টানা কয়েক দিনের সংঘাতের পর ১০ মে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ঘোষণায় থেমে যায় ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের ঝুঁকি। তিনি জানান, তার প্রশাসনের মধ্যস্থতায় দুই দেশের মধ্যে ‘পূর্ণাঙ্গ ও তাৎক্ষণিক’ যুদ্ধবিরতি হয়েছে। যদিও এতে উপমহাদেশে স্বস্তি আসে, ভারতের ভেতরে প্রশ্ন ওঠে- এ বিজয় না পরাজয়?
মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্স, পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও এবং হোয়াইট হাউসের চিফ অব স্টাফ স্যুজি ওয়াইলস জরুরি কূটনৈতিক হস্তক্ষেপে এই সংঘাত ঠেকান। জেডি ভ্যান্স সরাসরি ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে পরিস্থিতির ভয়াবহতা সম্পর্কে সতর্ক করে দেন।
যুদ্ধবিরতির ঘোষণায় বিশ্ববাসী হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেও, ভারতের রাজনৈতিক ও সামরিক অঙ্গনে এ নিয়ে উঠেছে তীব্র বিতর্ক। ভারতের সাবেক সেনাপ্রধান ভেদ প্রকাশ মালিক প্রশ্ন তুলেছেন, ‘আমরা আসলে কী পেলাম?’ সংসদ সদস্য আসাদুদ্দিন ওয়াইসির প্রশ্ন, তৃতীয় পক্ষের হস্তক্ষেপ তো ভারতের নীতির পরিপন্থি- এবার কেন ব্যতিক্রম?
এই ক্ষোভের পেছনে যুক্তি আছে। ট্রাম্প শুধু যুদ্ধবিরতির ঘোষণাতেই থামেননি; কাশ্মীর ইস্যুতে সমাধানের কথাও তুলেছেন। আর এটিই ভারতের দীর্ঘদিনের ‘অভ্যন্তরীণ বিষয়’ নীতিকে কাঁপিয়ে দিয়েছে।
কাশ্মীরের পেহেলগামে ২২ এপ্রিলের হামলার প্রতিক্রিয়ায় ভারতের ‘অপারেশন সিঁধুর’ দেখাতে চেয়েছিল শক্তি, কিন্তু তা আরও প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। পাকিস্তান পাল্টা হামলায় ৫টি ভারতীয় যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করার দাবি করে- তাও আবার চীনের গোয়েন্দা সহায়তায়। ভারতীয় পক্ষ এসব দাবি অস্বীকার করলেও মার্কিন কর্মকর্তাদের বরাতে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে এসেছে ভিন্ন তথ্য।
রাফাল জেট নিয়ে ভারতীয় গণমাধ্যমের উচ্ছ্বাসও ধাক্কা খেয়েছে বাস্তবতার দেয়ালে। করাচিতে ‘ধ্বংসাত্মক হামলা’র প্রচারণা মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে, যেটি ভারতীয় ভাবমূর্তির ক্ষতি করেছে।
উল্টো, পাকিস্তানও ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলা চালিয়ে ভারতের ভেতরেও আঘাত হেনেছে- সামরিক ঘাঁটি ও বেসামরিক এলাকায়। যা স্পষ্ট করে দেয়, এই সংঘাতে ভারতের একতরফা কৌশল ব্যর্থ হয়েছে।
সবচেয়ে বড় বিষয়, চীনের প্রযুক্তি ও সহায়তায় পাকিস্তানের নজরদারি ও প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়ন ভারতের তুলনায় বেশি কার্যকর প্রমাণিত হয়েছে। ভারতের নিজস্ব বিশ্লেষকরাও বহুদিন ধরে সতর্ক করে আসছিলেন- পাক-চীন জোটের বিরুদ্ধে দিল্লি প্রস্তুত নয়। কিন্তু নীতিনির্ধারকরা এসব সাবধানবাণীকে গুরুত্ব দেননি।
এই পুরো পরিপ্রেক্ষিত ভারতের আঞ্চলিক নেতৃত্বের ভাবমূর্তি, তার সামরিক সক্ষমতা ও কূটনৈতিক নীতিকে একসঙ্গে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। যুদ্ধবিরতির ঘোষণাটা ট্রাম্প দিলেও- আন্তর্জাতিক মহলে বিষয়টি যেন ভারতের সীমাবদ্ধতা ও পরনির্ভরতার এক অনিবার্য স্বীকৃতি।
এখন দিল্লি প্রতিক্রিয়ায় সামরিকীকরণ বাড়াতে পারে, কিন্তু তা বাস্তব সমস্যার সমাধান নয়। বরং পাকিস্তান ও ভারতের মতো পারমাণবিক শক্তিধর কিন্তু অর্থনৈতিক ও মানবসম্পদে পিছিয়ে থাকা দেশগুলোর জন্য সংযমই একমাত্র দায়িত্বশীল পথ। নয়তো রাজনৈতিক আত্মম্ভরিতা ও সংঘাতের অঙ্কচিত্রে ডুবে যাবে দুই জাতির ভবিষ্যৎ।
বিশ্বের প্রতি চারজন দরিদ্র মানুষের একজন এবং ৩৫ কোটির বেশি নিরক্ষর প্রাপ্তবয়স্ক যে দুটি দেশে বাস করে, সেই ভারত ও পাকিস্তানের পক্ষে দীর্ঘদিন ধরে যুদ্ধ কিংবা সামরিক উত্তেজনা ধরে রাখা বাস্তবসম্মত নয়।
চলমান সংঘাত একদিকে যেমন ভারতের উন্নয়নযাত্রায় বড় বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে, অন্যদিকে পাকিস্তানের নাজুক অর্থনীতিকে সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত করে তুলতে পারে—আর এই ক্ষতির মাত্রা হবে তাদের যেকোনো অর্জনের তুলনায় অনেক বেশি ভয়াবহ।
আল জাজিরায় ইউসুফ নজরের প্রবন্ধ থেকে অনুবাদকৃত
মন্তব্য করুন