ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে পুলিশের গুলিতে ১৭ বছর বয়সী এক আলজেরীয়-বংশোদ্ভূত তরুণ নিহত হওয়ার ঘটনায় ফুঁসছে ফ্রান্স। পুলিশের গুলিতে নিহত হওয়ার ঘটনা এবং ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে টানা তিন রাতের সহিংসতা ও দাঙ্গা ফ্রান্সের পুলিশিং কাঠামো এবং পদ্ধতিকে আরও একবার প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।
ফরাসি পুলিশের কার্যক্রমের সমালোচনা করা সর্বশেষ আন্তর্জাতিক সংস্থা জাতিসংঘের মানবাধিকার হাইকমিশন (OHCHR)। শুক্রবার সংস্থাটির কার্যালয় থেকে বলা হয়, গুলি চালানোর ঘটনাটি ‘ফ্রান্সের আইন প্রয়োগকারী সংস্থার গভীর বর্ণবাদ এবং জাতিগত বৈষম্যমূলক আচরণের প্রকাশ’।
ওএইচসিএইচআরের মুখপাত্র রাভিনা শামদাসানি বলেছেন, কর্তৃপক্ষকে এটা নিশ্চিত করতে হবে যে, পুলিশ বাহিনীর ব্যবহার সর্বদা বৈধতা, প্রয়োজনীয়তা, আনুপাতিকতা, বৈষম্যহীনতা, সতর্কতা এবং জবাবদিহিতার নীতিগুলোকে সম্মান করে।
নাহেল নামের ওই কিশোরের মৃত্যু ২০২৩ সালে ফ্রান্সে ট্রাফিক স্টপ চলাকালে পুলিশের গুলি চালানোর তৃতীয় মারাত্মক ঘটনা। গত বছর ফ্রান্সে পুলিশের গুলিতে রেকর্ডসংখ্যক ১৩ জনের মৃত্যু হয়েছিল। ২০২১ সালে এ সংখ্যা ছিল তিনটি এবং ২০২০ সালে দুটি।
২০১৭ সাল থেকে পুলিশের গুলিতে নিহতের শিকাররা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কৃষ্ণাঙ্গ বা আরব বংশোদ্ভূত। এটি ফরাসি আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর মধ্যে সিস্টেমিক বর্ণবাদের দাবিকে আরও শক্তিশালী করে৷
সামাজিক ক্যাম্পেইন গ্রুপ ‘এসওএস রেসিজম’র প্রধান ডমিনিক সোপো বলেন, আমরা কীভাবে শান্ত হব! আমরা কীভাবে চুপ করব! আমরা কীভাবে নিশ্চিত হব আমাদের এই পুলিশ বাহিনী এরপর আর কোনো কৃষ্ণাঙ্গ এবং আরবকে দেখে বর্ণবাদী শব্দ ব্যবহার করে চিৎকার করবে না? আমরা কীভাবে নিশ্চিত হব আমাদের এই পুলিশ বাহিনী কৃষ্ণাঙ্গ এবং আরবদের মাথায় আর গুলি চালাবে না?
অনেক পুলিশ সদস্যের মধ্যে প্রাতিষ্ঠানিক বর্ণবাদের বাইরেও, ফরাসি পুলিশিং দায়িত্ব পালনের সময় তাদের মাঝে সহিংসতার প্রবণতা রয়েছে যা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ এবং ইউরোপ কাউন্সিলসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর রিপোর্টেও হাইলাইট করা হয়েছে। বিক্ষোভের সময় পুলিশ গুলি চালিয়েছে, টিয়ারগ্যাস, গ্রেনেড নিক্ষেপ করেছে, রাবার বুলেট এবং বড় ফ্ল্যাশ বল নিক্ষেপ করেছে। পুলিশের এই সহিংস আক্রমণে ব্যাপকভাবে শারীরিক আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছেন বিক্ষোভকারীরা।
ফরাসি পুলিশের দমনমূলক এবং পক্ষপাতী আচরণকে অনেক সমালোচক দীর্ঘকাল ধরে একটি ট্যাবু হিসেবে দেখে আসছেন। তবে সমালোচকরা বলছেন, পুলিশের এই সহিংস আচরণ এখন একটি প্রধান রাজনৈতিক সমস্যা হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে, ২০১৮-১৯ সালের ‘গিলেটস জাউনস’ বিক্ষোভে পুলিশের সহিংস আচরণের পর থেকে প্রশ্ন উঠছে ফ্রান্সের পুলিশ বাহিনী নিয়ে। ওই বিক্ষোভ চলাকালে পুলিশের হামলায় অন্তত ২ হাজার ৫০০ মানুষ আহত হয়েছিল। এর মধ্যে অনেকেই হারিয়েছিলেন তাদের চোখ বা অন্য কোনো অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ।
