ব্যক্তিগত জীবনে ‘সম্পর্ক’ অনেক গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয়। বাবা-মা, স্বামী-স্ত্রী, ভাইবোন, ছেলেমেয়ে, আত্মীয়স্বজন, বন্ধু-বান্ধব- যে সম্পর্কই আমরা বলি না তা অত্যন্ত প্রিয় এবং অনেক গুরুত্ব বহন করে। আর এই সম্পর্কগুলোকে লালন করতে হয়। সম্পর্ককে ‘নিশ্চিতভাবে’ ধরে নিলে মনের অজান্তেই হয়তো প্রয়োজন অনুযায়ী গুরুত্ব দেওয়া হয় না, এমনকি ক্ষেত্র বিশেষে অবহেলাও করা হয়। সময়ের সাথে সাথে, এই অবহেলা পরিবারের সদস্যদের সম্পর্কের মধ্যে চাপা উত্তেজনা এবং টানাপড়েন সৃষ্টি করতে পারে।
পারিবারিক সম্পর্কের এই দূরত্ব বা অবনতি নেতিবাচকভাবে প্রভাব ফেলে আমাদের মানসিক স্বাস্থের ওপর, যা জড়িত ব্যক্তিদের জন্য একদিকে যেমন মানসিক কষ্টের কারণ হতে পারে অন্যদিকে তেমন একাকীত্ব বাড়াতে পারে। এতে করে ভুল বোঝাবুঝি, ভুল যোগাযোগ বা অমীমাংসিত দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়ে দুঃখ, অপরাধবোধ বা রাগের অনুভূতি হিসেবে প্রকাশ হতে পারে। ফলশ্রুতিতে, এক সময় সম্পর্কের মিষ্টতা নষ্ট হয়ে যায়- অনেক ক্ষেত্রেই আমরা তা বুঝতেই পারি না। আর এই সম্পর্ক একবারে বা একদিনে নষ্ট হয় না, এটা ধীরে ধীরে নষ্ট হয়- এমনকি বিশেষ কোনো কারণ ছাড়াই, যা পরবর্তীতে বিশ্বাস এবং ঘনিষ্ঠতা পুনঃনির্মাণকে দুর্বোধ্য করে তোলে।
আমরা জানি, পরিবারকে সামাজিকীকরণ এবং সমাজের একটি মৌলিক একক হিসেবে দেখা হয়- যা আমাদের প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে মানসিক সমর্থন দিয়ে থাকে। থোমাস এবং অন্যদের (২০১৭) মতে সুস্থ জীবন পরিক্রমায় পারিবারিক সম্পর্কের এক দীর্ঘস্থায়ী এবং প্রয়োজনীয় ভূমিকা রয়েছে।
পারিবারিক সম্পর্কগুলো বিভিন্ন ধরনের- যেমন : রক্তের সম্পর্ক, বৈবাহিক সম্পর্ক, দত্তক গ্রহণের মাধ্যমে একে অপরের সাথে সম্পর্ক বা সংযোগ বা বন্ধন। এই সম্পর্কগুলো মানবসমাজের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ যা পারিবারিক ও সামাজিক জটিলতা এবং সাংস্কৃতিক তাৎপর্যের মধ্যে পরিবর্তিত হতে পারে বা হতে থাকে। স্পর্শকাতর/গুরুত্বপূর্ণ এই বিষয়টিকে মাথায় রেখে লেখাটিতে প্রধানত- ৩টি বিষয় তুলে ধরা হয়েছে– প্রথমত, সম্পর্কগুলো কী অপরিবর্তনীয় না কি পরিবর্তন হয়, দ্বিতীয়ত, পরিবর্তন হলে কেন হয় এবং তৃতীয়ত, সেক্ষেত্রে আমাদের করণীয় কী।
প্রথমে আসা যাক পারিবারিক সম্পর্কের পরিবর্তনের বিষয়ে। পারিবারিক সম্পর্ক অপরিহার্যভাবে স্থির নয়; তা বিভিন্ন কারণ এবং পরিস্থিতির কারণে অর্থাৎ প্রতিটি সদস্যের ওপর অর্পিত দায়িত্বের পরিপ্রেক্ষিতে, সাংস্কৃতিক, সামাজিক এবং পারিপার্শ্বিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে ব্যাপকভাবে সময়ের সাথে পরিবর্তিত এবং বিকশিত হতে পারে।
