ইসরায়েল ও ভারত একটি বিনিয়োগ সুরক্ষা চুক্তি (আইপিএ) চূড়ান্ত করতে যাচ্ছে। এটি দুই দেশের ফ্যাসিবাদী নীতি ও অবৈধ কার্যক্রমকে দায়মুক্তি দেওয়ার হাতিয়ার হতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন বিশেষজ্ঞরা।
গত সপ্তাহে ইসরায়েল সরকার জানায়, তারা ভারতের সঙ্গে বিনিয়োগের ঝুঁকি কমাতে একটি আইপিএ চুক্তি চূড়ান্ত করছে। তবে মানবাধিকার কর্মী ও বিশ্লেষকদের মতে, এ চুক্তির মাধ্যমে শুধু বিনিয়োগ নিরাপত্তা নয়; বরং গাজায় ইসরায়েলের যুদ্ধকে কাঠামোগত সহায়তা ও ভারতীয় অভ্যন্তরীণ দমননীতিকে আন্তর্জাতিক বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা চলছে।
বোস্টনভিত্তিক এক ভারতীয়-আমেরিকান সমাজকর্মী মিডলইস্ট আইকে বলেন, এ চুক্তির আড়ালে দুই দেশই তাদের ফ্যাসিবাদী আদর্শিক প্রবণতা ও নিপীড়নমূলক কর্মকাণ্ড থেকে দায়মুক্তি পাবে। এটি অত্যন্ত ভয়ংকর।
ইসরায়েলের অর্থমন্ত্রী বেজালেল স্মোট্রিচ চুক্তিটিকে একটি প্রধান অর্থনৈতিক লক্ষ্য হিসেবে দেখছেন। তিনি ভারতকে ‘সত্যিকারের বন্ধু’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। দিল্লির পক্ষ থেকেও চুক্তিকে ঘিরে পূর্ণ সমর্থন রয়েছে বলে জানা গেছে।
যুক্তরাজ্যভিত্তিক ফিলিস্তিনি লেখক ও গবেষক আবদুল্লাহ মোয়াসওয়েস বলেন, ভারত সরকার ইচ্ছাকৃতভাবে ইসরায়েলের সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্ককে তাদের কূটনৈতিক সাফল্য হিসেবে তুলে ধরছে। যাতে ইসরায়েল সমর্থনকারীদের ভোট পাওয়া যায়।
তিনি বলেন, বিজেপির ‘হিন্দু রাষ্ট্র’ আদর্শ ও ইসরায়েলের জায়নবাদে মোহ এ সমর্থনের পেছনে প্রধান চালিকাশক্তি।
গাজা যুদ্ধ ও ভারতের ভূমিকা
জাতিসংঘে গাজা যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবে ভোট না দেওয়ার ঘটনাকে ‘লজ্জাজনক’ বলে অভিহিত করেছেন ভারতের জাতীয় আন্দোলনের জোট ন্যাশনাল অ্যালায়েন্স অব পিপলস মুভমেন্টসের (এনএপিএম) সমন্বয়ক মীরা সংঘমিত্র। তিনি বলেন, ভারত সরকারের ইসরায়েলের সঙ্গে এই চুক্তি করা উচিত নয়; বরং নেতানিয়াহুর যুদ্ধাপরাধের জন্য আন্তর্জাতিকভাবে জবাবদিহির দাবি তোলা উচিত।
ইসরায়েলের অর্থনৈতিক সংকট ও ভারতের কৌশল
মধ্যপ্রাচ্যে একাধিক যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ায় ইসরায়েলের অর্থনীতি চাপে রয়েছে। ২০২৪ সালে প্রবৃদ্ধি মাত্র দশমিক ৯ শতাংশ হলেও সামরিক খাতে ব্যয় ২১ শতাংশ বাড়িয়েছে দেশটি। এর ফলে বিনিয়োগকারীদের আস্থা কমেছে এবং হাইফা বন্দরে মেরস্ক কোম্পানির কার্যক্রম স্থগিত হয়ে পড়ে, যার প্রভাব পড়েছে ভারতের আদানি গ্রুপের ওপরও।
হাইফা বন্দর ভারত-মধ্যপ্রাচ্য-ইউরোপ অর্থনৈতিক করিডরের অংশ, যা দুই দেশের কৌশলগত সম্পর্ককে আরও জোরদার করেছে।
অস্ত্র বাণিজ্য ও ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’
ভারত দীর্ঘদিন ধরেই ইসরায়েলের কাছ থেকে অস্ত্র আমদানি করে আসছে। বর্তমানে ভারত ইসরায়েলের সবচেয়ে বড় অস্ত্র আমদানিকারক। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দিল্লি দেশীয়ভাবে ইসরায়েলি অস্ত্র যৌথভাবে উৎপাদনের দিকেও এগিয়েছে।
মোয়াসওয়েস বলেন, এই বিনিয়োগ সুরক্ষা চুক্তি আসলে ভারতের ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ নীতিরই অংশ, যার মাধ্যমে দুই দেশের মধ্যে পারস্পরিক নির্ভরতা বাড়ানো হচ্ছে।
সমালোচনার মুখে দিল্লি
ভারতের সমাজকর্মীরা গত দুই বছর ধরে ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক পুনর্বিবেচনার আহ্বান জানিয়ে আসছেন। বিশেষ করে গাজা যুদ্ধে ইসরায়েলকে ড্রোন ও এআই পরিচালিত অস্ত্র পাঠানোর অভিযোগ ওঠার পর।
এ ছাড়া, ফিলিস্তিনি শ্রমিকদের পরিবর্তে হাজার হাজার ভারতীয় শ্রমিক পাঠানোর পরিকল্পনা নিয়েও বিরোধিতা চলছে। তবে ভারত সরকার অস্ত্র চুক্তিগুলোকে ‘জাতীয় স্বার্থ’ হিসেবে ব্যাখ্যা করে তাদের অবস্থানে অনড়।
প্রতিবাদ দমন
চলমান পশ্চিমা বিক্ষোভ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বয়কটের মুখে ইসরায়েল এখন পূর্ব দিকে, বিশেষ করে ভারতের দিকে ঝুঁকছে। ইসরায়েলি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ভারতীয় প্রযুক্তি ও প্রকৌশল খাতের সঙ্গে অংশীদারত্ব বাড়াচ্ছে।
একই সঙ্গে, ভারতের অভ্যন্তরে ইসরায়েলবিরোধী বিক্ষোভ দমন করা হচ্ছে। গত জুনে দিল্লিতে ফ্লোটিলা হামলার প্রতিবাদকারীদের মারধর করেছে পুলিশ।
বিশ্লেষকদের মতে, ভারত ও ইসরায়েল একে অপরের ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রনীতি, সামরিক আগ্রাসন ও দমনমূলক কর্মকাণ্ডকে সহযোগিতা করছে। এই সম্পর্ক এখন অস্ত্র, অর্থনীতি ও কূটনীতির বাইরে গিয়ে আদর্শিক মৈত্রীর রূপ নিচ্ছে, যা বৈশ্বিক সামরিক-শিল্প কাঠামোকে আরও শক্তিশালী করছে।
তথ্যসূত্র : মিডলইস্ট আই
মন্তব্য করুন