কারাগার বললেই চোখের সামনে ভেসে উঠে চৌদ্দ শিকের ছবি। সাজা পাওয়া অপরাধীরা গাদাগাদি করে সেই চৌদ্দ শিকের ভেতর আটকে আছেন। অপরাধীদের কেউ হয়তো শিকের ভেতর থেকে একটু বাইরে বেরিয়ে আসার জন্য আকুতি-মিনতি করছেন কারাগারের পাহারায় থাকা অস্ত্রধারী কারারক্ষীর কাছে। কিন্তু মন গলছে না কারারক্ষীর। উল্টো হাতে থাকা রাইফেলের বাট দিয়ে সজোরে মারছেন অপরাধীকে।
কিন্তু আজ এমন এক কারাগারের কথা বলা হচ্ছে, যে কারাগারে নেই কোনো লোহার শিক। নেই কোনো অস্ত্রধারী নিরাপত্তারক্ষী। সেখানে যে অপরাধীরা বন্দি থাকেন, তারা বিলাসবহুল জীবন কাটানোর সুযোগ পান সেখানে। তাদের অধিকাংশই এমন আনন্দ নিয়ে সেখানে থাকেন যে, ওই কারাগার থেকে কোনো বন্দি পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেননি কোনো দিন। কোথায় এই অদ্ভুত কারাগার?
হ্যালডেন প্রিজন নামে এই কারাগারটি অবস্থিত নরওয়ের রাজধানী অসলোতে। ২০১০ সালে নির্মিত এই কারাগারটিকে বলা হয় বিশ্বের সবচেয়ে মানবিক কারাগার। যেখানে কয়েদিদের শাস্তির পরিবর্তে পুনর্বাসনের দিকে মনোযোগ দেওয়া হয়। ১৩৮ মিলিয়ন পাউন্ড ব্যয়ে নির্মিত এই কারাগারটির নকশা করা হয়েছে বিশেষভাবে, যেন বন্দিদের মধ্যে কারাবাসের অনুভূতি ও কোনোরকম মনস্তাত্ত্বিক চাপ কাজ না করে।
২০১০ সালের ১ মার্চ উদ্বোধন হয় হ্যালডেন কারাগারের। একসঙ্গে ২৪৮ থেকে ২৫২ জন কয়েদি থাকতে পারেন এই কারাগারে। প্রত্যেক বন্দির জন্য রয়েছে ১১০ বর্গফুটের নিজস্ব ঘর। প্রতিটি সেলের সঙ্গে আছে টয়লেট, শাওয়ার রুম, ফ্রিজ, আলমারি, টেবিল, ফ্ল্যাট স্ক্রিন টিভি। এ ছাড়া সেল থেকেই উপভোগ করা যায় বাইরের প্রাকৃতিক দৃশ্য। সব কয়েদির জন্য আছে সোফা ও সুসজ্জিত রান্নাঘর। যদিও কারাগার থেকেই কয়েদিদের খাবার সরবরাহ করা হয়, তারপরও কোনো কয়েদি চাইলে আলাদাভাবে বাজার করে নিজে রান্না করেও খেতে পারেন।
হ্যালডেন কারাগারের প্রধান জানান, এই কারাগারে কয়েদিদের স্বাভাবিক জীবনের ধারণা দেওয়া হয়। তারা যখন মুক্তি পাবেন, তখন তারা যেন স্বাভাবিক সামাজিক জীবনে ফিরে যেতে পারেন, সে বিষয়ের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয় এখানে। বন্দিদের নানা ধরনের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় কারাগারে। কেউ মেকানিক, কেউ কার্পেন্টার, কেউবা শেফ হিসেবে যোগ্যতা অর্জন করেন। এখানে কারারক্ষী ও বন্দিরা একসঙ্গে খান, একসঙ্গে ভলিবল খেলেন এবং একসঙ্গে অবসর সময় কাটান।
হ্যালডেন কারাগারে কয়েদিরা হস্তশিল্পসহ নানা রকম কাজ শিখতে পারেন। কাঠ ও পাথর খোদাইয়ের কাজ থেকে শুরু করে গান শেখানো ও রান্না শেখানোর প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাও আছে বন্দিদের জন্য। এসব কাজে উৎসাহ দেওয়ার জন্য তাঁদের অর্থও দেওয়া হয়। গ্রাফিক ডিজাইন স্টুডিও ছাড়াও আছে মিক্সিং স্টুডিও। এই স্টুডিওতে বন্দিরা গান রেকর্ড করেন। এসব গান স্থানীয় একটি রেডিও স্টেশন প্রতি মাসে সম্প্রচার করা হয়। একটি ব্যান্ড দল এবং সুসজ্জিত স্পোর্টস টিমও রয়েছে কারারক্ষী ও বন্দিদের সমন্বয়ে।
কয়েদিদের সঙ্গে তাদের পারিবারিক যোগাযোগও নিশ্চিত করে হ্যালডেন কারাগার। প্রতি তিন মাসে একবার সন্তানদের সঙ্গে থাকতে পারেন বন্দিরা। তাদের থাকার জন্য রয়েছে কারাগারের মধ্যেই আরামদায়ক বাসা। নির্দিষ্ট কিছু শর্ত পূরণ করতে পারলেই কয়েদিরা তাদের সঙ্গী ও সন্তানদের সঙ্গে কয়েকদিন কাটাতে পারেন। বন্দিদের সন্তানেরা কারাগারে এসে যেন খেলাধুলা ও পড়াশোনা করতে পারে, সে ব্যবস্থাও আছে এখানে।
হ্যালডেনে দীর্ঘদিন ধরে থাকা একজন বন্দি বলেন, হ্যালডেনে থাকা অন্য কারাগারের চেয়ে স্বস্তির। আমরা আসলে পাঁচ তারকা হোটেলে আছি। বরং হোটেলের চেয়েও কারাগারের রুমগুলো সুন্দর।
মন্তব্য করুন