দ্বিতীয়ত, দৃষ্টি ফেরানো যাক এই পারিবারিক পরিবর্তন বা বিবর্তন কেন হয় তার দিকে। পারিবারিক সম্পর্ক বিভিন্ন কারণে পরিবর্তন হতে পারে এবং এই কারণগুলো এক পরিবার থেকে অন্য পরিবারে ব্যাপকভাবে আলাদাও হতে পারে। পারিবারিক সম্পর্কের অবনতি একটি জটিল এবং বহুমুখী প্রক্রিয়া, প্রায়ই কারণগুলো একে অন্যের সাথে জড়িত। বিভিন্ন কারণে এই সম্পর্কের অবনতি হচ্ছে, কিছু স্বাভাবিক কারণের প্রথমটিই হলো নিত্যদিনের ব্যস্ততা। ব্যক্তিগত জীবনে প্রতিদিনের বহুবিধ ব্যস্ততার কারণে আমরা অতি আপনজন থেকে শুরু করে অনেক কাছের মানুষকেও ঠিকমতো সময় দিতে পারি না বা যোগাযোগ বজায় রাখতে পারি না। ফলে, ধীরে ধীরে আমাদের অজান্তেই এই সুন্দর সম্পর্ক থেকে বা একে অন্যের থেকে দূরে সরে যাচ্ছি। পরিবারের সদস্যদের দ্বারা মানসিকভাবে অবহেলা বা পরিত্যাগ গভীর মানসিক ক্ষত সৃষ্টি করতে পারে এবং পারিবারিক সম্পর্কের ক্ষতি করতে পারে। এ ছাড়াও রয়েছে ব্যক্তির ব্যক্তিগত পরিসরের বা স্বাধীনতার প্রয়োজনীয়তা থেকে সৃষ্টি হওয়া একা থাকার মানসিকতা।
এখনকার ছেলেমেয়েদের মধ্যে একা থাকার মানসিকতা গড়ে উঠেছে যা হয়তো ভবিষ্যতের জন্য যথেষ্ট উৎকণ্ঠার বিষয়। এই একা থাকার মানসিকতার কারণে তারা পরিবারের মানুষকে সময় দিতে চাই না, আত্মীয়স্বজনকে সময় দিতে বিরক্ত বোধ করে, এমনকি বন্ধু-বান্ধবদের সাথে সম্পর্ক থাকলেও তা যথেষ্ট ঋদ্ধতার হয় না। তৃতীয়ত, উল্লেখ করা যেতে পারে সংসারে নিজের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা বা রাখার আগ্রহ– যা প্রকাশিত হয় একক (নিউক্লিয়ার) পরিবারের প্রতি পক্ষপাতে। স্বামী-স্ত্রী ও শুধু নিজের সন্তান নিয়ে থাকার মানসিকতাও একটা অনেক বড় অবদান রাখে এই সম্পর্কের অবক্ষয়ের পেছনে তা আমাদের অজানা নয়।
ভার্চুয়াল ভাইরাস বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের প্রতি আসক্তি যা মুঠোফোনের অতিরিক্ত ব্যবহার থেকেই উদ্ভূত হয়, তা একটা বড় ভূমিকা পালন করে সম্পর্কের রূপরেখা পরিবর্তনে। মুঠোফোনের ব্যবহার আমাদের যোগাযোগ অনেক সহজ করে দিয়েছে সত্যি, কিন্তু এর বহুবিধ ও অতিমাত্রিক ব্যবহার আমাদের অনেক ব্যস্ত করে দিয়েছে। সহজ এই যোগাযোগের মাধ্যম আমাদের সম্পর্কের উন্নতি না করে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অবনতি করছে তার বিভিন্ন App-এর অতিমাত্রায় ব্যবহারের কারণে। চারপাশে তাকালে দেখা যায়, একই টেবিলে, একই জায়গায় বা একই ঘরের মধ্যে থেকেও প্রত্যেকে মুঠোফোন নিয়ে ব্যস্ত।
