নেপালে চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতা দেশকে এক গভীর সংকটের মধ্যে ফেলেছে। কয়েক সপ্তাহ আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সরকারের হঠাৎ নিষেধাজ্ঞা আর দুর্নীতি ও কর্তৃত্ববাদী শাসনের বিরুদ্ধে তরুণদের ক্ষোভ থেকেই শুরু হয় বিক্ষোভ। প্রথমদিকে শান্তিপূর্ণভাবে মিছিল ও মানববন্ধন থেকে শুরু হওয়া এই আন্দোলন ক্রমে সহিংস রূপ ধারণ করে।
সাধারণ জনগণ ও বিশেষ করে জেনারেশন-জেড অর্থাৎ ১৯৯০-এর দশকের শেষ থেকে একবিংশ শতাব্দীর শুরুতে জন্ম নেওয়া প্রজন্ম সরকারের বিরুদ্ধে সজাগ হয়ে ওঠে। চলমান বিক্ষোভ আন্দোলনে মূলত তারাই নেতৃত্ব দিচ্ছে।
প্রথমদিকে বিক্ষোভকারীরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সরকারের হস্তক্ষেপের প্রতিবাদ জানায়। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আন্দোলন প্রসারিত হয়ে দুর্নীতি, স্বচ্ছতা, বিচারহীনতা এবং সরকারি কর্তৃত্ববাদের মতো ইস্যুতে কেন্দ্রীয় হয়ে ওঠে। প্রথম দিন থেকে সরকারি ভবনগুলোতে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ শুরু হয়। বিমান চলাচল বন্ধ করা হয়, এবং শহরগুলোতে কারফিউ জারি করা হয়। সংঘর্ষে প্রথমদিনে অন্তত ১৯ জন নিহত হয় এবং চার শতাধিক মানুষ আহত হয়।
বিক্ষোভের চাপ ক্রমেই প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা ওলির ওপর পড়ে। মঙ্গলবার (৯ সেপ্টেম্বর) অবশেষে পদত্যাগের ঘোষণা দেন তিনি। পদত্যাগের পর নেপাল সেনাবাহিনী হেলিকপ্টারে করে তাকে কাঠমান্ডু থেকে বের করে নিয়ে যায়। সেখানে তার নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয় এবং প্রাথমিকভাবে জল্পনা করা হচ্ছে, তিনি চিকিৎসার অজুহাতে দুবাই যেতে পারেন। তবে সরকারিভাবে তার গন্তব্য নিশ্চিত করা হয়নি।
প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগের পর পরিস্থিতি কিছুটা স্থিতিশীল হওয়ার বদলে আরও অস্থিতিশীল হয়। একই দিনে নেপালের রাষ্ট্রপতি রাম চন্দ্র পাউডেলও পদত্যাগের ঘোষণা দেন। সহিংসতা বেড়ে যাওয়ার পেছনে বিক্ষোভকারীদের ক্রমবর্ধমান রোষ এবং সশস্ত্র হস্তক্ষেপের ভয় ছিল। বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত ভিডিওতে দেখা যায়, প্রধানমন্ত্রীর এবং সাবেক মন্ত্রীদের পৈতৃক ও সরকারি বাড়িতে আগুন ধরানো হয়, লুটপাট হয় এবং হামলা চালানো হয়। এই সহিংসতায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী ঝালনাথ খানালের স্ত্রী রাজ্যলক্ষ্মী চিত্রকরও নিহত হয়েছেন।
প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগের পর রাজনৈতিক দলগুলো নতুন সরকার গঠনের প্রক্রিয়া শুরু করেছে। সেনাবাহিনী দেশব্যাপী নিরাপত্তা নিয়ন্ত্রণে নিয়োজিত হয়েছে এবং মন্ত্রীরা নিরাপত্তার জন্য বাড়িতে অবস্থান করছে। তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, দেশের নতুন সরকার গঠনের প্রক্রিয়া জটিল হয়ে উঠেছে, কারণ বিক্ষোভকারীরা দলীয় রাজনীতি থেকে আলাদা হয়ে দাবি করছে পুরো রাজনৈতিক ব্যবস্থা সংস্কারের।
নেপালের এই রাজনৈতিক অস্থিরতা কেবল দেশটির জন্য নয়, আঞ্চলিক নিরাপত্তার জন্যও বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রতিবেশী ভারত ইতোমধ্যেই সীমান্ত এলাকায় নিরাপত্তা বাড়িয়েছে এবং সহিংসতার নিন্দা জানিয়েছে। তবে নয়াদিল্লি বলছে, ভারতের ভেতরে এমন বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা নেই।
এভাবেই নেপালের রাজনৈতিক পরিসর এখন এক অজানা পথে এগোচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, তরুণ প্রজন্মের ক্ষোভ এবং দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলন একত্রিত হয়ে দেশটিকে অস্থিতিশীল করে তুলেছে। প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগ থেকে রাষ্ট্রপতির পদত্যাগ এবং নতুন সরকার গঠনের প্রক্রিয়া—সব মিলিয়ে নেপালে চলমান বিক্ষোভ-সহিংসতার কাহিনী এখন আন্তর্জাতিক মহলেও উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এই ঘটনা প্রমাণ করছে, তরুণ প্রজন্মের সামাজিক সচেতনতা ও রাজনৈতিক সক্রিয়তা দক্ষিণ এশিয়ায় কোনো দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি দ্রুত পরিবর্তন করতে পারে। নেপালের ভবিষ্যৎ শাসনব্যবস্থা এখন অজানা ও অনিশ্চিত।
মন্তব্য করুন