এ পৃথিবীতে কেউ শতভাগ সফল নয়। আবার এমন একজনও পাওয়া যাবে না, তিনি শতভাগ বিফল। চলতি বছর এসএসসি পরীক্ষায় বাংলাদেশে একজনও শতভাগ নম্বর পেয়ে উত্তীর্ণ হতে পারেনি। অর্থাৎ যে সবচেয়ে বেশি নম্বর পেয়েছে তারও খামতি রয়েছে। অন্যদিকে একজনও পাওয়া যাবে না যে সকল বিষয়ের পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে এক নম্বরও পান নাই। অর্থাৎ কমবেশি সবাই সফল, আবার কমবেশি সবাই বিফল। বরং ফেল-দের জন্য রয়েছে আগামী দিনের সুবর্ণ সুযোগ। ধরুন এবার বাংলাদেশ যে শিক্ষার্থী সর্বোচ্চ নম্বর পেয়েছেন, তিনি বড়জোর ৯৭ শতাংশ নম্বর পেয়ে গোল্ডেন এ প্লাস পেয়েছেন। যে ছয় লক্ষ শিক্ষার্থী ফেল করেছে, তাদের মধ্য হতে এক বছর পড়াশোনা করার মাধ্যমে ৯৮ শতাংশ নম্বর পেয়ে রেকর্ড ব্রেক করতে পারে। আমার বিশ্বাস এমনটি ঘটবে। এই পৃথিবীতে ভালোর সীমা পরিসীমা নেই। খারাপ-এর ও একই অবস্থা। পৃথিবীতে সফলতার শীর্ষে আরহণকারী প্রায় সকলেই কোন না কোন পরীক্ষায় অনত্তীর্ণ হয়েছেন। বরং এ ধরনের গদবাদা সকল পরীক্ষায় ভালো ফলাফল করে উন্নতির সর্বোচ্চ শিখরে অবস্থান করেছেন, এমন মানুষ কম বললেই চলে।
অন্য যে কোনো বিষয়ের মতো এসএসসি পরীক্ষায় অনত্তীর্ণ হওয়ার কারণে স্বাভাবিকভাবে মন খারাপ হতেই পারে। কিন্তু এ মন খারাপটা যেন আত্মঘাত বা অন্তঘাত পর্য্যন্ত না গড়ায়। আমরা সকল মানুষ পৃথিবীতে প্রতিনিয়ত পরীক্ষার হলেই আছি, আমৃত্যু এই পরীক্ষা চলতেই থাকবে। প্রতিনিয়ত হাজারো পরীক্ষায় আমরা সবাই অকৃতকার্য হচ্ছি, এটাও এমনই একটা পরীক্ষা, এর চেয়ে বেশি কিছু নয়।
এসএসসি পরীক্ষা আমাদের দৈনন্দিন জীবনে হাজারো পরীক্ষার মধ্যে একটি পরীক্ষা মাত্র। অন্য বিষয়ের মত এক্ষেত্রেও মন খারাপ হতেই পারে। এজন্য নিজেকে শেষ করে দেওয়ার মতো বোকামি করা কোন অবস্থাতেই যুক্তিসঙ্গত হতে পারে না। এ পৃথিবীতে যে পরীক্ষাই হোক না কেন উত্তীর্ণ হওয়া মানে সব অর্জন হয়ে গেছে এমনটি ভাবায় কোন কারন নাই। যেকোনো পরীক্ষায় অনউত্তীর্ণ হওয়া মানে সব শেষ হয়ে যাওয়া নয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মানুষ অনত্তীর্ণ হওয়া মানেই তার জন্য এর চেয়েও ভালো কিছু অপেক্ষা করছে, এ সত্যটি প্রমাণিত। নিশ্চয়ই সে এর চেয়েও ভালো কিছু পাওয়ার যোগ্য।
একটা পরীক্ষার ফলাফল কখনোই কারো পরিপূর্ণ মূল্যায়ন হতে পারে না। জীবনের পথটা আঁকা বাঁকা। একেক জন একেক ভাবে নিজ গন্তব্যে পৌঁছাতে সক্ষম হন। স্কুলের পরীক্ষায় একটা নম্বর কম বা বেশি পাওয়া, পাস বা ফেল করা মানেই জীবন কামিয়াব বা শেষ এই ধারণা সঠিক নয়। বাংলাদেশে ভালো ফলাফলকারী সরকারি কর্মকর্তাদের সর্বোচ্চ পদবী মন্ত্রী পরিষদ সচিব অথবা প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব। অন্যদিকে কোন ধরনের একাডেমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ না হয়েও একজন মানুষ কল্পনা, অধ্যবসায়,দৃঢ় মনোবল ও সততা দিয়ে এসব পদবী হতেও সম্মানিত স্থানে আসীন হন। আমরা অনেক সময় ভুলে যাই, আমাদের জীবনে ব্যর্থতা বা সফলতা মানে নির্দিষ্ট কিছু পরীক্ষার ফল না। সফলতা মানে নিজের লক্ষ্যে পৌঁছানো, সেই লক্ষ্যে এ ধরনের পরীক্ষায় অবতীর্ণ না হয়েও পৌঁছানো সম্ভব। আজ হয়তো তুমি এ প্লাস পাওনি, হয়ত ফেল করেছ। তাতে তেমন কিছু যায় আসে না। যদি তুমি অধ্যবসায়ী হও, তবে তোমার সফলতা অবশ্যম্ভাবী।
প্রতিটি মানুষের জীবন চক্র আলাদা। কেউ হয়তো প্রচলিত পরীক্ষা পদ্ধতিতে মানিয়ে নিতে পারছেন না, তিনি হয়তো অন্য কোনভাবে নিজেকে মেলে ধরতে পারবেন। যদি নিজের প্রতি বিশ্বাস রাখেন, তবে অবশ্যই প্রচলিত গোল্ডেন এ প্লাস হতেও ভালো কিছু তার জন্য অপেক্ষা করছে। সবার সফলতা এক ভাবে আসে না। তবে প্রতিটি মানুষই মেধাবী। কাজেই সফলতা ধরা দিবেই।
আগামী বছর যখন এসএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশ হবে, তখন বাংলাদেশের আকাশে যেন এ আবহ দেখা দেয়, একদিকে বরণ করা হয় গর্বিত বিজয়ী মুখ, আর অন্যদিকে বুকে জরিয়ে নিবে আজকে অনত্তীর্ণ আগামী দিনের কিছু স্বপ্নের আলো-কে। এমন দৃষ্টিভঙ্গি আমাদের পোষণ করতে হবে। সেদিন শুধু রেজাল্ট বের হবে, যেন বের হয়ে না হয় সমাজের এক নির্মম বাস্তবতা, একটা কাগজের নাম্বার দিয়ে একজন কিশোর-কিশোরীর জীবনের ‘মান’ নির্ধারণ করা সম্ভব হয়না। শিক্ষা শুধু সনদের নাম নয়, এটা ভাবনা দক্ষতা স্বপ্ন আর লড়াইয়ের গল্প। আমরা যেন ভুলে না যাই, পৃথিবীর সবচেয়ে সফল মানুষরাও একাধিকবার পরীক্ষায় ব্যর্থ হয়েছেন, কিন্তু থেমে যাননি। তাহলে আজকের একজন শিক্ষার্থী যদি কিছু নম্বরে পিছিয়ে যায়, তাতেই কি তার জীবনের গন্তব্য হারিয়ে গেছে মনে করে তাকে দূরে ঠেলে দিব?
এসএসসির ফল শুধু একাডেমিক সনদের বিষয়, এটা কখনো আত্মসম্মানের যুদ্ধ হয়ে দাঁড়াতে পারে না, সামাজিক গ্রহণযোগ্যতার পরীক্ষা হতে পারে না। একটি ফলাফল কখনোই কারও প্রতিভার শেষ বিচার হতে পারে না। একজন শিক্ষার্থী হয়তো বিজ্ঞানে দুর্বল, কিন্তু সে হয়তো একদিন দারুণ একজন সাহিত্যিক হবেন। কারও গোল্ডেন জিপিএ ৫ নেই বলেই তার জীবনে অন্ধকার থাকবে, এমন ভাবনার কোনো যুক্তি নেই। পৃথিবীতে কেউ বিদ্যুৎ আবিষ্কার করেছে, কেউ কম্পিউটার, তাদের একাডেমিক ফলের চেয়ে বড় ছিল তাদের কল্পনা, অধ্যবসায় ও দৃঢ় মনোবল। ফলাফল প্রকাশের দিন আমাদের দেশে শুধু সফলদের নিয়েই আলোচনা হয়, আর যাদের রেজাল্ট খারাপ হয়, তারা যেন সমাজের বাতিল পণ্য! আমাদের এ কেমন শিক্ষাব্যবস্থা, যেখানে পিছিয়ে পরাদের পাশে দাঁড়ানোর সংস্কৃতি ইেন ? চেষ্টা সকলেই কমবেশি করেছে। তবে এ সংকীর্ণতা হতে বের হবো না কেন ?
