পপুলেশন ডিভিডেন্ড সদ্ব্যবহারে আমরা খুব বেশি নজর দেইনি। অনেকেই মনে করেন, এটা এমনিতেই অর্জন হয়ে যাবে। কিন্তু যারা পপুলেশন ডেভেলপমেন্ট নিয়ে কাজ করেন তারা মনে করেন এটা বড় একটি ইস্যু। তারা এটিকে শ্রমশক্তির একটি বড় খাত মনে করেন। আমরা আমাদের নীতিনির্ধারণে বলেছি, জনসংখ্যার সঙ্গে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডের সম্পর্ক রয়েছে। ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড দুই ধরনের - ফার্স্ট ডেমোগ্রাফিক ডিফিডেন্ট এবং সেকেন্ড ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড। এই দুইটিই আসে জনসংখ্যা থেকে।
প্রথম ধারণাটির অর্থ হলো শ্রমিকের প্রবৃদ্ধি জনসংখ্যার প্রবৃদ্ধি থেকে বেশি হবে। যেদিন থেকে জনসংখ্যার প্রবৃদ্ধি থেকে শ্রমশক্তির প্রবৃদ্ধি বেশি হবে এবং যে পর্যন্ত এটি চলবে সেটাকে আমরা বলি উইন্ড অফ অপরচুনিটি। অর্থাৎ এই সময়টাতে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড হবে। বাংলাদেশে এই পর্যায়টি শুরু হয়েছে ১৯৮০-এর দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে। আগামী ২০৪৭ সাল নাগাদ এই পর্যায়টি শেষ হয়ে যেতে পারে। সেই হিসেবে আমরা আমাদের ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডের ৬৬ থেকে ৭০ শতাংশের মতো সময় শেষ করে ফেলেছি।
কিন্তু এই সুযোগটা আমরা তেমন কোনো কাজে লাগাতে পারিনি। আমাদের জিডিপি রেশিওতে অথবা শ্রমিকদের আয় রেশিওতে আমাদের সর্বোচ্চ ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড কী হতে পারত সেটা আমরা পরিমাপ করতে পারিনি। কিন্তু আমরা বলে যাচ্ছি, আমাদের ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড ছিল, এখনও রয়েছে এবং আগামী ২০-২৫ বছর এটা থাকবে। আমরা বলছি, এই সুবিধাটা কাজে লাগিয়ে আমরা উচ্চপ্রবৃদ্ধি অর্জন করতে পারব। কিন্তু আমাদের দুর্বল পলিসির কারণে আমরা এই সুযোগটা ভালোভাবে কাজে লাগাতে পারিনি।
আমরা আমাদের শিক্ষার হার বাড়াতে পারিনি, শিক্ষার মান বাড়াতে পারিনি, কারিগরি শিক্ষার প্রসার ঘটাতে পারিনি, কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে পারিনি, যুব শ্রেণির একটা বড় অংশ বেকার রয়ে গেছে। বিশেষ করে নারীদের জন্য পর্যাপ্ত কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে পারিনি এবং এখনও বাল্যবিয়ে হচ্ছে। এসব কারণে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডের অনেক কিছুই আমরা কাজে লাগাতে পারিনি।
সেকেন্ড ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড বিষয়টি একটু আলাদা। যাদের বয়স হয়েছে এবং যারা রিটায়ার করবেন তাদের যদি সেভিংস অনেক বেশি হয় তাহলে সেই টাকাটা তারা কী করবেন? তারা সেই টাকাটি খরচ করবেন, হয় বিনিয়োগ করবেন অথবা বেশি বেশি ভোগ করবেন। আমরা যদি জাপান বা কোরিয়ার মতো দেশের দিকে তাকাই তাহলে দেখব সেখানে ফাস্ট ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড থেকে তারা যতটা বেনিফিট পেয়েছে তার থেকে অনেক বেশি বেনিফিট পেয়েছে সেকেন্ড ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড থেকে। কিন্তু বাংলাদেশ সেকেন্ড ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডের জন্য একদমই তৈরি নয়। আর এর মূল কারণ হলো আমাদের পরিকল্পনার অভাব। আমাদের বয়স্ক ব্যক্তিদের জন্য কোনো সেভিংস স্কিম বা পেনশন প্ল্যানিং ছিল না। আমাদের পেনশন প্ল্যানিং শুরু হয়েছে মাত্রই। আর এখান থেকে সুবিধা পেতে এখনো ৩০-৪০ বছর সময় লাগবে।
