

বাংলাদেশের সুতার বাজার গত কয়েক বছর ধরে দীর্ঘমেয়াদি সংকটের মুখে রয়েছে। প্রায় ২৩ বিলিয়ন ডলারের তৈরি পোশাকশিল্প থাকা সত্ত্বেও স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত সুতার তুলনায় আমদানিকৃত সুতার দাম কম হওয়ায় আমদানিনির্ভরতা দ্রুত বাড়ছে। এই প্রবণতা শুধু স্পিনিং শিল্পকেই নয়, বরং বাংলাদেশের সামগ্রিক রপ্তানি অর্থনীতির ভবিষ্যৎকেও এক অনিশ্চিত পর্যায়ে নিয়ে যাচ্ছে।
দেশের স্পিনিং শিল্প একসময় ছিল টেক্সটাইল ভ্যালুচেইনের অন্যতম শক্তিশালী স্তম্ভ। স্থানীয় তুলা আমদানি করে সুতা উৎপাদন, তা থেকে ফ্যাব্রিক তৈরি এবং পরে তৈরি পোশাক (আরএমজি) রপ্তানি—এই সমন্বিত চক্র একসময় বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের অন্যতম উৎস হিসেবে কাজ করত। কিন্তু গত কয়েক বছরে সেই ভারসাম্য ক্রমেই নষ্ট হচ্ছে। নগদ অর্থপ্রবাহ (ক্যাশফ্লো) ধরে রাখতে গিয়ে এখন অনেক কারখানাই লোকসানে উৎপাদন চালিয়ে যাচ্ছে, শুধু টিকে থাকার আশায়।
দেশি বনাম আমদানি: বাড়ছে প্রতিযোগিতার অসামঞ্জস্য
বর্তমানে স্থানীয় উৎপাদকরা প্রতি কেজি সুতা আমদানিকৃত সুতার তুলনায় প্রায় ০.৩০ মার্কিন ডলার বেশি দামে বিক্রি করছেন। উদাহরণস্বরূপ, ৩০ কাউন্টের সুতার আমদানি মূল্য যেখানে প্রতি কেজি ২ দশমিক ৬৫ থেকে ২ দশমিক ৭০ মার্কিন ডলার, সেখানে স্থানীয় মূল্য ২ দশমিক ৯৫ থেকে ৩ ডলার। এই পার্থক্য তৈরি পোশাক প্রস্তুতকারকদের জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। ফলে অনেক প্রতিষ্ঠান ভারত, চীন, পাকিস্তান বা ইন্দোনেশিয়া থেকে সুতা আমদানিকে অধিকতর লাভজনক মনে করছে।
এই পরিস্থিতিতে দেশীয় স্পিনিং মিলগুলো নিজেদের প্রতিযোগিতা সক্ষমতা হারাচ্ছে। যেহেতু গার্মেন্টস কারখানাগুলো ব্যয় কমিয়ে আন্তর্জাতিক বাজারে টিকে থাকতে চায়, তারা বাধ্য হয়ে আমদানিকৃত সুতার ওপর নির্ভর করছে। এর ফলেই স্থানীয় বাজারে চাহিদা কমে গিয়ে উৎপাদন ব্যয় তুলতে না পারার ঝুঁকি বাড়ছে।
নীতিগত প্রতিকূলতা: প্রতিযোগিতায় বাজার হারানোর পেছনের কারণ
ভারত সুতা শিল্পকে রক্ষায় একাধিক ইতিবাচক পদক্ষেপ নিয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো— ইউটিলিটি বিলের ওপর সরকারি ভর্তুকি, রপ্তানিতে নগদ প্রণোদনা, ট্যাক্স ছাড়, এবং বিনিয়োগবান্ধব নীতি। এসব উদ্যোগ তাদের উৎপাদন খরচকে কমিয়ে দিয়েছে। ফলস্বরূপ, ভারতীয় সুতার দাম আন্তর্জাতিক বাজারে স্থিতিশীল থেকেও প্রতিযোগিতামূলক।
অন্যদিকে, বাংলাদেশের নীতিগত কাঠামো উল্টো চাপ তৈরি করছে। স্থানীয় স্পিনিং শিল্পের প্রণোদনার হার ৪ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১ শতাংশ করা হয়েছে, তুলা আমদানিতে ২ শতাংশ অগ্রিম আয়কর আরোপ করা হয়েছে। এ ছাড়া স্থানীয় সুতার ওপর ৬৭ শতাংশ ভ্যাট বহাল আছে। এতে উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে বহুগুণে। তার সঙ্গে বিদ্যুৎ, গ্যাস ও অন্যান্য ইউটিলিটি খরচের লাগামহীন বৃদ্ধি যুক্ত হয়ে পরিস্থিতিকে আরও জটিল করেছে।
