বৃহস্পতিবার অনুষ্ঠিত নির্বাচন পাকিস্তানের সমস্যাগুলো সমাধান না করে বরং দেশটিকে আরও গভীর সংকটের মধ্যে নিমজ্জিত করেছে৷ দেশের ক্ষমতাধর সামরিক এলিটরা যেমনটা চেয়েছিল তা হয়নি। তারা নওয়াজ শরিফের পাকিস্তান মুসলিম লীগ (পিএমএল)-এর জয়ের জন্য চেষ্টার কোনো কমতি রাখেনি। তবে পাকিস্তানি ভোটাররা ইমরান খানকেই বেছে নিতে চেয়েছেন। পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফকে (পিটিআই) ভোট দিয়ে বংশবাদী রাজনীতির প্রতি মানুষ তাদের চূড়ান্ত অসন্তোষই যেন দেখালেন।
ইমরান খান ২০১৮ সালের নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। সেনাবাহিনী সে সময় ইমরান খানকে সমর্থন দিয়েছিল বলে অভিযোগ রয়েছে। ২০২২ সালের এপ্রিলে এক সংসদীয় অনাস্থা ভোটের মাধ্যমে ক্ষমতাচ্যুত হন ইমরান খান। আগে থেকেই নানামুখী সংকট চলতে থাকা দেশটিতে এই সময়ে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকট আরও তীব্র আকার ধারণ করে।
ইমরান খানকে ক্ষমতাচ্যুত করার পেছনে সেনাবাহিনীর হাত ছিল বলে সন্দেহ করা হয়। ষড়যন্ত্রের জন্য আমেরিকার সঙ্গে সামরিক এলিটদের দায়ী করেছিলেন ইমরান খান। তাই পাকিস্তানের সামরিক এলিটরা কোনোভাবেই চায়নি ইমরান খান আবারও দেশের প্রধানমন্ত্রী হোন। এ কারণে নওয়াজ শরিফ গং-কে সবধরনের পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছে তারা। সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান ও তার দল পিটিআইকে নির্বাচন থেকে দূরে রাখার সব ধরনের চেষ্টাই করা হয়েছে। এমনকি ইমরান খানকে কারাগারে রেখেই নির্বাচন আয়োজন করা হয় এবং পিটিআইকে নির্বাচন থেকে নিষিদ্ধ করা হয়।
পাকিস্তানি তরুণদের মধ্যে ব্যাপক জনপ্রিয়তা রয়েছে ইমরান খানের। তারা পিটিআইকে সমর্থন করেছে এবং বাধা ও প্রতিকূলতা কাটিয়ে দলের জন্য কাজ করে গেছে। তারা ব্যাপক দমন-পীড়নের স্বীকার হয়েও হার মানেনি। তারা এআই প্রযুক্তি ব্যবহার করে ইমরান খানের বক্তব্য দেশবাসীর কাছে পৌঁছে দিয়েছে। যদিও নির্বাচনে পিটিআইয়ের জনপ্রিয় প্রতীক নিষিদ্ধ করা হয়েছে এবং পিটিআই সমর্থিত প্রার্থীদের কোনো একক প্রতীকে নির্বাচন করতে দেওয়া হয়নি। তারা স্বতন্ত্রভাবে ভিন্ন ভিন্ন প্রতীকে নির্বাচন করেছেন। মানুষ ভোটের মাধ্যমে ইমরান খানের প্রতি তাদের সমর্থন দেখিয়েছে।
সবধরনের বাধা সত্ত্বেও নির্বাচনে সবচেয়ে বেশি আসনে জয় পেয়েছে পিটিআই সমর্থিত প্রার্থীরা। কারাগারে থেকেও ইমরান খান যে ভোট বিপ্লব দেখিয়েছেন তা অবাক করেছে সমগ্র পাকিস্তানকে। নির্বাচনে সবচেয়ে বেশি আসন পেয়েও সরকার গঠন করতে পারছেন না ইমরান খান। সামরিক পৃষ্ঠপোষকতায় নওয়াজ শরিফ ও বিলাওয়াল ভুট্টো-গং ক্ষমতাসীন হলেও তাতে পাকিস্তানি নাগরিকদের মতের প্রতিফলন ঘটে না। ফলে নির্বাচনের পর পাকিস্তানের রাজনৈতিক সংকটের সমাধান না হয়ে বরং সংকটকে আরও বাড়িয়ে দিতে পারে।
