অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ
প্রকাশ : ২৬ জুন ২০২৪, ০৩:৩৯ এএম
আপডেট : ২৮ জুন ২০২৪, ০৩:৫৮ পিএম
অনলাইন সংস্করণ

অতি ব্যয় ও অতি ঋণের বাজেট

অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ
গ্রাফিক্স : কালবেলা
গ্রাফিক্স : কালবেলা

অর্থনীতি যেভাবে পরিচালিত হচ্ছে তার কারণেই বাংলাদেশে অতি ধনী বৃদ্ধির হার অনেক বেশি। এর পেছনে সরকারের বিভিন্ন সিদ্ধান্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। গ্যাস বিদ্যুৎ সবকিছুর দাম বাড়ছে, ঋণ বাড়ছে, বিদেশি মুদ্রার ওপর চাপ বাড়ছে। এরকম পদক্ষেপগুলোতে লাভ হচ্ছে কতিপয় গোষ্ঠীর, বোঝা বাড়ছে সর্বজনের। এবারের বাজেটও এ ধারাকেই বৈধতা দিচ্ছে

আগামী অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত বাজেটে গত কয়েক বছরে সরকারের দুর্নীতিযুক্ত অতি ব্যয় এবং অতি ঋণের খেসারত দেখা যাচ্ছে। অনেক বেশি ঋণনির্ভর প্রকল্প গ্রহণ এবং মাত্রাতিরিক্ত ব্যয়ে বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়নের কারণে দেশের ওপরে আর্থিক বোঝা বেড়েছে। উপরন্তু পাচারের কারণে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর চাপ তৈরি হয়েছে। সরকারের আমদানি এবং উন্নয়ন ব্যয়ের ক্ষমতা কমেছে। নিজের তৈরি সেই সমস্যা থেকে বের হওয়ার জন্য প্রস্তাবিত বাজেটে সরকার নানা বোঝা তৈরি করেছে জনগণের জন্য। এ বাজেটের তাই সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো অধিক অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক ঋণনির্ভরতা এবং কর সম্প্রসারণ।

বাজেটে বেশ কিছু প্রয়োজনীয় পণ্যের শুল্ক কমানো হয়েছে। সরকার বলছে, এর মাধ্যমে জিনিসপত্রের দাম কমবে। কিন্তু এটা আমাদের ইতিহাসে দেখা যায় না। বাজার অর্থনীতির নিয়ম অনুযায়ী শুল্ক কমানো হলে জিনিসপত্রের দাম কমার কথা। কিন্তু বাংলাদেশে বাজার অর্থনীতির এই প্রাথমিক নিয়ম কাজ করে না। কারণ বাংলাদেশের অর্থনীতি চলে অলিগোপলি বা কতিপয় গোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণে জবাবদিহিহীন একচেটিয়া ব্যবস্থায়। এ গোষ্ঠী যে কোনো সময় যে কোনো পণ্যের দাম বাড়াতে পারে, কৃত্রিম সংকট তৈরি করতে পারে। তারা পণ্যের দাম এবং জোগান নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। সরকার তাদের ব্যাপারে নিষ্ক্রিয় ভূমিকা পালন করে। সুতরাং সরকারের শুল্ক কমানোয় দ্রব্যের দাম কমবে এটা আশা করা কঠিন। আবার যেসব পণ্য বা দ্রব্যের শুল্ক বাড়ানো হয়েছে এগুলোর দাম আরও বাড়বে। অর্থবছর এখনো শেষ হয়নি, অথচ বাজেট ঘোষণার পরপরই জিনিসপত্রের দাম বাড়তে শুরু করেছে। এটাই হলো সরকারের গৃহীত ব্যবস্থার সঙ্গে বাস্তবতার সম্পর্ক।