দেশীয় উৎপাদকদের জন্য সবচেয়ে বড় বাধা হচ্ছে অনিশ্চিত নীতিগত পরিবেশ। দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ও কর-সহায়তার নিশ্চয়তা না থাকায় তারা নতুন বিনিয়োগে আগ্রহ হারাচ্ছেন। অনেক মিল আংশিকভাবে উৎপাদন বন্ধ রাখতে বাধ্য হচ্ছে—যার প্রভাব পড়ছে শ্রমিকদের কর্মসংস্থানেও।
সংকটের গভীরে গুদামভর্তি অবিক্রীত সুতা
বর্তমানে দেশের অনেক মিলের গুদাম ভর্তি অবিক্রীত সুতা রয়েছে। আরএমজি খাত ভারতের তুলনামূলক সস্তা সুতা বেছে নেওয়ায় স্থানীয় উৎপাদকরা বিক্রির সংকটে পড়েছেন। এই অবিক্রীত মজুত শুধু মূলধন আটকে রাখছে না, বরং সংরক্ষণ ব্যয় ও আর্থিক চাপ বাড়িয়ে তুলছে।
একইসঙ্গে, অনেক স্পিনিং মিল এখন রপ্তানি উন্নয়ন তহবিল (ইডিএফ) সুবিধা থেকে বঞ্চিত। ফলে ব্যাংক ঋণ পরিশোধে ব্যর্থতার ঝুঁকি দেখা দিচ্ছে। ঋণ পরিশোধে দেরি হলে ব্যাংকগুলোর ঝুঁকি বাড়ে, যা সামগ্রিক আর্থিক খাতেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
এ ছাড়া বিশ্ববাজারে তুলার দামের অস্থিরতা, ডলার সংকট এবং আমদানির সময়সীমা বেড়ে যাওয়ার মতো কারণগুলোও শিল্পখাতের চাপ বাড়াচ্ছে। সবমিলিয়ে, এটি শুধু একটি শিল্পের সংকট নয়—এটি এখন অর্থনীতির এক বৃহৎ পরিসরে ছড়িয়ে পড়া সমস্যা।
আশু সরকারি পদক্ষেপ প্রয়োজন
বাংলাদেশের তৈরি পোশাকশিল্প (আরএমজি) দেশের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের প্রধান উৎস, আর সেই খাতের মূল কাঁচামাল সুতা। অর্থাৎ সুতা শিল্পের টিকে থাকা মানে পোশাকশিল্পের স্থিতিশীলতা, কর্মসংস্থানের নিরাপত্তা এবং রপ্তানি আয়ের ধারাবাহিকতা। তাই এখনই সময় এই খাতকে বাঁচাতে সরকারকে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।
প্রস্তাবিত নীতিগত সহায়তাসমূহ হতে পারে: ১. বিদ্যুৎ ও গ্যাসের বিলে আংশিক ভর্তুকি প্রদান ২. তুলা আমদানিতে আরোপিত ২ শতাংশ অগ্রিম আয়কর প্রত্যাহার ৩. স্থানীয় সুতার ওপর থেকে ৬৭ শতাংশ ভ্যাটের অবসান ৪. প্রণোদনার হার পুনর্বহাল বা বৃদ্ধি করা ৫. স্পিনিং শিল্পের জন্য স্বল্পসুদের পুনঃঅর্থায়ন তহবিল (Refinancing Scheme) চালু করা
এই পদক্ষেপগুলো নিলে শুধু শিল্প নয়, সামগ্রিক অর্থনীতি একটি ইতিবাচক গতি ফিরে পেতে পারে। স্থানীয় সুতা শিল্পকে রক্ষা করা মানে হাজারো শ্রমিকের জীবিকা, বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের স্থিতি, এবং দেশের শিল্পায়নের ধারাবাহিকতা রক্ষা করা।
সরকারের সময়োপযোগী নীতি সহায়তা ও কার্যকর তদারকি থাকলে বাংলাদেশের স্পিনিং শিল্প আবারও ঘুরে দাঁড়াতে সক্ষম হবে—আর সেই পুনরুত্থানই আমাদের টেক্সটাইল খাতের ভবিষ্যৎ স্থিতিশীলতার অন্যতম ভিত্তি গড়ে দেবে।
মন্তব্য করুন