মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১
রেজওয়ান উর রহমান
প্রকাশ : ১১ এপ্রিল ২০২৪, ০৯:০৯ পিএম
অনলাইন সংস্করণ

‘আজ ভুলে যা তোর দোস্ত-দুশমন, হাত মেলাও হাতে’

ছবি : সংগৃহীত
ছবি : সংগৃহীত

বোধ করি, দীর্ঘ বিরতির পরে কোভিড পরিবর্তী জন-জীবনে ছায়া হয়ে এসেছে- ঈদের আনন্দ। নতুন জামা, হরেক রকমের ভোজন মুসলমান বাঙালির এটাইতো ঈদ উৎসব! আমরা মনে হয় বড্ড বেশি মেকি হয়ে গেছি আমাদের ঈদ উৎসব গুলোকে নিয়ে; রমজানের দর্শন ও এর মহিমা আমাদের জীবনের সঙ্গে কীভাবে মিশে আছে সেটা অনুপস্থিত!

যাই হোক, এই রমজান এলে ধর্মীয়ভাবে যেমন ইবাদাত ও ইফতার নিয়ে আমারা ব্যস্ত থাকি; ঠিক তেমনি আরেকটি উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হলো- জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের সেই অনবদ্য গান- ‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ।’ কবি গানটি এমনভাবে লিখে গিয়েছেন- রমজানের মূল্যবোধ, করণীয় সুনিপুণরূপে সুস্পষ্ট। কিন্তু, এই গানটির শানে নুজুল কী ছিল? কীভাবে কবি সৃষ্টি করলেন এমন একটি গানের!

জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের প্রতি খুব ছোটবেলা থেকেই আমরা বাঙালিরা পরিচিত; তাতে কোনো প্রকার সন্দেহ নেই, কী পাঠ্যপুস্তক বা পারিবারিক পরিমণ্ডলে! কিন্তু, মুশকিলটা হলো; এই মহীয়সী আমাদের মাঝে এমন কিছু রেখে গেছেন; যা কি না আমরা নেহাতই আয়ত্ত করে যাচ্ছি হয় পাঠ্যপুস্তকে, হোক সেটা মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক, স্নাতক কিংবা স্নাতকোত্তর!

কাজী নজরুল ইসলাম; বাংলা গানে হরেক রকম মাত্রা যোগ করেছেন, করেছেন বাংলা গানকে সমৃদ্ধ। এ এক রীতিমতো পরশপাথরের মতো, যেটাকে মন থেকে না ছুঁয়ে দেখলে উপলব্ধি করা দুরূহ এবং শুধু সে কারণেই এই মহামানবের সৃষ্টি একেকটি ঘটনার সাক্ষী ও শিক্ষণীয় বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। আবেগের সুউচ্চ সীমায় আরোহণ করে সেই আবাগকে টাইম মেশিনের মতো আবদ্ধ রেখে হয়তো অনেক কবি অনেক কিছু রেখে গেছেন; কিন্তু কাজী নজরুল ইসলাম তার সৃষ্টিশীল সাহিত্যকর্মে জন্ম দিয়েছেন নানাবিধ নানা আঙিকের গানের।

কাজী নজরুল ইসলাম সময়কে জয় করে গেছেন, সময়ের সঙ্গে হারিয়ে যাবেন না, বরং তারা সব সময়ই বর্তমান। এ এক অবিশ্বাস্য রকমের অলৌকিক ব্যাপার! পৃথিবীতে খুব কম মানুষ এই দুর্লভ গুণটি অর্জন করেছেন। তার জন্য তারা হলেন- মহামানব।

এবারে যেই গানটি নিয়ে এত কথা- বাঙালি মুসলিম সমাজে আজ অব্দি জাতীয় কবির অমর সৃষ্টি ‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ’- গানটি জানেন না এরকম মানুষ বাংলাদেশে ও পশ্চিমবঙ্গে খুঁজে পাওয়া যাবে না। গানটির সৃষ্টির পেছনে একটা রোমাঞ্চকর ঘটনা জড়িয়ে আছে, যেটা আগে বলছিলাম, রয়েছে একটা পটভূমি এবং সাথে একটি দর্শন ও নৈতিক বাণীসমেত উপস্থিত।