কানাডা নরওয়ে সুইডেন কিংবা উন্নত দেশগুলোর দিকে তাকালে দেখা যায় তাদের পেনশন স্কিম অনেক বড় একটি ফান্ড। তারা এই অর্থ বিভিন্ন উন্নয়ন কাজে খরচ করতে পেরেছে। সেই জায়গা থেকে দেখলে আমাদের এখন সেকেন্ড ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডের জন্য তৈরি হওয়া উচিত। এর জন্য আমাদের পলিসিগত পার্থক্য থাকবে।
বাংলাদেশ অনেক বড় একটি সুবিধা পেতে পারে জেন্ডার ডিভিডেন্ড থেকে। জেন্ডার ডিভিডেন্ড কম হওয়ার জন্য একটি দেশের ক্ষেত্রে যে কারণগুলো থাকে সেই সব কারণগুলো বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও রয়েছে। যেমন- বাল্যবিয়ে, আনুষ্ঠানিক শ্রমশক্তিতে নারীদের কম অংশগ্রহণ, জেন্ডারভিত্তিক ওয়েজ গ্যাপ, নারীদের আন পেইড ওয়ার্কসহ আরও অনেক কিছু। আবার পুরুষ যুবসমাজের থেকে নারী যুবসমাজের কর্মক্ষেত্রে অংশগ্রহণ অনেক কম। এসব ক্ষেত্রে যদি পরিবর্তন আসে যদি নারীদের কর্মক্ষেত্র অংশগ্রহণ বাড়ে, তাহলে শুধু জেন্ডার ডিভিডেন্ড থেকেই আমাদের দেশে একটি বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটতে পারে। উদাহরণ হিসেবে আমরা ধরতে পারি আফ্রিকান দেশ লাইব্রেরিয়াকে। বিশ্বব্যাংকের একটি গবেষণায় দেখা গেছে সেখানে জেন্ডার ডিভিডেন্ড থেকে অর্থাৎ শুধু নারীদের থেকে সে দেশের জিডিপির ৪৯ শতাংশ আসতে পারে।
আমি সম্প্রতি জেন্ডার অ্যান্ড ইকোনমিক ডেভেলপমেন্ট নিয়ে লাউপিডিয়ারের সঙ্গে একটি প্রজেক্টে কাজ করেছি। সেখানে আমরা একটি জেন্ডার ডিভিডেন্ড মডেল করেছিলাম। সেখানে আমরা দেখেছি লাউপিডিয়ারে কর্মক্ষেত্রে নারীদের অংশগ্রহণ পুরুষদের প্রায় সমান। সেখানে আমরা জেন্ডার ডিভিডেন্ড দেখেছি জিডিপির ১৭ থেকে ২১ শতাংশ।
বাংলাদেশের জেন্ডার ডিভিডেন্ড লাউপিডিয়ার সমান হবে। কারণ আমাদের বেতন পার্থক্য অনেক বেশি এবং আমাদের দেশে নারীদের অবৈতনিক কাজের পরিমাণ অনেক বেশি। এখন আমাদের দেখতে হবে ফাস্ট ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড থেকে আমরা কতটুকু সুবিধা নিতে পারি। এ অবস্থা আমাদের জন্য আর ২০ বছর চলবে। এরপর সেকেন্ড ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডের সময়কাল আনলিমিটেড। কারণ আমাদের সবারই বয়স হবে এবং আমরা বার্ধক্যের দিকে যাব। বাংলাদেশ ধীরে ধীরে সেকেন্ড ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্টের দিকে যাচ্ছে।
