পেশাদারিত্বের মোড়কে আবেগকে আটকানোর একটা চেষ্টা তিনি করেছিলেন। কিন্তু পারলেন কোথায়? তামিম ইকবাল—তিনিও তো রক্ত-মাংসের মানুষ। বাবার হাত ধরে যে খেলাটার সঙ্গে পরিচয়। যে খেলাটা তাকে খ্যাতি-যশ-অর্থ-বিত্ত সবই দিয়েছে। যে খেলাটা তাকে ষোলো বছর ধরে দেশকে প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ দিয়েছে, সেই ক্রিকেটকে এভাবে ‘বিদায়’ বলতে হবে ভাবতে পেরেছিলেন কি!
দেশের অধিনায়কত্ব করা, দেশের পক্ষে সবচেয়ে বেশি রানের মালিক আফগানিস্তান সিরিজের মাঝপথে যেভাবে সংবাদ সম্মেলন ডেকে ‘অবসর’-এর ঘোষণা দিলেন, তাতে মনে হতে পারে অনেক ভেবেচিন্তে তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। সিদ্ধান্ত তার। তবে সিদ্ধান্ত নিতে তিনি বাধ্য হয়েছেন! তা না হলে বিশ্বকাপের তিন মাস আগে অধিনায়ক চোখের জলে অবসর নেবেন কেন? অনেকটা তড়িঘড়ি করে মিডিয়ার সামনে নিজের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটীয় সত্তাকে
মৃত ঘোষণা করলেন বাংলাদেশের সর্বকালের অন্যতম সেরা ব্যাটার। কেন যাচ্ছেন? এ প্রশ্নের সুযোগও দিলেন না ‘দ্য প্রিন্স অব চিটাগং’! নিজের শহরে বসেই ক্রিকেটকে বিদায় জানালেন; কিন্তু
রাজপুত্রের সেই বিদায় রাজকীয় হলো কোথায়?
আসলে বাংলাদেশ ক্রিকেটে মাঠ থেকে রাজকীয় বিদায় কেউ নিতে পেরেছে বলে মনে পড়ে না! তবে তামিমের বিদায়ে সেই স্বতঃসিদ্ধ নিয়মের একটা ব্যত্যয় ঘটল যেন! অন্তত লোকে বলতে শুরু করল, ‘সে কি এখনই!’ এই লেখা লিখতে বসার পরও বিদেশি বিভিন্ন গণমাধ্যম থেকে ফোন, বিশ্বকাপের ঠিক মাস তিনেক আগে তামিম অবসর সম্পর্কিত এ ধরনের একটা দর্শন বেছে নিলেন কেন? প্রেসের সামনে অবসরের ঘোষণার নজির তামিমের চাচা আকরাম খানেরও আছে। কিন্তু তার অবসর নিয়ে সে সময় প্রশ্ন ওঠেনি, ‘এখনই কেন!’ তামিমের বেলায় উল্টো হলো, শুধু দেশজ ক্রিকেট প্রেস নয়। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের মিডিয়া জানতে চাইছে এভাবে কেন?