তো যাই হোক, সালটা ছিল ১৯৩১। কবি তখন কলকাতায় গ্রামোফোন কোম্পানিতে রেকর্ড নিয়ে বিভোর। সৃষ্টি করে চলেছেন একের পর এক অনবদ্য গান, রাগ। রেকর্ডও বেরুচ্ছে ধুমসে! তো সেই সময় কবির পরিচয় হয় আব্বাসউদ্দিন সাহেবের সঙ্গে। সে আরেক ইতিহাস! আব্বাসউদ্দিন সাহেব তখন লেখাপড়া করেন কুচবিহার কলেজে। খুব সম্ভবত বিএ পড়ছেন, কলেজের এক বার্ষিক মিলাদ মাহফিলে আমন্ত্রিত হয়েছিলেন কবি কাজী নজরুল ইসলাম। আব্বাসউদ্দিন সাহেব তখন বিশেষভাবে সুপরিচিত কেননা তিনি আর্য সাহিত্য সমাজ থেকে ইতোমধ্যে ‘কাব্যরত্নাকর’ উপাধি পেয়ে গেছেন। তো স্বাভাবিকভাবেই কবি, আব্বাসউদ্দিনের গান শুনতে চাইলেন। কবি তো কখনও কাউকে ‘না’- বলতে পারতেন না, সুতরাং আব্বাসউদ্দিন সাহেবকে উনি বললেন, ‘তুমি কলকাতা চলো, গান রেকর্ড করাব তোমার’। যেমন কথা, তেমন কাজ।

কলকাতায় শিল্পী আব্বাসউদ্দিন এসে এক এক করে অনেকগুলো গান রেকর্ড করে ফেললেন। অবশ্য সেইসময় কলকাতায় কাওয়ালি গানের ব্যাপক জনপ্রিয়তা ছিল। আব্বাসউদ্দিন সাহেব সেই সময়, খুব সম্ভবত কাওয়ালির রেশ ধরেই ইসলামি গানের কথা চিন্তা করলেন।

কবিকে বললেন, ‘কাজীদা, একটা কথা মনে হয়। এই যে পিয়ারু কাওয়াল, কাল্লু কাওয়াল- এরা উর্দু কাওয়ালি গাইছে, এদের গানও শুনি অসম্ভব কাটতি, এই ধরনের বাংলায় ইসলামি গান করলে হয় না? আপনি যদি ইসলামি গান লেখেন, তাহলে মুসলমানের ঘরে ঘরে আবার উঠবে আপনার জয়গান’ ।

শিল্পী আব্বাসউদ্দিনের এই কথাটা খুব মনে ধরল বিদ্রোহী কবির। কিন্তু, বিধি বাম! তখনকার রক্ষণশীল মুসলিম-সমাজ গান-বাজনায় খুব একটা আন্তরিক ছিল না, বরঞ্চ ঘোরবিরোধী ছিল। বাণিজ্যিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে গ্রামোফোন কোম্পানির (এইচএমভি) রিহার্সাল ইনচার্জ ভগবতী ভট্টাচার্যের কাছে কবি তাই বিশেষ আগ্রহ দেখালেন না। উনি উপরন্তু আব্বাসউদ্দিনকে বললেন, ‘আব্বাস তুমি ভগবতী বাবুকে বলে তার মত নাও, আমি ঠিক বলতে পারব না।’

আব্বাসউদ্দিন গেলেন ভগবতী বাবুর কাছে, জানাতেই তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলেন মহাশয়, ‘না না না, ও সব গান চলবে না। ও হতে পারে না।’ মনে একপ্রকার হতাশার উদ্রেক হলো আব্বাসউদ্দিন সাহেবের। কিন্তু উনিও নাছোড়বান্দা, ঠিকই মাস ছয়েক পরে রাজি করিয়ে নিলেন ভগবতী বাবুকে। আব্বাসউদ্দিন সাহেবকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘নেহাতই নাছোড়বান্দা আপনি, আচ্ছা আচ্ছা, করা যাবে।’ আব্বাসউদ্দিন পরমানন্দে কবিকে খুঁজতে লাগলেন, দেখলেন যে কবি পাশের কামরায় রিহার্সাল করাচ্ছেন, গিয়ে জানালেন, ভগবতীকে রাজি করানোর কথা। কবি তখন ইন্দুবালা দেবীকে গান উঠিয়ে দিচ্ছিলেন। আব্বাসউদ্দিন সাহেবের কথা শুনেই সঙ্গে সঙ্গে ইন্দুবালা দেবীকে বাড়ি পাঠানোর ব্যবস্থা করলেন এবং বললেন, ‘ইন্দু তুমি বাড়ি যাও, আব্বাসের সঙ্গে কাজ আছে।’