অর্থমন্ত্রী বাজেটে মুদ্রাস্ফীতি কমানোর কথা বলছেন। বিনিয়োগ কমানো, টাকার সরবরাহ কমানো, সুদের হার বাড়ানো, সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি—এগুলো মুদ্রাস্ফীতি কমানোর পাঠ্যপুস্তকের সমাধান। এ পাঠ্যপুস্তকের নিয়ম শুধু তখনই কাজ করে যখন বাজার অর্থনীতি পুস্তক নির্দেশিত নিয়মে চলে। আর বাজার যদি কিছু গোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণাধীন হয় তাহলে এসব নিয়ম আর কাজ করে না। জবাবদিহিহীন রাজনৈতিক ব্যবস্থায় প্রধান অংশীদার ক্ষুদ্র গোষ্ঠী যখন প্রধান নিয়ন্ত্রকের ভূমিকায় থাকে, তখন জিনিসপত্রের দাম বৃদ্ধি, মানুষের ভোগান্তি এবং মানুষের প্রকৃত আয় কমে যাওয়া—এসবের ধারাবাহিকতা আগামী অর্থবছরেও যে অব্যাহত থাকবে তা বোঝাই যাচ্ছে।

অর্থনীতির সংকটের জন্য যে কারণগুলো দায়ী তার কোনোটিই বাজেটের কোথাও উল্লেখ করা হয়নি। সেই কারণগুলোর কোনো স্বীকৃতি নেই এবং সেগুলো দূর করার জন্য কোনো পদক্ষেপ নেওয়ার কথা নেই। এর অন্যতম উদাহরণ, বড় বড় ঋণখেলাপি। ব্যাংক খাতের ওপর কিছু গোষ্ঠীর ভয়ংকর দাপট এবং তাদের হাত দিয়ে ব্যাংক খাত নষ্ট করে ফেলার বিষয়েও কিছু বলা হয়নি বাজেটে। ব্যাংক লুট দুভাবে হচ্ছে—একদিকে ঋণখেলাপি অন্যদিকে ব্যাংকের ওপর দখল-কর্তৃত্ব নিয়ে জালিয়াতি প্রতারণার মাধ্যমে সরাসরি ব্যাংক লুট। এগুলো প্রতিরোধ বা নিয়ন্ত্রণ করার কথা বাংলাদেশ ব্যাংকের। কিন্তু যারা নানাভাবে ব্যাংক লুট করছে তাদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ ব্যাংক বা সরকারের কোনো প্রতিষ্ঠানকে কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখা যায় না। উপরন্তু ঋণখেলাপি কমানোর জন্য যেসব ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বাংলাদেশ ব্যাংক তার উল্টো দিকে যাচ্ছে। ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার পরিবর্তে তাদের উল্টো সুবিধা বাড়ানো হয়েছে এবং তাদের আরও বেশি ঋণ নেওয়ার সুযোগ তৈরি করে দেওয়া হচ্ছে। যেমন সামান্য অর্থ পরিশোধ করে রি-শিডিউল করার সুযোগ করে দেওয়া হচ্ছে, সময়সীমা বাড়ানো হচ্ছে। ফলে ঋণখেলাপি এবং ব্যাংক লুটেরা—এ দুই গোষ্ঠীর সম্মিলিত তৎপরতা দেশের আর্থিক খাতে ভয়ংকর সংকট তৈরি করছে। এরাই দেশ থেকে ডলার পাচারের প্রধান নায়ক। অর্থমন্ত্রী তার বক্তব্যে এ লুটেরা গোষ্ঠীর তৎপরতার কথা এড়িয়ে গেছেন। অথচ অর্থনীতির প্রকৃত সংকট এদের দ্বারাই তৈরি হচ্ছে।

