কোনো জাতির উন্নতি, অগ্রগতি ও প্রগতির সোপানে উন্নীত হওয়ার জন্য শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। সার্বিক বিবেচনায় অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান ও চিকিৎসার পাশাপাশি শিক্ষাকেও মানুষের মৌলিক চাহিদার আওতায় রাখা হয়েছে। বাস্তবতায় দেখা যায়, যে জাতি যত বেশি শিক্ষিত সে জাতি তত বেশি উন্নত। আর এ কারণেই বলা হয় ‘শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড’।
আবহমান কাল ধরে বিশ্বজুড়ে দুটি ধারায় শিক্ষাব্যবস্থা চালু রয়েছে। প্রথম ধারায় ধর্ম, বর্ণ, জাতি নির্বিশেষে সর্বসাধারণ শিক্ষা গ্রহণ করে থাকে। এটিকে ‘সাধারণ শিক্ষা’ বলে অভিহিত করা হয়। অপরটিতে উল্লিখিত সাধারণ শিক্ষার পাশাপাশি ধর্মীয় মূল্যবোধকে অগ্রাধিকার দিয়ে ধর্মীয় নৈতিক শিক্ষাকে প্রাধান্য দেওয়া হয়। এটিকে মাদ্রাসাশিক্ষা বলা হয়। যা কেবল মুসলিম সন্তানরাই গ্রহণ করে থাকে।
মানবজাতি যখন উন্নতি, অগ্রগতি ও প্রগতির ঘোড় দৌড় প্রতিযোগিতায় ব্যস্ত, বিজ্ঞানের জয়যাত্রার স্লোগানে মুখরিত, পশ্চিমা দুনিয়ার নগ্ন সভ্যতার হাতছানিতে বিভোর, যখন তারা মাদ্রাসা শিক্ষাকে ‘ফকিরি বিদ্যে’ বলে উপেক্ষা করে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার অপচেষ্টায় উন্মাদের মত ছুটে চলেছে ঊর্ধ্বশাসে, তখন তাদেরই উদ্দেশে নিবেদিত হলো আমার এই লেখা।
বিশ্ব নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আজ থেকে প্রায় দেড় হাজার বছর পূর্বে সুস্পষ্ট ভাষায় ভবিষ্যদ্বাণী করে গেছেন, মহাপ্রলয়ের পূর্বে মানুষ ধর্ম বিবর্জিত শিক্ষাব্যবস্থার প্রতি আকৃষ্ট হবে। যার বাস্তব প্রতিফলন আমাদের চোখের সামনে দিবালোকের সূর্যের মতো সুস্পষ্ট।
আজ যে সমস্ত বন্ধুগণ আধুনিক সভ্যতার চাকচিক্যে মোহিত হয়ে মাদ্রাসার শিক্ষার প্রতি অনীহা পেশ করছেন এবং আপন সন্তানদেরকে ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষার প্রাধান্য থেকে বঞ্চিত করছেন, তাদের প্রতি আমার একান্ত দাবি, পশ্চিমা সভ্যতার ঝলসানো মরীচিকার পেছনে না ছুটে বরং অতীত গৌরবময় সভ্যতার ইতিহাসের পাতায় একবার নজর বুলিয়ে দেখুন। এ যাবৎ দুনিয়ায় জাতির শান্তি, স্বস্তি, মুক্তি, কল্যাণ, উন্নতি, অগ্রগতি ও প্রগতির দুয়ার যারা উন্মোচন করেছিলেন ও শিক্ষায়, সভ্যতায়, এবাদত, উপাসনায়, রাজনীতিতে, অর্থনীতিতে, কাব্যে, সাহিত্যে, শিল্পে, বাণিজ্যে, বিজ্ঞানে, দর্শনে, ধর্মে, কর্মে, ত্যাগে, তিতিক্ষায়, মহানুভবতায়, পরোপকারিতায় ও চরিত্র-মাধুর্যে যারা স্বর্ণশিখরে আরোহণ করেছিলেন, সেই সমস্ত মহান ব্যক্তিবর্গ সবাই ছিলেন ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত। যখন আধুনিক কালের উচ্চ মাপের বিদ্যাপীঠ অক্সফোর্ট, ক্যামব্রিজ, হার্ভার্ড, ক্যালিফোর্নিয়ার স্বপ্নও কেউ দেখিনি।
বর্তমানে গৌরবময় মাদ্রাসাশিক্ষা উপেক্ষা করে ঐতিহ্যবাহী মুসলিম জনগোষ্ঠী গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে দুনিয়ার মোহে কোনরূপ চিন্তা-ভাবনা না করেই ইংরেজ বিলেতিদের ছুঁড়ে দেওয়া শিক্ষাব্যবস্থা আপন সন্তানদের কাছে তুলে দিচ্ছি। যে শিক্ষা আমাদের কাঙ্ক্ষিত স্বপ্নপূরণে ব্যর্থ হচ্ছে, এর বাস্তবতা সর্বত্রই বিদ্যমান।
বিগত প্রায় ২০০ বছর যাবৎ জাতি ইংরেজদের পরানো গোলামীর জিঞ্জির টেনে অতিষ্ঠ জনতা শেষ অবধি প্রতিরোধ যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতা সূর্য ছিনিয়ে এনে গোলামীর শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হয়েছিলেন। ভারতবর্ষে শিক্ষা, সভ্যতা ও সংস্কৃতির অঙ্গনে ইংরেজরা ঢালাওভাবে তাদেরই রুচিসম্মত শিক্ষা, সভ্যতা ও সাংস্কৃতির যে প্লাবন সৃষ্টি করেছিল, তার মধ্যে জাতি হাবুডুবু খাচ্ছে আজও। এর নেপথ্যে যে বিষয়টি জড়িত তা নিম্নে আলোকপাত করা হলো।