একই বিক্ষোভে কমপক্ষে ১ হাজার ৮০০ জন পুলিশ সদস্যও আহত হয়েছিল। ফরাসি পুলিশের অভিযোগ, বিক্ষোভকারীরা পুলিশের ওপর সহিংস আক্রমণ করেছে যাতে অনেক পুলিশ সদস্য পঙ্গুত্ববরণ করেছে, এমনকি পুলিশ সদস্যদের হত্যার লক্ষ্যেও আক্রমণ চালিয়েছে বিক্ষোভকারীরা। চলতি বছর পেনশন সংস্কারের বিক্ষোভও একই রকম নৃশংস দৃশ্যের দিকে পরিচালিত করেছিল। শুধু মার্চ মাসেই বিক্ষোভ ঠেকাতে গিয়ে আহত হয়েছিল এক হাজার পুলিশ সদস্য।
ইউরোপজুড়ে পুলিশিং অধ্যয়নের বিশেষজ্ঞরা যারা পুলিশিং কাঠামো এবং পদ্ধতির মৌলিক পার্থক্য ও কৌশল নিয়ে গবেষণা করেন তারা বলছেন, ফরাসি পুলিশ এবং জেন্ডারমেসরা নিজেদের জনগণের সেবক হিসেবে নয় বরং সরকারের রক্ষক হিসেবে দেখে।
ফলস্বরূপ, ফ্রান্সে পুলিশের সাথে জনসাধারণের সম্পর্ক ব্রিটেন বা জার্মানির পুলিশের সাথে সে দেশের জনসাধারণের সম্পর্কের থেকে আলাদা। বিষয়টি ফ্রান্সের রাস্তায় রাজনৈতিক প্রতিবাদের দীর্ঘ ঐতিহ্যের সাথে সম্পর্কিত। গবেষকরা বলছেন, পুলিশ নিজেদের অবরুদ্ধ মনে করে এবং নিজেদের অবস্থান ছাড়তে অনিচ্ছুক।
অপরাধতত্ত্ববিদ সেবাস্তিয়ান রোচে বলেন, ফরাসি পুলিশিং পদ্ধতি প্রতিবাদকে শান্ত করার লক্ষ্যে পরিচালিত হয় না বরং এটি সংঘাতমূলক এবং ইচ্ছাকৃতভাবে সংঘাতকে বাড়িয়ে দেয়। অন্যান্য গবেষকরা ফরাসি পুলিশিং পদ্ধতিকে সংজ্ঞায়িত করতে ব্যবহার করেছেন বিশৃঙ্খল, আক্রমণাত্মক, কর্তৃত্ববাদী, নৃশংসতার মতো শব্দগুলো।
রোচে বলেন, ফরাসি পুলিশের একমাত্র কাজ ‘সমাজ থেকে দূরে থাকা এবং শুধু ক্ষমতার মসনদের ডাকে সাড়া দেওয়া’।
সেবাস্তিয়ান রোচে আরও বলেন, বেশিরভাগ ইউরোপীয় দেশের পুলিশ বাহিনীর তুলনায় ফরাসি পুলিশ অনেক বেশি অস্ত্র বহন করে এবং তারা এমন সব অস্ত্র মোতায়েন করে যেগুলো বেশিরভাগ দেশেই নিষিদ্ধ। এর একটি কারণ হিসেবে দেখানো হয়েছে- ২০১৮ সাল থেকে ফ্রান্সের বিভিন্ন বিক্ষোভে ৩৬ জন পুলিশ সদস্য মারাত্মকভাবে আহত হয়েছে এবং গত ১০ বছরে নিহত হয়েছে তিনজন পুলিশ সদস্য।
এই বছরের শুরুতে ফরাসি গণমাধ্যম লে মন্ডেকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে অপরাধতত্ত্ববিদ সেবাস্তিয়ান রোচে বলেছিলেন, ফ্রান্সের পুলিশের তুলনায় জার্মানি, স্ক্যান্ডিনেভিয়া এবং ইংল্যান্ডে পুলিশকে বেশি সম্মান করা হয়। আর এর কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, এসব দেশের পুলিশের কাজ অনেক সম্মানজনক।
রোচে রলেন, বিক্ষোভকারীদের শান্ত করা এবং তাদের নিরস্ত্র করা আমাদের প্রতিবেশীদের বিভিন্ন সংস্কৃতির ফল নয় বরং সেসব দেশের পুলিশ শক্তি প্রদর্শন না করার জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যায়।
রাস্তা থেকে দূরে থাকা ফরাসি রাজনীতিবিদরা- বিশেষ করে অভ্যন্তরীণ এবং প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়, যারা জাতীয় পুলিশ বাহিনীকে নিয়ন্ত্রণ করে তারা দীর্ঘদিন ধরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সমালোচনা থেকে রক্ষা করে আসছেন। তারা জনসাধারণের বিশ্বাসের ভাঙনকে প্রশ্রয় দিয়েছেন৷
পুলিশিং ইস্যুতে বিশেষজ্ঞ আরেকজন গবেষক জ্যাক ডি মেইলার্ড বলেন, ‘ফ্রান্সের পুলিশ বাহিনী এখন ‘নিয়োগ, প্রশিক্ষণ, দর্শন এবং ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে প্রকৃত কাঠামোগত সমস্যার সম্মুখীন’।
তিনি বলেন, ফ্রান্সের পুলিশিং সিস্টেমটিকে সম্পূর্ণরূপে পুনর্মূল্যায়ন করা দরকার। নতুন অনুশীলন শুরু করতে হবে। শক্তির আনুপাতিক ব্যবহার এবং জনসাধারণের সাথে সুসম্পর্ককে পরম অগ্রাধিকার দিতে হবে।
মূল: জন হেনলি, সংবাদমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ানের একজন ইউরোপ করাসপনডেন্ট
ভাষান্তর: মুজাহিদুল ইসলাম
মন্তব্য করুন