সাম্প্রতিক সময় ইউক্রেন রাশিয়া যুদ্ধের একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ওয়াগনার গ্রুপের রাশিয়া যাত্রা। ওয়াগনার গ্রুপ একটি রুশ আধাসামরিক সংস্থা। একে একটি প্রাইভেট মিলিটারি কোম্পানি (PMC), ভাড়াটে সৈনিকদের একটি নেটওয়ার্ক বা রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সাবেক ঘনিষ্ঠ মিত্র ইয়েভগেনি প্রিগোজিনের একটি ডি ফ্যাক্টো প্রাইভেট আর্মি হিসেবে দেখা হয়।
রাশিয়ার পক্ষে যুদ্ধ করা ওয়াগনার গ্রুপ রাশিয়ার সামরিক নেতৃত্বের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে রাশিয়ার একটি আঞ্চলিক সামরিক হেডকোয়ার্টারের দখল করে নেয় এবং রাজধানী মস্কোর দিকে মার্চ করে। কেউ কেউ এটাকে পশ্চিমা বিশ্বের একটা কৌশল আবার কেউ কেউ পুতিনের কৌশল বলে মনে করছেন। কিন্তু আসলে ঘটনাটি কী?
ওয়াগনার গ্রুপ একটি ভাড়াটে সামরিক বাহিনী। কিছুদিন ধরেই লক্ষ্য করা গেছে রাশিয়ার সামরিক নেতারা বা প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে এই বাহিনীর দূরত্ব তৈরি হয়েছে। তারা বিদ্রোহ করার চেষ্টা করেছে। যুদ্ধাবস্থায় বিভিন্ন পক্ষ বিভিন্ন ধরনের আচরণ করতে পারে। এর পেছনে নানা রকমের কারণ থাকতে পারে। ওয়াগনার বাহিনীর বিদ্রোহের কারণ নিশ্চিত করে বলা এই মুহূর্তে সম্ভব নয়। আমরা এখন শুধু অনুমান করতে পারি।
ওয়াগনার গ্রুপের সঙ্গে পশ্চিমাদের একটা যোগাযোগ থাকতে পারে। আবার এই সুযোগে তারা তাদের প্রভাব বৃদ্ধির চেষ্টা করতে পারে। একটি দর কষাকষির জায়গা তৈরি করতে পারে। অন্যদিকে ভ্লাদিমির পুতিন স্বাভাবিকভাবেই তাদের ওপরে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করবেন এবং ওয়াগনার গ্রুপের সঙ্গে রাশিয়ার সামরিক নেতৃত্বের যে দূরত্ব তৈরি হয়েছে সেটি কমাতে চেষ্টা করবেন।
কন্সপারেসি থিউরিতে অনেক কিছুই বলা যায়। বলা যায়, এটি পুতিনের সৃষ্টি—আবার এটাও বলা যায়, এটি পশ্চিমাদের সৃষ্টি। কিন্তু বাস্তবতা হলো এরকম একটা মার্সেনারি বাহিনী সব সময় নিয়ন্ত্রণের মধ্যে থাকবে তা আশা করা বাতুলতা মাত্র। এ ধরনের বিদ্রোহমূলক আচরণ সব সময় অপ্রত্যাশিত নয়।
অনেকে মনে করছেন, ওয়াগনার বাহিনীর এই বিদ্রোহের ফলে ইউক্রেন যুদ্ধে বড় ধরনের প্রভাব পড়বে। কিন্তু বিষয়টা আসলে তেমন নয়। এই ক্ষণস্থায়ী বিদ্রোহের ফলে যুদ্ধের মোড় ঘোরার মতো তেমন পরিস্থিতি তৈরি হয়নি।
যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হলে এ ধরনের আরও ঘটনা হয়তো আমরা দেখব। আমরা দেখেছি এই সময়ে বেলারুশে অভ্যুত্থান চেষ্টা হয়েছে। রাশিয়ার ভিতরেও ভ্লাদিমির পুতিনকে ক্ষমতাচ্যুত করার চেষ্টা হচ্ছে। এই সবকিছুই যুদ্ধেরই অংশ। তবে সেগুলো যুদ্ধের মোড় ঘোরার মতো কোনো পরিস্থিতি নয়।