যখন ইংরেজদের বিরুদ্ধে বিদায় ঘণ্টা বেজে উঠলো। পরাজয়ের অপমানজনক তিলক কপালে ধারণ করে গ্লানীর মালা গলায় পরে শ্লেষ্মাভরে তাদের সুদূর প্রসারী দুরভিসন্ধির কথা ব্যক্ত করেছিল। যা ইতিহাসের পাতায় পরিষ্কারভাবে উল্লেখ রয়েছে। আমরা দেখতে পাই ইংরেজ লেখক লর্ড ম্যাকল বলেছেন যে, আমরা ভারতবর্ষে এমন এক শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করেছি যার দ্বারা এদেশের শিক্ষিত লোকেরা রং ও বর্ণের দিক দিয়ে ভারতীয় হবে। কিন্তু মন মস্তিষ্ক বৃষ্টি কালচারের দিক দিয়ে হবে বিলাতি।
উইলিয়াম হান্টার লিখেছেন আমরা এ দেশে এমন এক সিলেবাস দিয়ে গেলাম যার দ্বারা শিক্ষিত হয়েও এ দেশের যুবক-যুবতীরা তাদের মুসলমান পিতা-মাতাকে বেকুফ মনে করবে। এসব ভবিষ্যদ্বাণীর সারমর্ম হলো তাদের রেখে যাওয়া ধর্মীয় ও নৈতিকতা বিবর্জিত সিলেবাস অনুসরণকারী শিক্ষিত জনগোষ্ঠী যদিও ভূখণ্ডগত দিক থেকে ভারতীয় হবে। তবে চিন্তা-চেতনায় আদর্শে ইংরেজদের তাবেদার হবে, আজীবন ইউরোপীয় গোলামীর জিঞ্জিরাবদ্ধ রাখতে এটা ছিল তাদের পরিকল্পিত কুৎসিত নীল নকশা। অপ্রিয় হলেও সত্য, তাদের সেদিনকার ভবিষ্যৎ বাণীর বাস্তব রূপ বর্তমান পৃথিবী পরিগ্রহ করছে।
পূর্বে আলোচিত ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষার সুফল ও প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থার বাস্তবতায় আমরা সকলেই ভুক্তভোগী। কোনো শিক্ষাব্যবস্থাকে আমরা একেবারে অনৈতিক বলবো না। তবে ইংরেজ মদদপুষ্ট শিক্ষাব্যবস্থা জাতীয় নৈতিক অবক্ষয় রোধে চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তাই সভ্য সৎ ও যোগ্য জাতি গঠনে ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষার কোন বিকল্প নেই। এজন্য সার্বজনীন শিক্ষা ব্যবস্থার প্রতিটি ক্ষেত্রে ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক করার একান্ত অপরিহার্যতা অনুভব করছি। সাথে সাথে ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষাঙ্গনে গতানুগতিক সিলেবাসে ব্যাপক পরিবর্তন সাধন-পূর্বক আধুনিক বিজ্ঞান ভিত্তিক সিলেবাস প্রণয়ন করে বিজ্ঞানের জয়-যাত্রায় প্রতিযোগিতার দৌড়ে টিকে থাকা ও বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করার শুভ উদ্যোগ গ্রহণ অতীব জরুরি হয়ে পড়েছে।
ধর্মীয় নৈতিক শিক্ষার অতীত বর্তমান অবস্থা পর্যালোচনান্তে আমরা অনায়াসেই এ কথা বলতে পারি যে, আজ জাতীয় জীবনে নৈতিক অবক্ষয় রোধে পশ্চিমা দুনিয়া থেকে প্রলয়ংকারী বেগে ধেয়ে আসা ইউরোপীয় কৃষ্টি কালচারের প্রবল স্রোতের মুখে ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষার দুর্ভেদ্য প্রাচীর গড়ে তুলে আগামী প্রজন্মকে যদি আধুনিক বিজ্ঞানময় ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষার স্রোতমুখী না করা যায়, তবে অচিরেই ভবিষ্যত সম্ভাবনাময় আমাদের উত্তরসুরিরা ইউরোপীয় কৃষ্টি কালচারের অবিরাম বন্যার তান্ডবে খড় কুটার ন্যায় ভেসে গিয়ে অধঃপতনের অতল গহবরে নিমজ্জিত হবে। শত চেষ্টা করেও সেখান থেকে আর কখনো বেরিয়ে আসতে পারবে না। এখনই জাতির শুভবুদ্ধির উদয় হোক। এই শুভ প্রত্যাশা মহান আল্লাহ তাআলা কবুল করুন। আমীন।
লেখক : প্রভাষক, ডিআরএম ইউনাইটেড আইডিয়াল কলেজ, কালিগঞ্জ, সাতক্ষীরা।
মন্তব্য করুন