শরতের প্রায় শেষ। নীরবে নিভৃতে আসে সকালগুলো। সূর্যটা ওঠে খুব শান্তভাবে। শুভ্র এক সকালে ছেলেকে নিয়ে বাবা ঘর থেকে বেরোলেন চাটগাঁয়ে যাওয়ার জন্য।
বাইরে বেরোবার সময় গেটের কাছে শিউলি-গাছের থেকে আসা গন্ধটা প্রাণ জুড়িয়ে দেয়। সকালের কাঁচাসোনা রোদে শিউলিগুলো ভেজা মাটিতে শুয়ে আছে, এখনো কেউ তাকায়নি ওদের দিকে। মনে পড়ে, ছোটবেলায় তার মা প্রতি ভোরে মুঠোভরতি শিশির ভেজা শিউলি ফুল খাবারের টেবিলে রাখতেন। স্নিগ্ধ হাওয়ায় ফুরফুরে মনে, অনেকদিন পর খুব ভালো লাগল স্টেশনে যেতে। রেলস্টেশন তখনো পুরোপুরি জেগে ওঠেনি। সুবর্ণ-এক্সপ্রেসে চড়লেন বাবা-ছেলে। কক্ষে আরও দুজন যাত্রী তাদের সঙ্গী। আওয়াজ দিয়ে ঠিক সময়েই ট্রেনটা ছেড়ে দিল।
তাদের দুজনারই ট্রেন-যাত্রা খুব প্রিয়। আজ কিন্তু জীবনের এক বিশেষ আনন্দক্ষণে বাবা-ছেলের এই যাত্রা। ছেলের বয়স সবে তেরো হবে, কিন্তু মনে হয় আরো অনেক বড়। অনেক লম্বা হয়ে গেছে, বাবার মতো চওড়া কাঁধ। ট্রেন ছুটে চলেছে বিস্তীর্ণ মাঠ আর নদ-নালা পেরিয়ে। নদীর দুধারে ভরে উঠেছে কাশফুল, পাশেই ঢেউ খেলানো সবুজ ধানের ক্ষেত। বিলে ঝিলে লাল-গোলাপি শাপলা আর শাপলা। প্রকৃতির কি মনোহর রূপ ! অমল ধবল পালে লেগেছে … হাওয়া। ছেলে চিৎকার করে বলে, বাবা, আমি ওখানে যেতে চাই। যেতে চাই, বাবা। ছেলের যেন এ এক নতুন অভিজ্ঞতা।
তাদের সাথের যাত্রী-দুজন তাকিয়ে আছে ওদের দিকে। তারা যে বেশ জাঁদরেল, তা বুঝতে দেরি হলো না। মহিলার খুঁতখুঁতে স্বভাবে রেল কর্মচারীরা তখন সবাই তটস্থ। কথায় কথায় উনি অভিযোগ করছিলেন। খুঁটিনাটি জগতের সকল অসুবিধা তার সুশ্রী মুখে ভর করেছে।
জানালা দিয়ে ছেলেকে বারবার মুখ বের করতে দেখে বাবা কিছুটা রাগ করলেন। ট্রেনের জানালা দিয়ে ছেলেটা বাইরে তাকিয়ে চিৎকার করে বলল, “বাবা, দেখো, দেখো ! গাছগুলো পেছন দিকে চলে যাচ্ছে।“ বাবা মুচকি হেসে দিল। কেবিনের অন্য দুজন কিন্তু বিরক্তি সহকারে নিষ্পলক ছেলেটির শিশুসুলভ আচরণ খেয়াল করেই চলেছে। চোখে-মুখে একরাশ তাচ্ছিল্য আর বিরক্তি। আকাশে তখন পেঁজা পেঁজা তুলোর মতো ভেসে বেড়াচ্ছে মেঘমালা। হঠাৎ ছেলেটি আবারও চিৎকার করে বলল, 'বাবা, বাবা, দেখো মেঘগুলোও আমাদের সাথে দৌড়াচ্ছে’ !!
সহযাত্রী মহিলার বিরক্তিভরা মুখটা ক্রমশই ভারী হয়ে উটছে। ‘ইস্-উশ্’ বলে, গরমে মুখ আর গলা মুছছিলেন বারবার। এসি ছাড়বার জন্য অনুরোধ করায় বন্ধ করে দিতে হলো জানালাগুলো। মনটা খারাপ হয়ে গেল ছেলেটার। কিছুক্ষণ পর ওদের সবার জন্য গরম গরম চা আর ফ্রুট কেক দেওয়া হলো। ধূমায়িত দুধ-চা দেখে ছেলেটার খুব ভাল লাগলো। আঁকাবাঁকা ধোঁয়াগুলো দেখে বলল, ‘বাবা, বাবা… দেখো কি সুন্দর লাগছে’ ! তাদের উলটো দিকের জুটিটি আর ধৈর্য ধরে রাখতে পারল না। তারা ছেলেটির বাবাকে ভারী গলায় বললেন, “কিছু মনে করবেন না, আচ্ছা, আপনি আপনার ছেলেকে একজন ভালো মানসিক ডাক্তার দেখাচ্ছেন না কেনো ?”
বাবাটি নম্র হেসে বললেন : ‘আমি গিয়েছিলাম ওকে নিয়ে ডাক্তারেরই কাছে, তবে চোখের হাসপাতালের ডাক্তার। আমরা হাসপাতাল থেকে ফিরেছি গত পরশু। আমার ছেলেটি আড়াই-বছর বয়স থেকেই অন্ধ। সে গতকাল থেকে আবার চোখে দেখছে। আজই প্রথম বের হয়েছে ঘর থেকে।“ ছেলেটার চোখ ছলছল করে উঠল বাবার কথা শুনে। তার দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে গেলেন তার বাবা। নিজের অজান্তেই তার চোখ দিয়েও দু-ফোঁটা অশ্রু ঝরে পড়ল। ট্রেন তখন মেঘনার বুকের ওপর দিয়ে দ্রুতগতিতে ধেয়ে চলেছে। আশ্বিনের মধ্যবেলায় নদীর জলে সূর্যের খেলা দেখা হয় না কারো। প্রতিটি মানুষের জীবনেরই যে এক একটা নিজস্ব গল্প আছে, তা অনেকে জেনেও জানে না।
নির্যাস: মানুষকে ঠিকঠাক জানার আগেই তার সম্পর্কে কোনো ধারণা পোষণ করা ঠিক না। সত্যিটা জানলে হয়তো আশ্চর্যান্বিতই হব।
ডা. রুবায়ুল মোরশেদ: চিকিৎসক, গবেষক - কাইন্ডনেস এবং হ্যাপিনেস
মন্তব্য করুন