বলা বাহুল্য, কাজী নজরুল ইসলাম চা ও পান থেকে খুব পছন্দ করতেন। কবির সৃষ্টির যেন কোনো প্রকার প্রতিবন্ধকতা না হয়, সেইকারণে আব্বাসউদ্দিন সাহেব দশরথ নামের একজনকে দিয়ে এক ঠোঙা পান আর চা আনালেন। তারপর আর কে পায় তাকে! খিড়কি বন্ধ করে দিয়ে চলল ইতিহাস রচনা। গান রচনা করতে কবি সময় নিলেন মাত্র আধ ঘণ্টা! ভাবা যায়! কী এক যুগান্তকারী গান তিনি উপহার দিলেন বাংলার মুসলিম সমাজকে; যেই গানটি বিনা ঈদুল-ফিতর বাঙালি মুসলিম সমাজে অসম্পূর্ণ!

‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ,

তুই আপনাকে আজ বিলিয়ে দে, শোন আসমানি তাগিদ’।।

তোর সোনা-দানা বালাখানা সব রাহেলিল্লাহ্‌।

দে জাকাত মুর্দা মুসলিমের আজ ভাঙাইতে নিদ্‌’।।

কবি গান রচনা করেই ক্ষান্ত হলেন না, উনি সব সময়ই সঙ্গে সঙ্গে সুর আরোপ করতেন, সুতরাং এ গানেও ব্যতিক্রম কিছুই হলো না। পরের দিন আব্বাসউদ্দিন সাহেবকে আসতে বললেন, গান তুলে নেওয়ার জন্য। এখানে একটা কথা বলা রাখা প্রয়োজন মনে করছি; তখন একটি রেকর্ডে মাত্র দুটি গান ধরত, তাই আরেকটি গান কবি রচনা ও সুর করেছিলেন ঐ একই দিনে এবং সেটা হলো-

‘ইসলামের ঐ সওদা লয়ে এলো নবীন সওদাগর।

বদনসীব আয়, আয় গুনাহগার নতুন করে সওদা কর।।

জীবন ভরে করলি লোকসান আজ হিসাব তার খতিয়ে নে;

বিনিমূলে দেয় বিলিয়ে সে যে বেহেশতি নজর’।।

ব্যস চলল গানের কাজ। অবশ্য, গানগুলো লেখার চার দিন পর শিল্পী আব্বাস উদ্দিনের গলায় রেকর্ড করা হয়। তখনকার সময় আজকের মতো এত অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি কল্পনাতীত; তাই অনেক রকম চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেই রেকর্ডিঙের বন্দোবস্ত করতে হতো। যাই হোক, ভগবতী বাবু তো গোঁড়া থেকেই নেতিবাচক ছিলেন, স্বয়ং উনিই মাত্র চারদিনের মাথায় রেকর্ড বের হয়ে যাবে শুনে একেবারেই হতচকিত!! কবিও অবশ্য গান দুটি নিয়ে ছিলেন বেশ উল্লসিত।

ঈদের বন্ধ কাটিয়ে আব্বাসউদ্দিন সাহেব কলকাতায় এসেছেন। ততদিনে তো রেকর্ড বাজারে বেরিয়ে গিয়েছে। উনি একদিন ট্রামে করে যাচ্ছেন, হঠাৎ এক যাত্রীর কণ্ঠে একটি গান শোনা গেল, ‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে।’

আব্বাসউদ্দিন সেইদিন খুব অবাক হয়েছিলেন! ছুটলেন প্রকাশক বিভূতি বাবুর অফিসে। আব্বাসউদ্দিন সাহেবকে দেখে আনন্দে জড়িয়ে ধরলেন। আব্বাসউদ্দিন সাহেবকে আপ্যায়ন করালেন চা, সন্দেশ, রসগোল্লা! আহা কী অমিয়!! কথাটা লিখতে সৈয়দ মুজতবা আলীর কালজয়ী ‘রসনা-বিলাস’ গল্পটি মনে পড়ে গেল।

