আজ বিশ্ব মশা দিবস । ১৯৩০ সাল থেকে প্রতি বছরের ২০ আগস্ট দিবসটি পালিত হচ্ছে। ব্রিটিশ চিকিৎসক রোনাল্ড রস ১৮৯৭ সালের ২০ আগস্ট ম্যালেরিয়া রোগের কারণ যে মশা, সেটি আবিষ্কার করেন । এই আবিষ্কারের জন্য তিনি পরে চিকিৎসাশাস্ত্রে নোবেল পুরস্কার পান। তার সম্মানে যুক্তরাজ্যের লন্ডন স্কুল অব হাইজিন অ্যান্ড ট্রপিক্যাল মেডিসিন দিবসটি পালন শুরু করে। এরপর থেকে পৃথিবীর অনেক দেশেই এই দিবসটি পালিত হয়ে আসছে। এ বছর মশা দিবসের মূল প্রতিপাদ্য হলো ‘এটি এখনো উন্মোচন করা বাকি (It is yet to be disclosed)’ ।
করোনা অতিমারির আঘাত কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই ডেঙ্গু মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা হয়ে আমাদের সামনে হাজির হয়েছে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে এ বছর বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চসংখ্যক মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মারা গিয়েছে। আগস্ট মাসেও এডিস মশার কামড়ে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে প্রতিদিন গড়ে হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছে প্রায় আড়াইহাজার মানুষ।
জলবায়ু পরিবর্তন, উষ্ণ-আর্দ্র আবহাওয়া, অপরিকল্পিত নগরায়ণ, পানি সরবরাহ পদ্ধতি ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় দুর্বলতা ও মানুষের অসচেতনতার কারণে বাংলাদেশ মশার প্রজননের উপযুক্ত ক্ষেত্র হিসেবে রূপান্তরিত হয়েছে। বাংলাদেশ এ পর্যন্ত ১২৬ প্রজাতির মশা শনাক্ত করা হয়েছে তার মধ্যে বর্তমান ঢাকাতে আমরা পাই ১৬ প্রজাতির মশা। বাংলাদেশে প্রায় প্রতি বছরই মশাবাহিত রোগে আক্রান্ত হচ্ছে লক্ষাধিক মানুষ। মশা নিয়ন্ত্রণ ও মশাবাহিত রোগের চিকিৎসায় ব্যয় হচ্ছে হাজার কোটি টাকার ওপরে।
বাংলাদেশ মশা বাহিত রোগগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া, ম্যালেরিয়া, ফাইলেরিয়া ও জাপানিজ এনসেফালাইটিস।
ডেঙ্গু: ২০০০ সালে প্রথম বাংলাদেশে ডেঙ্গু শনাক্ত হয় এবং ৫,৫০০ মানুষ আক্রান্ত হয় । এরপর প্রতি বছরই কমবেশি ডেঙ্গু হয়েছে। তবে ডেঙ্গুর ভয়াবহতা দেশবাসী সবচেয়ে বেশি দেখেছে ২০১৯ সালে। ওই বছর সরকারি হিসাব অনুযায়ী ১০১,৩৫৪ জন মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয় এবং ১৭৯ জন মারা যায়। এ বছর ডেঙ্গুতে মৃত্যু বাংলাদেশের ইতিহাস ভেঙে রেকর্ড করেছে। ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসা নেওয়া রোগীর সংখ্যা এখন লাখ ছুঁই ছুঁই। আমরা যে ফোরকাস্টিং মডেল তৈরি করি তাতে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা এ বছর বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ হবে। ডেঙ্গু সংক্রমণ ঘটায় ডেঙ্গু ভাইরাস বহনকারী, এডিস মশার দুটি প্রজাতি। যার একটি হলো এডিস ইজিপ্টি আরেকটি হলো অ্যালবোপিকটাস। এডিস ইজিপ্টিকে শহরে মশা বা নগরের মশা অথবা গৃহপালিত মশা বলা হয় আর অ্যালবোপিকটাসকে বলা হয় এশিয়ান টাইগার মশা অথবা গ্রামের মশা।
এডিস মশা পাত্রে জমা পানিতে জন্মায় ও বর্ষাকালে এর ঘনত্ব বেশি হয়। তাই ডেঙ্গু রোগের প্রাদুর্ভাব এই সময়টায় বেড়ে যায়।
