

বাংলাদেশের স্বাধীনতা, বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধ, বাংলাদেশের বিজয়, এক সাগর রক্তের বিনিময়ে অর্জিত দেশ এসব কথা নিজের মনে মনে বলি, মুখে উচ্চারণ করি রক্তে ঢেউ খেলে যায়। মুক্তিযুদ্ধকালীন পত্রপত্রিকার খবর, টেলিভিশনে প্রচারিত তথ্যচিত্র, কবি লেখকদের গল্প, কবিতা, গান, উপন্যাস, নাটকে উচ্চারিত মুক্তিযুদ্ধ, তাজা তাজা প্রাণের আত্মত্যাগ, সীমাহীন নির্যাতন সহ্য করা বীর বাঙালি, বাংলাদেশি, যুদ্ধের সহযোগীদের কথামালা, তাদের স্মৃতিচারণা জেনে ও বুঝে শরীরের লোম দাঁড়িয়ে যায়, জাগ্রত হয় দেশপ্রেম।
তখন নিজের রক্ত বলে ওঠে একটি নাম বাংলাদেশ, স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব এনে দিয়েছে আমাদের সাহসী পূর্বপুরুষরা। এ আমাদের পরিচয়, আমাদের আদর্শ, আমাদের ঠিকানা। এই কথাগুলো স্মরণ করছি ৫৫তম বিজয় দিবসের মুহূর্তে, এই দেশের একজন নাগরিক হিসেবে যার বয়স দাঁড়িয়েছে ২৬ বছরে।
আমাদের ইতিহাস বলে, আমাদের মুক্তিকামী জনগণকে নির্বিচারে হত্যা করে, জুলুম করে পরাজিত করতে পারেনি পাকিস্তানি বাহিনী। তারা আমাদের বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করে মেধাশূন্য জাতি করার অপচেষ্টা করেছে। তাদের প্রতি ও তাদের সহযোগীদের প্রতি আমাদের ঘৃণা জানাই।
আমরা এই দিনে লাখ লাখ নাম না জানা শহীদদের স্মৃতির প্রতি সম্মান জানাই, তাদের স্মরণ করি ও সালাম জানাই। যারা প্রস্তুতি ছাড়াই দখলদার পাকিস্তানি সরকারের প্রত্যক্ষ মদদে পরিচালিত হত্যাযজ্ঞের বিরুদ্ধে জনযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। দেশের বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষ, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে এ দেশেকে স্বাধীন করতে শহীদ হয়েছেন, সর্বহারা হয়েছেন, আহত হয়েছেন, সম্ভ্রম হারিয়েছেন৷ তাই আমরা উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছি বীরগাঁথা ইতিহাস, ঐতিহাসিক বিজয়, মা ও মাটির জন্য আবেগ ও অনুভূতি।
আমাদের প্রশ্ন জাগে, বিজয়ের ৫৫ বছর পর বাংলাদেশের গণমানুষ কেমন আছে? রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক স্বাধীনতা নিয়ে মানুষ নিজেকে কতটা মুক্ত ভাবে। সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক সুবিচার নিয়ে এদেশের মানুষ কেমন আছে। এই প্রশ্নগুলো বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রশ্নে, সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে এই ভূখণ্ডে হাজার হাজার বছর ধরেই প্রাসঙ্গিক হয়ে থাকবে। এর কারণ, আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক মুক্তিকে লক্ষ্য করে পরিচালিত। আমরা চেয়েছি সাম্য, মানুষের মর্যাদা ও ন্যায়বিচার।
পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর দেওয়া রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্য, শোষণ-নিপীড়ন, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা হরণ, শিক্ষার অধিকার থেকে বঞ্চিত করা, মায়ের ভাষায় কথা বলতে বাধা দেওয়া বাংলাদেশের মুক্তিকামী জনগণ মেনে নেয়নি। বীর যোদ্ধারা হাসিমুখে প্রাণ দিয়েছেন বৈষম্যকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করতে, একটি মানবিক রাষ্ট্র গড়তে। তাদের দেখা স্বপ্ন আমাদের সামনে সর্বদা উজ্জ্বল ও আলোকিত হয়েছে তাদের জীবন উৎসর্গ করার মধ্য দিয়ে।
আমাদের মুক্তিকামী বীর জনগণের আকাঙ্ক্ষা পূরণে যেখানে আমাদের যেভাবে এগিয়ে আসা উচিত ছিল, সেই তুলনায় আমরা পিছিয়ে। আমাদের সামাজিক বৈষম্য, অর্থনৈতিক বৈষম্য, রাজনৈতিক সমস্যা আমাদের পিছিয়ে রাখে। তৈরি হয় দ্বন্দ্ব ও সংঘাত। তাই আমরা স্বাধীনতা পরবর্তী সময়গুলোতে বিপ্লব দেখেছি, গণঅভ্যুত্থান দেখেছি আর ঝরেছে অগণিত মানুষের প্রাণ। যদি সম্পূর্ণরূপে আমরা মুক্তিযুদ্ধকে লালন করতে পারতাম, বীর শহীদদের স্বপ্নকে ধারণ করতে পারতাম, আমরা আরও এগিয়ে যেতাম।
কবি শামসুর রহমান তার ‘বন্দী শিবির থেকে’ কাব্যগ্রন্থের ‘তোমাকে পাওয়ার জন্যে, হে স্বাধীনতা’ কবিতায় লিখেছিলেন, আর কতবার ভাসতে হবে রক্তগঙ্গায়? এই প্রশ্ন যেন আর ফুরাচ্ছে না। তিনি ‘বন্দী শিবির থেকে’ কবিতায় লিখেছিলেন, ‘স্বাধীনতা নামক শব্দটি লিখে দিতে চাই বিশাল অক্ষরে’। যা আমরা আজও চাই।
আমাদের আশা দেখায়, আমাদের লাল-সবুজের পতাকা, জাতীয় সংগীত, মুক্তিযুদ্ধকে লালন করা আমাদের তরুণ প্রজন্মকে দেখে। যাদের হাতে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ। যে ভবিষ্যৎ বিনির্মাণে লাখ লাখ মানুষ ১৯৭১ সালে জীবন বাজি রেখেছিলেন। বীর মুক্তিযোদ্ধাদের আকাঙ্ক্ষা পূরণে জাগ্রত থাকুক আমাদের দেশপ্রেম, সমুন্নত থাকুক মানবাধিকার। এই দেশ হোক স্বনির্ভর। আজকের এই মহান দিবসে শ্রদ্ধা জানাই সকল শহীদ, বীর মুক্তিযোদ্ধা ও বীরাঙ্গনাদের প্রতি। শ্রদ্ধা জানাই বাংলাদেশকে।
মন্তব্য করুন