন। এ দেশের জনগণের ভাগ্যের বিপর্যয় সে থেকে ঘটে। আর ভারতবর্ষে মুসলিম শাসনেরও অবসান হয়।
সিরাজউদ্দৌলা আজও বেঁচে আছেন মানুষের হৃদয় জুড়ে দেশের জন্যে জীবন দিয়ে। ব্রিটিশরা নিষ্ঠুর শোষণ নিপীড়ন ও নির্মম গণহত্যার মাধ্যমে মানবতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত। এ অপরাধের কোনো বিচার হয়নি বিশ্ব ইতিহাসে ।
এই বাংলা, বাংলাদেশ নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে কখনো ভুলবে না। তার মৃত্যু দিবসে আমাদের অকৃত্রিম শ্রদ্ধা।
লেখক : ড. মো. আনোয়ার হোসেন, প্রেসিডেন্ট আন্তর্জাতিক মাদকবিরোধী সংগঠন ফ্রিডম ইন্টারন্যাশনাল এন্টি অ্যালকোহল।
মন্তব্য করুন