এসএসসি সমমানের পরীক্ষার ফল জীবনের একটি অতি ক্ষুদ্র অংশ, বিশাল জীবনের একমাত্র মাপকাঠি মনে করা বোকামি নয় কি ? চীনের উদ্যোক্তা জ্যাক মা জীবনের প্রথম দিকেই ৩০টিরও বেশি চাকরির আবেদন প্রত্যাখ্যাত হয়েছিলেন। কেএফসিতে ওয়েটার পদে পর্য্যন্ত তাকে নেয়নি। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষাতেও তিনবার ফেল করেছিলেন। কিন্তু তিনিই পরে গড়ে তুলেছেন আলিবাবা, যেটি এখন বিশ্বের অন্যতম বড় ই-কমার্স সাম্রাজ্য। স্টিভ জবস স্কুলের গণ্ডিতে খুব একটা উজ্জ্বল ছিলেন না, কলেজ থেকেও ঝরে পড়েন। কিন্তু পরে তিনি প্রযুক্তি জগতের চেহারাই পাল্টে দিয়েছেন অ্যাপলের মতো প্রতিষ্ঠান তৈরি করে। এ মানুষগুলো আমাদের শেখায়, ব্যর্থতা মানেই শেষ নয়, বরং সাফল্যের একটা ভিন্ন শুরু। চার্লস ডারউইনের কথাই ধরা যাক। তার বাবা ভেবেছিলেন, এই ছেলেটা জীবনে কিছুই করতে পারবে না। মেডিকেল কলেজে ভর্তি হয়ে মাঝপথেই ছেড়ে দেন তিনি। অথচ পরবর্তীকালে তিনিই বিশ্ববিখ্যাত বিবর্তন তত্ত্বের জনক হন। ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি ও ‘মিসাইলম্যান’ এপিজে আবদুল কালাম ছোটবেলায় সংবাদপত্র বিলি করতেন। তার পরিবারের অবস্থা ছিল অত্যন্ত সাধারণ। স্কুলজীবনে অনেকেই তাকে গুরুত্ব দিতেন না। কিন্তু অধ্যবসায় আর স্বপ্নের শক্তিতে তিনি শুধু বৈজ্ঞানিক নন, কোটি তরুণের অনুপ্রেরণায় পরিণত হন। এমনকি আইনস্টাইনকেও স্কুলের শিক্ষকরা বলতেন, ‘এই ছেলে কিছু করতে পারবে না’, তিনি তো অঙ্কেও নাকি দুর্বল ছিলেন। অথচ আজ সেই নামটাই বিজ্ঞানের প্রতীক।
আপাতদৃষ্টিতে পৃথিবীর হাজারও ব্যর্থ মানুষের জীবন আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখায়, সাময়িক ভালো ফলাফল নয়, বরং লক্ষ্যপূরণের জেদই একদিন কিভাবে তাকে সাফল্যের শিখরে পৌঁছায়। ইউরোপ থেকে শুরু করে চীন সবখানেই ব্যর্থতাকে গুরুত্ব দিয়ে নতুন করে দাঁড়ানোর সুযোগ দেওয়া হয়। আর আমরা একটি পরীক্ষায় অকৃতকার্য্য হলে তার জীবনকে শেষ বলে মনে করি! এই মনোভাব এখনই বদলাতে হবে। প্রতিটি এসএসসি পরীক্ষার্থী সে সফল হোক কিংবা অকৃতকার্য্য তাকে মনে রাখতে হবে, এটাই শেষ নয়। জীবনটা অনেক বড়। এসএসসি কেবল একটি স্টেশন মাত্র, গন্তব্য নয়। যদি ট্রেন মিসও হয়, পরবর্তী ট্রেনের জন্য প্রস্তুতি নিতে হবে। ঘুরে দাঁড়াতে হবে।
পরীক্ষায় ফেল করা মানেই জীবন ফেল নয়। এসএসসি রেজাল্টের আগে একজন শিক্ষার্থী ছিল সন্তান বন্ধু ভাই-বোন এবং তার ভবিষ্যৎ গড়ে উঠবে পরবর্তী চেষ্টা, আত্মবিশ্বাস আর মানসিক দৃঢ়তার মাধ্যমে। আমরা যদি সত্যিই শিক্ষিত হই, তাহলে আমাদের উচিত সেই ব্যর্থতার মুহূর্তে একজন শিক্ষার্থীর পাশে দাঁড়ানো, তার হাত শক্ত করে ধরা, জয়ী হওয়ার নতুন গল্প শুরু করার জন্য।
পরীক্ষার গৎবাঁধা কিছু প্রশ্নের উত্তর না দেওয়া যদি ব্যর্থতা হয়, তবে জেনে রাখুন, এমন ফেলমারা কিছু মানুষসই বদলে দিয়েছে মানবসভ্যতা! সমাজ পরিবার রাষ্ট্র সবাইকে এদের পাশে থাকতে হবে। কারণ সঠিক সময়ে একটি সহানুভূতির হাত হয়তো একটা জীবন রক্ষা করতে পারে। রেজাল্ট যা-ই হোক, স্বপ্ন দেখা বন্ধ করা যাবে না। আজ থেকেই নতুন করে শুরু করতে হবে।
লেখক : ড. মো. আনোয়ার হোসেন; প্রাবন্ধিক, কলাম লেখক, কথা সাহিত্যিক, প্রেসিডেন্ট আন্তর্জাতিক মাদকবিরোধী সংগঠন ফ্রিডম ইন্টারন্যাশনাল এন্টি অ্যালকোহল।
মন্তব্য করুন