বিশ্বের যেসব নৌপথ ঘেঁষে জলদস্যুদের বিচরণ রয়েছে তার অন্যতম সোমালিয়ার উপকূলীয় অঞ্চল। সময়ের সাথে সাথে তাদের তৎপরতা ছিল চোখে পড়ার মতো। সম্প্রতি বাংলাদেশি একটি জাহাজ ছিনতাইয়ের কবলে পড়ায় গোষ্ঠীটি আবারও আলোচনায় এসেছে।
সোমালিয়ার উপকূলীয় অঞ্চলে ১৯৯৫ সাল থেকে মূলত জলদস্যুদের বিচরণ শুরু হয়। তবে সময়ের সাথে সাথে বেড়েছে তাদের তৎপরতা। বিভিন্ন সময়ে এ গোষ্ঠীটি মুক্তিপণ নিয়ে জাহাজ ও নাবিকদের মুক্তি দিলেও হত্যার মতো নৃশংস আচরণেও পিছপা হয়নি। হর্ন অব আফ্রিকা হয়ে চলাচলকারী সব পণ্যবাহী জাহাজগুলোর কাছে সোমালিয়ার জলদস্যুরা অন্যতম আতঙ্কের নাম। লুটপাট, নাবিকদের অপহরণ, মুক্তিপণ আদায় কিংবা অতর্কিত হামলা, গোলাবর্ষণসহ দুর্ধর্ষ সব কর্মকাণ্ড ঘটিয়ে থাকে এ দস্যুরা।
১৯৯০ সালের দিকে সোমালিয়া উপকূলে কাঠামোগত কোস্টগার্ড না থাকায় স্থানীয় জেলেরা ধারাবাহিকভাবে নৌপথটি পাহারা দিয়ে থাকেন। ১৯৯৫ সালে দায়িত্ব পালনকালে স্থানীয় জেলেরা একটি জাহাজ ভেসে আসতে দেখে। এরপর তারা জাহাজটিকে দ্রুত ঘিরে ফেলে এবং জাহাজের নাবিকদের কাছ থেকে মূল্যবান সামগ্রী কেড়ে নেয়। সেই থেকে এ উপকূলে আধুনিক জলদস্যুতার শুরু হয়।
২০০৫ সাল
সোমালিয়ার জলদস্যুরা ২০০৫ সালে এমভি ফাইস্টি নামের একটি পেট্রোলিয়াম গ্যাস ট্যাঙ্কার ছিনতাই করে। হংকংভিত্তিক কোম্পানির এ জাহাজটি থেকে তিন লাখ ১৫ হাজার ডলার মুক্তিপণ আদায় করে তারা। জাহাজটি সুনামি দুর্গতদের জন্য জাতিসংঘের ত্রাণ নিয়ে মোম্বাসা, কেনিয়ার থেকে বোসাসো যাচ্ছিল।
একই বছরে সি বর্ন স্পিরিট নামের একটি বিলাসবহুল জাহাজ উপকূলে এ দস্যুদের কবলে পড়ে। ২১০ জন যাত্রী থাকা ওই জাহাজে দস্যুরা দুটি স্পিডবোট নিয়ে অব্যাহতভাবে আক্রমণ ও গুলিবর্ষণ করে। তবে যাত্রীদের কৌশলের কারণে এ হামলা বিফলে যায়।
২০০৬ সাল
২০০৬ সালে ভারতের জাহাজ এমভি সাফিনা আল-বিরসারাত ছিনতাই করে সোমালিয়ার জলদস্যুরা। এ সময় তারা জাহাজটির ১৬ নাবিককেও জিম্মি করে। পরে অবশ্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতায় দস্যুরা আত্মসমর্পণ করে। এরপর তাকের কেনিয়ার একটি অঞ্চলে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এছাড়া একই বছর সোমলিয়ার জলদস্যুরা আরও কিছু জাহাজ ছিনতাইয়ের চেষ্টা করে। এ সময় একজন নিহত ও ১২ জলদস্যু গ্রেপ্তার হন।
২০০৭ সাল
২০০৭ সালে সোমালিয়ার জলদস্যুরা আরও একটি জাহাজ দখলে নেয়। ওই সময়ে জাহাজটিতে ছয় কেনীয় ও শ্রীলঙ্কানসহ মোট ১২ ক্রু ছিলেন। পরে ওই বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে সোমালিয়ার কোস্টগার্ড জাহাজটি পুনরুদ্ধারের চেষ্টা চালিয়ে ব্যর্থ হয়। এতে করে কোস্টগার্ডের দুই সদস্য নিহত হন।
এ বছরের মে মাসে সোমালিয়ার জলদস্যুরা ১০ জন চীনা, ২ তাইওয়ানি ও ২ ফিলিপাইন্সের নাগরিকসহ একটি মাছ ধরার জাহাজ আটক করে। তাদের মধ্যে এক চীনা নাগরিককে হত্যা করা হয়। কেননা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে জাহাজের মালিকপক্ষ দেখা করতে পারেনি।
২০০৮ সাল
সোমালিয়ার উপকূলবর্তী ভারত মহাসাগরে ২০০৮ সালে একের পর এক বাণিজ্যিক জাহাজে হামলা চালায় জলদস্যুরা। এ সময়ে তাদের হাতে জাহাজের এক ক্যাপ্টেন ৪৭ দিন আটক ছিলেন। পরে ছয় লাখ ৭৮ হাজার ডলারের বিনিময়ে তিনি ও তার জাহাজকে মুক্তি দেয় দস্যুরা।
২০১০ সাল
২০১০ সালে এডেন উপসাগরে সোমলিয়ার জলদস্যুদের কবলে পড়ে জার্মান তেলের ট্যাংকার মারিডা মারগারিটা। ওই সময়ে জাহাজটিতে ২২ জন ক্রু সদস্য ছিলেন। তাদের মধ্যে দুই বাংলাদেশিও ছিলেন। প্রায় সাড়ে সাত মাস জিম্মি থাকার পর ওই বছরের ২৮ ডিসেম্বর সাড়ে ৩৮ কোটি টাকার বিনিময়ে তারা মুক্তি পান।
২০১৩ সালে জাতিসংঘ, ন্যাটো ও ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ আন্তর্জাতিক জোটগুলোর কঠোর পদক্ষেপের পর সোমালিয়ার দস্যুদের প্রবণতা অনেকটা কমে আসে। ২০১৭ সালের মার্চ মাসে জ্বালানিবাহী ট্যাংকার এরিস আক্রমণের মাধ্যমে পাঁচ বছর পর আবারও বড়সড়ো কোনো হামলা করে তারা।
চলতি বছরের জানুয়ারিতে সোমালিয়ার এ দস্যুদল ইরানের পতাকাবাহী একটি জাহাজ অপহরণ করে। ওই সময়ে জাহাজটিতে ইরানের ১৭ নাগরিক ছিলেন। একই মাসে ইরানের পতাকাবাহী আরেকটি মাছ ধরার জাহাজ এফভি আল নাঈমিতে ১১ জন সশস্ত্র জলদস্যু আক্রমণ করে। এ সময় তারা ১৯ জন ক্রু সদস্যকে জিম্মি করে। পরবর্তীতে ভারতীয় যুদ্ধজাহাজ আইএনএস সুমিত্র তাদের উদ্ধার করে।
মন্তব্য করুন