পিটিআই দাবি করেছে, তারা নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা সত্ত্বেও প্রতারিত হয়েছে। পিটিআইকে সরকার গঠন করতে দেওয়ার স্বীকৃতির দাবিতে রাস্তায় নামতে ইচ্ছুক দলটির নেতা-কর্মীরা। লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড থেকে পিটিআইকে বঞ্চিত করা হয়েছিল এতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে পাকিস্তানের পূর্ববর্তী নির্বাচনগুলোতেও সামরিক সংস্থার অপছন্দের যে কোনো দলের ক্ষেত্রে এমনটাই হয়েছে। দলগুলো তখন সামরিক বাহিনীর সঙ্গে দর কষাকষি করে এগিয়ে যাওয়ার পথ খুঁজেছে।
পাকিস্তানের প্রতিটি প্রধান রাজনৈতিক দলের প্রধানরা ক্ষমতায় থাকার জন্য কোনো না কোনো সময়ে সামরিক জেনারেলদের সঙ্গে যোগসাজশ করেছেন। স্থায়ী রাষ্ট্রকাঠামো বিনির্মাণে ব্যর্থ হয়েছেন এবং উচ্ছৃঙ্খলতার শিকারও হয়েছেন একেকজন। পাকিস্তানের জন্য জরুরি হলো- সামরিক বাহিনীকে রাজনীতি থেকে দূরে রাখা এবং রাজনীতিবিদরা সামরিক বাহিনীকে রাজনৈতিক বিরোধের চূড়ান্ত সালিশ হতে না দিয়ে একে অপরের সঙ্গে আপস মীমাংসায় কাজ করা।
তবে ৮ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনের পর এটি আরও বেশি কঠিন হয়ে পড়েছে বলে মনে হচ্ছে। ইমরান খানের রাজনীতির জন্য বড় সুবিধা হলো তার রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীরা হয় দুর্বৃত্ত না-হয় বিশ্বাসঘাতক। ইমরান খান সর্বদা রাজনীতিতে সামরিক বাহিনীর হস্তক্ষেপ মোকাবিলা করতে পছন্দ করেছেন। তিনি আরও বেশি ক্ষমতা নিয়ে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার অভিপ্রায়ে জনপ্রিয়তা লাভ করতে চান। অন্যদিকে তার রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীরা সামরিক বাহিনীর আশীর্বাদে ক্ষমতায় থাকতে চায়। তারা জোট সরকার গঠন করতে আগ্রহী বলে মনে হচ্ছে।
ভোটাররা সামরিক এলিটদের উচিত জবাব দিতে চেয়েছিলেন। তবে ইমরান খানসহ রাজনৈতিক নেতাদের পদক্ষেপ সেনাবাহিনীর রাজনৈতিক ভূমিকা অব্যাহত রাখার মঞ্চ তৈরি করতে পারে। যদি রাজপথে সহিংসতা হয়, তাহলে দেশে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার জন্য আবারও সেনাবাহিনী সামনে চলে আসতে পারে। এদিকে ব্যক্তিস্বার্থের খেয়ালে পাকিস্তানের রাজনীতিবিদরা দেশের অর্থনীতিকে সম্পূর্ণরূপে উপেক্ষা করেছেন এবং বৈদেশিক সম্পর্ককে বিপর্যস্ত করে তুলেছেন।
পাকিস্তান যে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে তার সমাধান ছিল একটি সুষ্ঠু নির্বাচন এবং জনগণের ম্যান্ডেট নিয়ে ক্ষমতায় আসা একটি শক্তিশালী সরকার। ৮ ফেব্রুয়ারির নির্বাচন সেই পথে শক্ত বাধা হয়ে দাঁড়ালো। নির্বাচন পাকিস্তানকে আরও গভীর সংকটের মধ্যে নিমজ্জিত করেছে৷
হোসেন হাক্কানি: মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পাকিস্তানের সাবেক রাষ্ট্রদূত। ভাষান্তর: মুজাহিদুল ইসলাম
মন্তব্য করুন