রাশিয়ার মতো একটি সামরিক পরাশক্তিকে এ ধরনের বিদ্রোহ দিয়ে পরাজিত করা সম্ভব নয় সেটি ওয়াগনার বাহিনী হোক বা অন্য কোনো বাহিনী। এই বিদ্রোহকে যুদ্ধের অংশ হিসেবেই দেখতে হবে। রাশিয়া চাইলে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে এ ধরনের বাহিনীর একটি বিদ্রোহকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে, সেটিও কম আলোচনার বিষয় নয়।
ইউক্রেন যুদ্ধটা আরও অনেক বেশি অনিশ্চয়তার দিকে যাচ্ছে। মাঝখানে যেসব শান্তি প্রচেষ্টা নেওয়া হয়েছিল সেগুলোও আলোর মুখ দেখেনি। এই মুহূর্তে ওয়াগনার বাহিনীর বিদ্রোহ রাশিয়ার জন্য একটি দুর্ঘটনা। এটি ইউক্রেনে রাশিয়ার অবস্থানকে কিছুটা প্রভাবিত করতে পারে।
ইউক্রেন রাশিয়া যুদ্ধ সারা বিশ্বের জন্য সংকট তৈরি করেছে। আমরা সবাই এটার ভুক্তভোগী। আবার কিছু কিছু দেশ এখান থেকে সুবিধা গ্রহণ করছে। এটা রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধে যেমন হচ্ছে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ও হয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ থেকে মার্কিনরা সুবিধা পেয়েছে। কোরিয়ান যুদ্ধ থেকে জাপানিজরা সুবিধা পেয়েছে। ভিয়েতনাম যুদ্ধ থেকেও জাপানিজরা বেনিফিটেড হয়েছে। কিছু দেশ সুবিধা পেলেও পৃথিবীর বেশিরভাগ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ইউক্রেনের ওপর রাশিয়ার আক্রমণেও পৃথিবীর কোটি কোটি মানুষ বিভিন্ন ধরনের সংকটের মধ্যে পড়েছে।
ইউক্রেন রাশিয়া যুদ্ধে বাংলাদেশ নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে এসময় বাংলাদেশের ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব বৃদ্ধি পেয়েছে। যুদ্ধ চলমান থাকায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনের মধ্যে যে মেরুকরণ সেটি আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। সেখানে বাংলাদেশ দর কষাকষির জায়গা তৈরি করতে পারে। কিন্তু যুদ্ধ থেকে সুবিধা নেওয়ার মতো কোনো অবস্থানে নেই বাংলাদেশ।
নতুন করে সংকটে পড়ার তেমন কোনো আশঙ্কা বাংলাদেশের সামনে নেই। বাংলাদেশের এখনকার যে সংকটময় পরিস্থিতি রয়েছে সেগুলো কাটিয়ে উঠতে হবে। যুদ্ধ দীর্ঘদিন চলমান থাকায় একটি স্থিতাবস্থা তৈরি হয়ে গেছে। শুরুর দিকে যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল এখন সেটা নেই। দীর্ঘদিন যুদ্ধ চলমান থাকায় বৈশ্বিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা নতুন করে সাজানো হয়েছে। তবে বাংলাদেশের নতুন কোনো সংকটে পড়ার সম্ভাবনা নেই। বিদ্যমান সংকটগুলো মোকাবিলায় সঠিক কর্মপন্থা নির্ধারণ করা প্রয়োজন।
ড. দেলোয়ার হোসেন: অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়; সদস্য, সরকারি কর্ম কমিশন
মন্তব্য করুন