এখন জানা-অজানা বিভিন্ন কারণে সরকার ঘনিষ্ঠ এবং সরকারের অংশ অনেকেরই বড় বড় দুর্নীতির খবর, লুটপাট এবং সম্পদের পাহাড় বানানোর খবর প্রকাশিত হয়ে যাচ্ছে। পুলিশের সাবেক প্রধান বেনজীরের মতো আরও অনেকের বিষয় সামনে আসছে। বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয় যে, এ প্রক্রিয়ায় আরও বহু ক্ষমতাবান মানুষ যুক্ত রয়েছে। তাদের দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে অসংখ্য মানুষ। এ লুটপাটকারীদের তৎপরতায় দেশে নতুন দারিদ্র্য সৃষ্টি হচ্ছে, জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে এবং মানুষের জীবন-জীবিকা বিপর্যস্ত হয়েছে। দারিদ্র্যের ওপর ভয়াবহ চাপ তৈরি হয়েছে। সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের জীবন-জীবিকার ওপর এরকম অবিরাম আক্রমণ অব্যাহত রেখে সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির কথা প্রহসনের মতো শোনায়।

শিক্ষা ও চিকিৎসা—সবচেয়ে জরুরি এ দুটি খাত বরাবরের মতো সব থেকে বেশি অবহেলিত। শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য খাতে এমনিতেই বরাদ্দ কম, তার ওপর যে বরাদ্দ রয়েছে তার পরিপূর্ণ এবং সঠিক বাস্তবায়ন হয় না। শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতের বরাদ্দে দেখা যায়, অপ্রয়োজনীয় ভবন নির্মাণ, অপ্রয়োজনীয় গাড়ি আমদানি, অপ্রয়োজনীয় বিদেশ সফরসহ নানাভাবে অপচয়। অথচ যেখানে অর্থ ব্যয় করার প্রয়োজন সেখানে অর্থের সংকট।

চিকিৎসা খাতে অনেক ডাক্তারের পদ খালি, অনেক নার্সের পদ খালি। চিকিৎসা খাতে মানুষের ব্যয় হু হু করে বেড়ে যাচ্ছে। পাবলিক বা সর্বজন চিকিৎসা সম্প্রসারণের কোনো উদ্যোগ নেই, উল্টো এ বাজেটে দেখা গেল চিকিৎসা সরঞ্জাম আমদানির ওপর শুল্ক বাড়ানো হয়েছে। চিকিৎসা খাতে এ বছর যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে, তার সমপরিমাণ অর্থ বাংলাদেশের মানুষ চিকিৎসার জন্য ভারতে খরচ করেন!

বড় বড় প্রকল্প যে পরিমাণ ঋণ নিয়ে করা হচ্ছে, সেগুলো আর্থিক এবং পরিবেশগত দুদিক থেকেই বাংলাদেশের ওপর বোঝা হয়ে চেপে বসছে। উদাহরণস্বরূপ, ভারতের এনটিপিসির সঙ্গে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র আমাদের জন্য অমূল্য সুন্দরবনের মারাত্মক ক্ষতি করবে। এ প্রকল্পের পিছে পিছে এই এলাকায় শতাধিক বিপজ্জনক প্রকল্প বসেছে যেগুলো পুরো অঞ্চলে ভয়াবহ ক্ষতির কারণ হবে। চীন ও জাপানের ঋণে ও কর্তৃত্বে উপকূলীয় এলাকায় আরও কয়েকটি কয়লাচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরি করা হয়েছে। এসব প্রকল্প জলবায়ু পরিবর্তনে বাংলাদেশের যে ঝুঁকি তা আরও কয়েকগুণ বৃদ্ধি করবে। একই সঙ্গে ভয়াবহ ঝুঁকি আর বিশাল ঋণের বোঝা নিয়ে রাশিয়ার সঙ্গে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরি করা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য কোম্পানির সঙ্গে এলএনজি আমদানির বড় প্রকল্পও রয়েছে। এ প্রকল্পগুলোর কারণে বিশাল বৈদেশিক ঋণ জমছে, যা পরিশোধের জন্য বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ চাপ সৃষ্টি করছে।