পরমত অসহিষ্ণুতা অর্থাৎ ব্যক্তিগত দ্বন্দ্ব এবং মতবিরোধ এরজন্য অনেকটাই দায়ী। মূল্যবোধ, বিশ্বাস, অগ্রাধিকার এবং ব্যক্তিত্বের পার্থক্য একটি পরিবারের মধ্যে মতবিরোধ এবং দ্বন্দ্বের দিকে নিয়ে যা পরবর্তীতে সম্পর্কের টানাপড়েন ঘটাতে ভূমিকা রাখে। কমিউনিকেশন গ্যাপ বা খোলা আলোচনার অভাবও পারিবারিক সম্পর্কে দেয়াল তুলে দেয়। মন খুলে কথা বলার অভাবে পরিবারের সদস্যরা তাদের ক্ষোভ, অতীতের আঘাত বা অমীমাংসিত সমস্যাগুলো ধরে রাখতে পারে যা সময়ের সাথে সাথে তাদের সম্পর্ককে নষ্ট করে দেয়।
'Sibling rivalry' বা সহোদরদের মধ্যে ঈর্ষা এবং প্রতিযোগিতা আরেকটি সাধারণ অথচ দুঃখজনক কারণ। ভাইবোনের প্রতিদ্বন্দ্বিতা এবং ঈর্ষা সম্পর্কের অবনতি ঘটাতে পারে, বিশেষ করে ভাইবোনের মধ্যে যখন তারা অনুভব করে, তারা পিতামাতার মনোযোগ বা তাদের সম্পদের জন্য প্রতিযোগিতায় রয়েছে। পরিবারের সদস্য সংখ্যা বৃদ্ধি এবং সদস্য পরিবর্তনের সাথে সাথে পরিবারের মধ্যে এক একজনের ভূমিকা এবং তাদের প্রত্যাশাগুলো পরিবর্তন হতে পারে, যা অনেক সময় বিভ্রান্তি এবং অস্বস্তির কারণ হতে পারে।
এবার আসি সম্পর্ক পুনরুদ্ধারে আমাদের করণীয় কী সে বিষয়ক আলোচনায়। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, পারিবারিক সম্পর্কের অবনতি সন্তানের শিক্ষায়, শৈশবে অভ্যন্তরীণ ব্যাধি এবং মানসিক স্বাস্থ্যে (হতাশা, উদ্বেগ ইত্যাদি) প্রভাব ফেলে (Brock & Kochanska, 2015; Steele et al., 2009; Mphaphuli, 2023)। প্রতিটি পরিবার অনন্য এবং পারিবারিক গতিশীলতার প্রকৃতি এক পরিবার থেকে অন্য পরিবারে ব্যাপকভাবে পরিবর্তিত হয়। এজন্য, পারিবারিক সম্পর্কের এই পরিবর্তনের মুখে সুস্থ, সুন্দর ও ইতিবাচক পারিবারিক সম্পর্ক বজায় রাখার জন্য খোলামেলা যোগাযোগ, সহানুভূতি এবং একে অপরকে বোঝার এবং সমর্থন করার ইচ্ছা অপরিহার্য। যদিও নষ্ট বা অবনীত পারিবারিক সম্পর্ক পুনরুদ্ধার করা একটি চ্যালেঞ্জিং/কঠিন ব্যাপার, তবে অসম্ভব নয়। এটি একটি ধীর এবং চলমান প্রক্রিয়া।
পারিবারিক সম্পর্ক পুনঃনির্মাণে সময় লাগতে পারে এবং পথে বাধা হতে পারে। তবে, ধৈর্য ধরে চেষ্টা করতে হবে। হয়তো অবিলম্বে ফলাফল আশা করা যাবে না, তবে ধীরে ধীরে সমস্যাগুলোর সমাধান সম্ভব। সম্পর্ক পুনরুদ্ধার করতে পারলে এর ভালো দিক বা সুবিধাই বেশি।
পারিবারিক সম্পর্ক পুনঃনির্মাণ এবং উন্নতিতে সাহায্য করতে পারে এমন কিছু পদক্ষেপের মধ্যে রয়েছে – প্রথমত, খোলামেলা এবং সৎ যোগাযোগ। পরিবারের প্রতিটি সদস্যের কী বলার আছে তা সক্রিয়ভাবে শুনতে হবে, তাদের দৃষ্টিভঙ্গি এবং অনুভূতি বোঝার চেষ্টা চেষ্টা করতে হবে। পরিবারের সকল সদস্যের মধ্যে খোলামেলা এবং সম্মানজনক যোগাযোগকে উৎসাহিত করতে হবে। সততার সাথে চিন্তাভাবনা এবং আবেগ ভাগ করে নেওয়ার গুরুত্বের