এখন আমাদের করণীয় কি? আমাদের জেন্ডার ডিভিডেন্ড নিয়ে আমরা কি করতে পারি? প্রথমত, আমরা যদি নারীদের অনেক বেশি পরিমাণ বেতনভুক্ত কর্মে যুক্ত করতে পারি তাহলে অর্থনীতিতে একটি বড় প্রভাব পড়বে। দ্বিতীয়ত, আমাদের শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য খাতে অনেক চাকরির সুযোগ রয়েছে। অর্থাৎ সার্ভিস সেক্টরে ব্যাপক কর্মী চাহিদা রয়েছে। এই চাহিদাটা মূলত নারীরা পূরণ করতে পারেন। এ ছাড়া হসপিটালিটি সেক্টরে আমরা উন্নতি করতে চাচ্ছি। সেখানেও বেশিরভাগ নারী কর্মী প্রয়োজন। আমরা যদি নারীদের এসব সেক্টরে নিয়ে আসতে চাই তাহলে আমাদের কী করতে হবে, তা নিয়ে আমাদের নীতিনির্ধারকদের ভাবতে হবে।
নারীদের কর্ম ক্ষেত্রে আনতে হলে আমাদের কেয়ার সার্ভিস তৈরি করতে হবে। কমিউনিটি বেইজ কেয়ার সার্ভিস থাকলে নারীরা তার সন্তানকে সেখানে রেখে নিশ্চিন্তে কর্ম ক্ষেত্রে যেতে পারেন। বাংলাদেশে মূলত সন্তান লালন-পালনের জন্যই নারীরা চাকরি ক্ষেত্রে যেতে পারেন না।
কর্মক্ষেত্রে নারীদের জন্য সেফটি এবং সিকিউরিটির উন্নতি করতে হবে। সরকারকেই এটার দায়িত্ব নিতে হবে। এসব জায়গায় ডেভেলপ করতে পারলে ব্যাপক পরিমাণ নারী কর্ম ক্ষেত্রে যুক্ত হতে পারবেন। আর এটা হলে এক ধরনের রেভুলেশন হবে। শুধু জিডিপির প্রবৃদ্ধি নয় পাশাপাশি নারীর ক্ষমতায়ন এবং জীবনযাত্রার মান উন্নত হবে।
পলিসিগত দিক থেকে আমাদের ম্যাক্রোপলিসির দিকে নজর দেওয়া জরুরি। আমাদের নতুন অর্থনৈতিক পণ্য তৈরি করতে হবে যাতে এসব জায়গায় আমাদের সঞ্চয় বৃদ্ধি পায়। আমরা আমাদের সঞ্চয় জমি কিনে বা অন্য কোনো ভাবে গচ্ছিত রাখি। কিন্তু এই সঞ্চয় যদি আমরা উৎপাদনমুখী ক্ষেত্রে কাজে লাগাতে পারি তাহলে সেটা দেশের অর্থনীতিকে পরিবর্তন করতে বড় ভূমিকা রাখতে পারে।
এখন প্রশ্ন আসে, এসব উদ্যোগ সরকার নেবে না কি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো নেবে? এ সব উদ্যোগ গ্রহণের জন্য এই মুহূর্তে এত বাজেট প্রণয়ন করা সরকারের পক্ষে সম্ভব নয়। আমি মনে করি এখানে শুরুটা করতে পারে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো অথবা পাবলিক সেক্টর। আমরা কমিউনিটি পর্যায়ে উদ্যোগ নিতে পারি। স্থানীয় নারীদের ট্রেনিং দিয়ে তাদেরই কাজে লাগাতে হবে। এভাবে আমরা খুব কম খরচে তাদের এগিয়ে নিতে পারব। এই মুহূর্তে আমাদের দরকার স্বল্প খরচে মানসম্মত কেয়ার সার্ভিস।
আমরা আমাদের যুবসমাজকে যেভাবে প্রশিক্ষণ দিচ্ছি তার বেশিরভাগই অকার্যকর। শিক্ষার্থীদের মার্কেটভিত্তিক প্রশিক্ষণ দেওয়া দরকার। আমাদের দেশে যেসব বিষয়ে মাস্টার্স পড়ানো হয় তার বেশিরভাগই কাজে লাগে না। আমাদের শিক্ষার কারিকুলামগুলো আপডেট করা দরকার। আমাদের ভোকেশনাল ট্রেনিংয়ের ক্ষেত্রকে আরও উন্নত করা দরকার। আমরা অন্যান্য দেশের মডেলগুলোকে দেখব ও যাচাইবাছাই করব। কিন্তু নিজেদের জন্য আমাদের নিজস্ব ও স্বতন্ত্র একটি মডেল থাকা দরকার।
শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কেয়ার ইকোনমি এবং হসপিটালিটি—এই ৪টি ক্ষেত্র আমাদের কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে একটা বিরাট পরিবর্তন নিয়ে আসবে। আমরা এদিকে দৃষ্টি দিলে আগাম ১০-১৫ বছরের মধ্যে এই সেক্টরগুলোর ব্যাপক বিস্তৃতি ঘটবে, অর্থনীতিও গতিশীল হবে।
ড. বজলুল হক খন্দকার : অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
মন্তব্য করুন