শিল্পী আব্বাসউদ্দিনের খুশি তো আর ধরে না, দৌড়ালেন সোজা কবির বাসায়। উনি গিয়ে কবিকে পেলেন না, জানতে পারলেন উনি আছেন যথারীতি রিহার্সাল রুমে। গিয়ে দেখেন কাজীদা একা বসে দাবা খেলায় একেবারে মত্ত হয়ে আছেন, কবি দাবা খেলতে বসলে দিন-দুনিয়া সব কিছু বেমালুম ভুলে যেতেন! আব্বাসউদ্দিন সাহেবের ডাক শুনেই লাফিয়ে উঠলেন, অতঃপর তাকে জড়িয়ে ধরলেন।

বিদ্রোহী কবি, সাম্যের কবি- কাজী নজরুল ইসলাম লিখে গিয়েছেন-

‘আজ সৃষ্টি সুখের উল্লাসে–

মোর মুখ হাসে মোর চোখ হাসে মোর টগবগিয়ে খুন হাসে

আজ সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে।’

কাজী নজরুল ইসলাম নিঃশর্ত ভালোবেসে উজাড় করে দিয়ে গেছেন। যে গানটি শুধু একটি গানই নয়; বরং বাঙালি মুসলিম সমাজে গানটি এককথায় আচারিক তুল্য। যেমনই এ গানের কলি, তেমনি মাদকতা গানটির সুরে, দর্শন গানটির আবেগে!

লেখটার একপর্যায়ে কবিকে হৃদয় নিংড়ানো ভালোবাসা ও প্রগাঢ় শ্রদ্ধা জানিয়ে আরেকটি গান শুনছিলাম-

‘হে প্রিয় আমারে দিব না ভুলিতে

মোর স্মৃতি তাই রেখে যাই শত গীতে’।।

রেজওয়ান উর রহমান : আটলান্টা, জর্জিয়া অঙ্গরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র

[ নিবন্ধ, সাক্ষাৎকার, প্রতিক্রিয়া প্রভৃতিতে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। দৈনিক কালবেলার সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে নিবন্ধ ও সাক্ষাৎকারে প্রকাশিত মত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির ব্যাখ্যা বা বিশ্লেষণ, তথ্য-উপাত্ত, রাজনৈতিক, আইনগতসহ যাবতীয় বিষয়ের দায়ভার লেখকের, দৈনিক কালবেলা কর্তৃপক্ষের নয়। ]
কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

তীব্র তাপদাহে বিদ্যুৎ বিভাগের নির্দেশনা

ভয়াল ২৯ এপ্রিলের স্মরণে ঢাকাস্থ কক্সবাজার সমিতি

মালবাহী ট্রেনের ধাক্কায় ইঞ্জিনিয়ারের মৃত্যু

মঙ্গলবার কেমন থাকবে আবহাওয়া?

সন্তান প্রসব করাতে গিয়ে নারীর জরায়ু কাটার অভিযোগ

রাজবাড়ীতে বিদ্যুৎস্পর্শে একজনের মৃত্যু

বঙ্গবন্ধু মে দিবসকে জাতীয় দিবস হিসেবে ঘোষণা করেন

পাবিপ্রবিতে বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি পালন

বাজারে গিগাবাইটের এআই পরিচালিত ইন্টেল ১৪ জেনারেশন ল্যাপটপ

চিকিৎসা শেষে পথেই প্রাণ গেল ৪ জনের

১০

ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ট্রাকচাপায় কলেজছাত্র নিহত

১১

উপজেলা নির্বাচনে আ.লীগ নেতাকে কারণ দর্শানোর নোটিশ

১২

এআইইউবিতে সিএস ফেস্ট

১৩

৩ সাংবাদিকসহ ৬ জনের বিরুদ্ধে সাইবার মামলা

১৪

উচ্চ শিক্ষায় ফিলিস্তিনের নারী শিক্ষার্থীদের বৃত্তি দিচ্ছে আইইউবিএটি

১৫

দেশ এখন ভয়াবহ সংকটে রয়েছে : গণঅধিকার পরিষদ

১৬

মুক্তি পেতে যাচ্ছেন মামুনুল হক 

১৭

স্বাধীন তদন্ত কমিশনের মাধ্যমে জিয়াউর রহমানের মুখোশ উন্মোচনের দাবি পরশের

১৮

গোপালগঞ্জে বঙ্গবন্ধু ধানের ফসল কর্তন উৎসব

১৯

কক্সবাজারে ডাকাতদলের সঙ্গে র‍্যাবের গোলাগুলিতে নিহত ১

২০
*/ ?>
X