ওপর জোর দিতে হবে। দ্বিতীয়ত, ক্ষমা চাওয়া এবং ক্ষমা করা। সম্পর্কের অবনতিতে যে অবদান রাখে তাকে তার কার্যকলাপের জন্য দায়িত্ব নিতে হবে এবং প্রয়োজনে আন্তরিক ক্ষমা প্রার্থনা করতে হবে। ক্ষমাকে সমস্যা সমাধানের জন্য একটি শক্তিশালী হাতিয়ার হিসেবে চিন্তা করে পরিবারের সদস্যদের তাদের অতীতের ভুলের জন্য ক্ষমা করার মানসিকতা গড়ে তুলতে হবে এবং ক্ষোভ ছেড়ে দিতে হবে।
তৃতীয়ত, একসঙ্গে গুণগত/মানসম্পন্ন সময় কাটানো। পরিবারের সদস্যদের সময় দিতে হবে এবং তাদের সাথে মানসম্পন্ন সময় কাটাতে হবে– যা পারিবারিক বন্ধনকে আরো শক্তিশালী করতে পারে। পারিবারিক আচার-অনুষ্ঠান, দেশীয় সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যগুলো আলোচলা করতে হবে, উপভোগ করতে হবে- যা পরে দীর্ঘস্থায়ী স্মৃতি তৈরি করতে পারে। পারিবারিক সম্পর্কের ছোটখাটো উন্নতিকে উপভোগ এবং উদযাপন করতে হবে।
চতুর্থত, সহানুভূতি এবং বোঝাপড়া। পরিবারের প্রতিটি সদস্যকে একে অন্যের দৃষ্টিভঙ্গি, অনুভূতি এবং চাহিদা বোঝার চেষ্টা করতে হবে এবং এই অনুযায়ী সহানুভূতি অনুশীলন করতে হবে। পরিবারের সদস্যদের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ সম্পর্ক থেকে সরে আসতে হবে। পঞ্চমত, দোষ এবং বিচার এড়িয়ে চলা। দোষারোপ না করে সমাধান খোঁজার দিকে মনোযোগ দিতে হবে। বিচারমূলক ভাষা এবং সমালোচনা এড়িয়ে চলা পুনর্মিলনের জন্য আরও ইতিবাচক পরিবেশ তৈরি করতে হবে। পরিবারের প্রতিটি সদস্যদের ব্যক্তিত্ব, বিশ্বাস এবং জীবনধারাই ভিন্নতা থাকতে পারে- বিচার ছাড়াই এই পার্থক্যগুলো গ্রহণ করার মানসিকতা গড়ে তুলতে হবে।
এবং সর্বোপরি, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, নিয়মিত আত্ম-বিশ্লেষণ। নিজের আচরণ, মনোভাব এবং ক্রিয়াকলাপ বিশ্লেষণ করতে হবে এবং তা কীভাবে সম্পর্কের অবনতিতে অবদান রাখছে বা রাখতে পারে তা চিহ্নিত করে সংশোধন করতে হবে। শান্ত থাকা এবং রাগ নিয়ন্ত্রণ করার কৌশল রপ্ত করতে হবে।
প্রতিদিনের পত্রিকা পড়লে আর চারপাশে খেয়াল করলেই দেখা যায়, দিনে দিনে আমাদের দেশে পারিবারিক সম্পর্কের যথেষ্ট অবনতি হচ্ছে। যত্ন, বোঝাপড়া এবং ভালোবাসার সাথে এই পারিবারিক সম্পর্কগুলোকে লালন করতে করতে হবে, এটাকে ‘নিশ্চিতভাবে ধরে নেওয়া (taken for granted)’ যাবে না। এটি একজনের পক্ষে সম্ভব নয়, পরিবারের প্রত্যেকে প্রত্যেকের জন্য একটি সহায়ক এবং পরিপূর্ণ পারিবারিক পরিবেশ তৈরির চেষ্টা করতে হবে। অন্যথায়, যথাযথ লালনের অভাবে এই সুন্দর পারিবারিক সম্পর্ক হয়তো আমরা হারিয়ে ফেলব।
ড. জিন্নাত আরা : রিসার্চ ফেলো, বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান
মন্তব্য করুন