অর্থনীতি যেভাবে পরিচালিত হচ্ছে তার কারণেই বাংলাদেশে অতি ধনী বৃদ্ধির হার অনেক বেশি। এর পেছনে সরকারের বিভিন্ন সিদ্ধান্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। যেমন, বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠানগুলো যে পরিমাণ গ্যাস তোলার জন্য খরচ করে প্রায় ১ হাজার ৭০০ কোটি টাকা, সেই একই পরিমাণ গ্যাস সরকার কতিপয় দেশি-বিদেশি কোম্পানিকে ব্যবসা দিতে এলএনজির মাধ্যমে আমদানি করে ৩২ হাজার কোটি টাকা দিয়ে। খেয়াল করতে হবে প্রথমটা হলো দেশীয় মুদ্রায় আর দ্বিতীয়টা হচ্ছে বিদেশি মুদ্রায়। এতগুণ বেশি টাকায় বিদেশি মুদ্রা দিয়ে গ্যাস আনা হচ্ছে, অথচ নিজেদের গ্যাস উত্তোলনের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। ফলে গ্যাস বিদ্যুৎ সবকিছুর দাম বাড়ছে, ঋণ বাড়ছে, বিদেশি মুদ্রার ওপর চাপ বাড়ছে। এ ধরনের পদক্ষেপগুলোতে লাভ হচ্ছে কতিপয় গোষ্ঠীর, বোঝা বাড়ছে সর্বজনের। এবারের বাজেটও এ ধারাকেই বৈধতা দিচ্ছে।

অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ: অর্থনীতিবিদ ও ত্রৈমাসিক জার্নাল সর্বজনকথা’র সম্পাদক

[ নিবন্ধ, সাক্ষাৎকার, প্রতিক্রিয়া প্রভৃতিতে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। দৈনিক কালবেলার সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে নিবন্ধ ও সাক্ষাৎকারে প্রকাশিত মত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির ব্যাখ্যা বা বিশ্লেষণ, তথ্য-উপাত্ত, রাজনৈতিক, আইনগতসহ যাবতীয় বিষয়ের দায়ভার লেখকের, দৈনিক কালবেলা কর্তৃপক্ষের নয়। ]
কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আজ ১১ ঘণ্টা গ্যাস থাকবে না যেসব এলাকায়

বাসায় তৈরি ক্রিমেই দূর হবে মুখের দাগছোপ

বান্দরবানে সেনা অভিযানে কেএনএ কমান্ডারসহ ২ সদস্য নিহত

বিলুপ্তির দ্বারপ্রান্তে ঐতিহ্যবাহী তাঁতশিল্প

৬৫ যাত্রী নিয়ে ডুবে গেল কাঠের নৌকা

চুক্তিতে না এলে জাপানকে ৩৫ শতাংশ শুল্কের হুমকি ট্রাম্পের

মোটরসাইকেল রেজিস্ট্রেশন নিয়ে কঠোর নির্দেশনা বিআরটিএর

মঙ্গলে প্রাণ নেই কেন? নতুন তথ্য দিল নাসা

২ লাখ টাকার চুক্তিতে খুন হয় প্রবাসী স্ত্রী

এআইয়ের কারণে মাইক্রোসফট থেকে বাদ পড়ছে ৯ হাজার কর্মী 

১০

০৩ জুলাই : কী ঘটেছিল ইতিহাসের এই দিনে

১১

দুপুরের মধ্যে ঢাকাসহ ৯ জেলায় হতে পারে ঝড়বৃষ্টি 

১২

সাড়ে ৩ কোটি টাকার হিসাব নেই কুবিতে

১৩

বৃহস্পতিবার ঢাকার যেসব এলাকায় মার্কেট বন্ধ

১৪

০৩ জুলাই : আজকের নামাজের সময়সূচি

১৫

জুলাই বিপ্লব নিয়ে কটূক্তি, ছাত্রলীগ কর্মী গ্রেপ্তার 

১৬

‘আমার লক্ষ্য কেবল নির্বাচন নয়, জনগণের অধিকার নিশ্চিত করা’

১৭

চাঁদপুরে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে হত্যা মামলার আসামি গ্রেপ্তার

১৮

ঘুষ লেনদেনের ভিডিও ভাইরাল, এসআই প্রত্যাহার

১৯

বন্ধুর ছুরিকাঘাতে বন্ধু খুন

২০
X