চিকুনগুনিয়া: ডেঙ্গুর মতো চিকুনগুনিয়া রোগটিও এডিস মশার মাধ্যমে ছড়ায়। ২০০৮ সালে বাংলাদেশে প্রথম চিকুনগুনিয়া ধরা পড়ে। এরপর ২০১১ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত প্রায় প্রতি বছর চিকুনগুনিয়া রোগ শনাক্ত হয়। ঢাকাতে সবচাইতে বেশি চিকুনগুনিয়া শনাক্ত হয় ২০১৬-২০১৭ সালে।
ম্যালেরিয়া: অ্যানোফিলিস মশার সাতটি প্রজাতি বাংলাদেশে ম্যালেরিয়া রোগ ছড়ায়। এর মধ্যে চারটি প্রজাতিকে প্রধান বাহক বলা হয়। বাংলাদেশের পার্বত্য জেলা এবং বর্ডার এরিয়ার মোট ১৩ জেলায় ৭২টি উপজেলায় ম্যালেরিয়ার প্রাদুর্ভাব দেখা যায়। ২০০০ সালের পর সবচেয়ে বেশি ম্যালেরিয়ার প্রাদুর্ভাব দেখা যায় ২০০৮ সালে। ২০০৮ সালে ৮৪,৬৯০ জন মানুষ ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয় এবং ১৫৪ জন মারা যায়। ২০১৯ সালে বাংলাদেশে এই সংখ্যাটি কমে রোগী হয় ১৭,২২৫ জনে। ২০২২ সালে বাংলাদেশে ম্যালেরিয়া আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ১৮,১৯৫ এবং মারা গেছে ১১ জন। এ বছর এখন পর্যন্ত আক্রান্ত প্রায় আট হাজার। ম্যালেরিয়া বাহক অ্যানোফিলিস মশা গ্রীষ্ম-বর্ষায় বেশি জম্মায় এবং এই সময়ে রোগের প্রাদুর্ভাব বেশি হয়।
ফাইলেরিয়া: ফাইলেরিয়া বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিম- দক্ষিণের প্রায় ৩৪টি জেলাতে কম বেশি পাওয়া যায়। এই রোগে মানুষের হাত-পা ও অন্যান্য অঙ্গ অস্বাভাবিকভাবে ফুলে ওঠে। স্থানীয়ভাবে এই রোগটিকে গোদ রোগ বলা হয়ে থাকে। একসময় এ রোগের প্রাদুর্ভাব বেশি ছিল তবে বর্তমানে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের ফাইলেরিয়া এলিমিনেশন প্রোগ্রামের মাধ্যমে এটিকে নিয়ন্ত্রিত পর্যায়ে নিয়ে আসা হয়েছে। ফাইলেরিয়া নেমাটোড জাতীয় কৃমি; ইউচেরিয়া ব্যানক্রফটি বাহিত মশার দ্বারা সংক্রমিত হয়। কিউলেক্স মশার দুটি প্রজাতি ও ম্যানসোনিয়া মশার একটি প্রজাতির মাধ্যমে বাংলাদেশ এ রোগ ছড়ায়।
জাপানিজ এনসেফালাইটিস: এই রোগটি বাংলাদেশের প্রথম শনাক্ত হয় ১৯৭৭ সালে মধুপুর বন এরিয়া থেকে। এরপর বিভিন্ন সময়ে রাজশাহী-রংপুর চট্টগ্রাম খুলনা অঞ্চলে এই রোগটি পাওয়া যায়। জাপানিজ এনসেফালাইটিস রোগটি কিউলেক্স মশার মাধ্যমে ছড়ায়।
ওপরের বর্ণনাকৃত রোগগুলো যেহেতু মশাবাহিত তাই এই রোগ থেকে মুক্ত থাকার প্রধান ও অন্যতম উপায় হল মশা থেকে নিজেকে মুক্ত রাখা। মশা নিয়ন্ত্রণ সঠিক ভাবে করতে পারলেই আমরা রক্ষা পেতে পারি মশাবাহিত ভয়াবহ রোগ থেকে।মশা এবং মশাবাহিত রোগ নিয়ন্ত্রণে সরকারের মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন করা অত্যন্ত জরুরি। অন্যদিকে সরকারের পাশাপাশি জনসাধারণ কেউ সম্পৃক্ত হতে হবে এ কাজে । ব্যক্তি, সামাজিক, প্রাতিষ্ঠানিক এবং সরকারি উদ্যোগের সম্মিলিত প্রয়াস ঘটাতে পারলে আমরা আমাদের পরিবার ও দেশকে মশাবাহিত রোগ থেকে মুক্ত করতে পারব।
ড. করিরুল বাশার: কীটতত্ত্ববিদ, অধ্যাপক ও গবেষক, প্রাণিবিদ্যা বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
মন্তব্য করুন