উত্তর তামিম বাষ্পজড়ানো গলায় বলেছেন, ‘আমার ক্রিকেট নিয়ে আলোচনায় এখানেই দাড়ি টেনে দিন।’
ধরে নিলাম তামিম ভেবেচিন্তে ক্রিকেট ছেড়েছেন! কিন্তু সেটা যুক্তিগ্রাহ্য হয় না। মাত্র আটচল্লিশ ঘণ্টা আগে যে লোকটা বললেন, ‘আমি পুরোপুরি ফিট না। কিন্তু ম্যাচ খেলব।’ সেই লোকটা অনেক ভেবেচিন্তে ক্রিকেটকে বিদায় জানিয়ে দিলেন হঠাৎ মিডিয়াকে ডেকে! মন সায় দেয় না, তার এমন সাজানো-গোছানো উত্তরে! বরং তার মন নিশ্চয়ই বলেছে, আমি দলের অধিনায়ক। চলতি সিরিজের মাঝপথে আমি কেন সরে যাব। দল যতই সিরিজে পিছিয়ে থাকুক। জয়ের সম্ভাবনা শেষ হয়ে যায়নি। সামনে বিশ্বকাপ। বিদায় নিতে হলে মাঠ থেকেই নেব। কিন্তু তিনি বিদায় নিলেন মলিন বেদনাবিদীর্ণ চেহারায়! কোথায় তার মাথায় গর্বের সেই বাংলাদেশ ক্যাপ? ব্লেজার, কিংবা টি-শার্ট? যার ব্যাট থেকে আতশবাজির মতো ক্রিকেটীয় আলোকছটা বেরিয়ে এসেছে, আলোকিত করেছে বাংলাদেশ ক্রিকেটকে, আনন্দের বন্যায় ভাসিয়েছে ক্রিকেটপ্রেমীদের হৃদয়, তার ভেতরের সব মজুত থাকা বারুদ কি পুড়ে শেষ হয়ে গেল কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই!
দেশজ মিডিয়া মোটামুটি জানত বিশ্বকাপে তামিমই বাংলাদেশ দলের নেতৃত্ব দেবেন। কিন্তু তারাও আশ্চর্য, এখন অবসর কেন! কেউ বলেছেন, ছন্দে নেই। তবু লড়ছে। আমাদের দেশে এই লড়াইয়ের খুব একটা দাম নেই। কিন্তু অস্ট্রেলিয়ানদের কাছে এটা খুব সম্মানের। ওরা এটাকে বলেন, ব্যাটলার। লড়াকু। যে পেশাতেই থাকুন, এই ব্যাটলারদের একটা আলাদা কদর আছে। কিন্তু এটা যে বাংলাদেশ! তাই তামিম ইকবালের ক্রিকেটীয় শেষ যাত্রায় সঙ্গী হয়ে থাকল দীর্ঘশ্বাস আর আবেগ! ক্যারিয়ারের অন্তিম প্রহরে এসে আবেগের আস্তরণ তৈরি হলো, যা তামিম ইকবালকে দিয়েও বলিয়ে নিলো, ‘বিদায় ক্রিকেট’! তামিমের মুখে এই বাক্যগুলো উচ্চারিত হওয়ার পর ওপারে বসে থাকা তার বাবার চোখ থেকেও দু-ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল কি না কে জানে! কারণ, তামিমের ক্রিকেট জীবন যে উৎসর্গিত তার বাবা ইকবাল খানের স্মরণে।
কোনো জয়ধ্বনিতে তৃপ্তির অবসর নয় তামিম ইকবালের। তার জায়গা ভরাট হতে সময় লাগবে বাংলাদেশ ক্রিকেটে। তবে তামিমের অবসরে বাংলাদেশ ক্রিকেটে দীর্ঘদিনের একটা আক্ষেপের শেষ হতে পারে। এত বছর টেস্ট খেললেও ক্রিকেট সার্কিটে সাড়া ফেলার মতো কোনো টেস্ট ক্রিকেটারকে কমেন্টেটর হিসেবে পায়নি বাংলাদেশ। তামিম সেই অভাব পূরণ করতে পারেন। প্রেস কনফারেন্স শেষ করে চোখের জলে ইতিহাস হয়ে গেলেন তামিম। কিন্তু তিনি তো বাংলাদেশ ক্রিকেটে অনেক ইতিহাসের স্রষ্টা। মানুষটা চলে গেলেন দল ছেড়ে। কিন্তু রেখে গেলেন ষোলো বছরের স্মৃতি। বাংলাদেশ ক্রিকেটের কত উত্থান-পতন, কত ঝড়ঝাপটার সাক্ষী। সেসব স্মৃতি নিশ্চয়ই ভিড় করবে তামিম ইকবালের মনে।
তবে ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় যেভাবে অবসরের সিদ্ধান্ত নিন না কেন তামিম, আরও একটু সম্মান তার প্রাপ্য ছিল।
মন্তব্য করুন